লিবিয়ায় অবস্থান করা মানব পাচারকারীরা সেদেশে অপহরণের শিকার বাংলাদেশিদের মুক্তিপণের টাকা লেনদেন করেছে চট্টগ্রামের সেলিম অ্যান্ড ব্রাদার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে। এ প্রতিষ্ঠানের মালিক মোহাম্মদ মামুন সালাম ও তার স্ত্রী কানিজ ফাতেমা। মোহাম্মদ মামুন সালাম সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের মামাতো ভাই বলে জানা গেছে।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এ তথ্য। এ ঘটনায় চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানায় গত ১৫ অক্টোবর একটি মামলা হয়। সেলিম অ্যান্ড ব্রাদার্সের মাধ্যমে হুন্ডি এবং মানব পাচারের অন্তত ৩৭ কোটি ৭২ লাখ ১৭ হাজার ৯৬০ টাকা পাচার হয়েছে। মামলার আসামিরা হলেন- মোহাম্মদ মামুন সালাম ও তার স্ত্রী কানিজ ফাতেমা, তানভীর হাসান এবং সজল ইসলাম।
সিআইডি বলছে, বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবের মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংকের চট্টগ্রাম মুরাদপুর শাখা, ওয়ান ব্যাংকের জুবিলি রোড শাখা এবং ইউসিবি ব্যাংকের একই এলাকার শাখাসহ মোট তিনটি ব্যাংক হিসাব বিশ্লেষণ করা হয়। ওইসব ব্যাংক হিসাবে টাকা জমাদানকারী ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে সংস্থাটি। এদের কেউ মোবাইল এক্সেসরিস ব্যবসায়ী, কম্পিউটার ব্যবসায়ী, কাপড় ব্যবসায়ী, ইলেকট্রনিক পণ্য ব্যবসায়ী এবং কেউ স্বর্ণ ব্যবসায়ী। আবার কেউ চিকিৎসার জন্য ভারতে টাকা পাঠানোর নামে ওইসব হিসাবে জমা দিয়েছেন এবং ভারত থেকে রুপি সংগ্রহ করেছেন। এ ছাড়া কেউ কেউ বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা পাঠানোর জন্য সরাসরি সেলিম অ্যান্ড ব্রাদার্সের ব্যাংক হিসাবে টাকা জমা দিয়েছেন এবং বিদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করেছেন।
সংস্থাটির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএস) মোহাম্মদ বাছির উদ্দিন এ প্রতিবেদককে জানান, এই চক্রে আরও কেউ আছে কি না তা বের করতে তদন্ত চলছে। আর তদন্ত কাজ চলমান আছে। সিআইডির অনুসন্ধানে জানা গেছে, লিবিয়ায় অবস্থানরত মানব পাচারকারীরা বিদেশগামী বাংলাদেশিদের ওই দেশে আটক রেখে সেলিম অ্যান্ড ব্রাদার্সের ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে মুক্তিপণের অর্থ গ্রহণ করেছে। এ ছাড়াও আল আমিন নামে এক ব্যক্তি মোবাইল এক্সেসরিসের ব্যবসা করেন। তিনি যাদের কাছ থেকে মালামাল কেনেন তারা তাদের পণ্যের মূল্য সেলিম অ্যান্ড ব্রাদার্সের ব্যাংক হিসাবে জমা দিতে বলেন। আল আমিন ব্র্যাক ব্যাংকের ১১১৩২০৪৬৩৯৪১৮০০ নম্বর হিসাবে ২০২১ সালের ১১ আগস্ট এবং ২২ আগস্ট ৮ লাখ করে মোট ১৬ লাখ টাকা জমা দেন। মানিক চন্দ্র রায় চায়না থেকে আসা বিভিন্ন কম্পিউটার, সিসিক্যামেরা, সফটওয়্যার ইত্যাদি পণ্যের মূল্য পরিশোধ বাবদ তার মালিক ইলিয়াস মোল্লার কথামতো সেলিম অ্যান্ড ব্রাদার্সের ওয়ান ব্যাংকের ০২৩১০২০০০৬৫৪৪ নম্বর ব্যাংক হিসাবে ২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর ৬ লাখ ৪০ হাজার ২০০ টাকা জমা দিয়েছেন।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, সাদিয়া সুলতানার স্বামীকে মানব পাচারকারীরা লিবিয়ায় আটকে রেখে মুক্তিপণের টাকা চায়। অপহরণকারীরা তাকে সেলিম অ্যান্ড ব্রাদার্সের ব্র্যাক ব্যাংকের ১১১৩২০৪৬৩৯৪১৮০০১ নম্বর হিসাবে টাকা দিতে বলে। সাদিয়া ২০২২ সালের ২১ এপ্রিল ৬ লাখ ৩০ হাজার ৫০০ টাকা জমা দেন। আমিনুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি চায়না থেকে আসা তৈরি পোশাক, ফার্নিচার, ইলেকট্র্রনিক্স আইটেম, বাচ্চাদের খেলনা ইত্যাদি পণ্য আমদানির মূল্য পরিশোধ বাবদ তার মালিক নুরে আলম ভূঁইয়ার কথামতো সেলিম অ্যান্ড ব্রাদার্সের ব্যাংক হিসাবে ২০২১ সালের ১২ এপ্রিল ১১ লাখ এবং ২৮ এপ্রিল ১০ লাখ টাকা জমা দেন।
মোজাম্মেল হক হুমায়ূন নামে এক ব্যক্তি দুবাই থেকে আসা স্বর্ণ ক্রয়ের মূল্য পরিশোধ বাবদ বিক্রেতা আবু বক্করের কথামতো সেলিম অ্যান্ড ব্রাদার্সের ব্যাংক হিসাবে ২০২১ সালের ২৮ অক্টোবর সাড়ে ৬ লাখ এবং এর আগে ২৪ অক্টোবর তার কর্মচারী সুমনকে দিয়ে ৩০ লাখ টাকা জমা দেন। এ ছাড়া মাসুদ পারভেজ নামে আরেক টাকা জমাদানকারী তার দোকানের মালিক নাজমুল ইসলামকে ভারতের চেন্নাইতে চিকিৎসা বাবদ টাকা পাঠানোর জন্য সেলিম অ্যান্ড ব্রাদার্সের ওয়ান ব্যাংকের হিসাবে ২০২১ সালের ৮ জুন ৬ লাখ টাকা জমা দেন।
জানা গেছে, ২০২৩ সালে মেঘনা ব্যাংক লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদে মোহাম্মদ মামুন সালাম ভাইস চেয়ারম্যান ও এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। মামুন সালাম মেঘনা ব্যাংকের স্পন্সর ডিরেক্টর এবং ব্যাংকের বোর্ডে সেলিম অ্যান্ড ব্রাদার্স লিমিটেডের প্রতিনিধিত্ব করেন। সেলিম অ্যান্ড ব্রাদার্স লিমিটেড ছাড়াও সালাম অ্যাপারেল লিমিটেড, ফ্যাশন ক্রাফট লিমিটেড, রিলায়েন্স অ্যাপারেলসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদেও রয়েছেন তিনি।
সিআইডির অনুসন্ধানে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, মামলার আসামি তানভীর হাসান তার ভাই সজল ইসলামের কথামতো সেলিম অ্যান্ড ব্রাদার্সের ব্র্যাক ব্যাংকের হিসাবে ২০২১ সালের ৯ জুন ৫০ লাখ টাকা এবং ১০ জুন আরও ৫০ লাখ টাকাসহ মোট ১ কোটি টাকা জমা দেন। এই টাকার সমপরিমাণ মুদ্রা সজল ইসলাম মালয়েশিয়া থেকে গ্রহণ করেন। এমন কয়েক শ ব্যবসায়ী বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশ থেকে তাদের ব্যবসাসংক্রান্ত পণ্য আমদানি করে সেসব পণ্যের মূল্য পরিশোধের জন্য সেলিম অ্যান্ড ব্রাদার্সের বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে জমা দিয়েছেন। অথচ মামলার আসামিদের সঙ্গে তাদের কোনো ব্যবসায়িক সম্পর্ক নেই। অভিযুক্ত মামুন সালাম ও তার স্ত্রী কানিজ ফাতেমা তাদের ব্যাংক হিসাবে জমা হওয়া বিপুল পরিমাণ টাকা তার বিকাশ ডিস্ট্রিবিউশন হিসাবের মাধ্যমে ই-মানিতে রূপান্তর করে তার নিয়ন্ত্রনাধীন বিভিন্ন বিকাশ এজেন্ট নম্বরে প্রেরণ করে। বাকি টাকা তারা ব্যাংক থেকে উত্তোলন করেন।