উত্তর কোরিয়া আবারও বিশ্ববাসীর নজর কাড়লো। কারণ উত্তর কোরিয়া এমন একটি উন্নত যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ করছে, যা দেশটির সামরিক সক্ষমতার একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
সাম্প্রতিক স্যাটেলাইট চিত্রে ধরা পড়েছে এমন একটি যুদ্ধজাহাজ, যা হতে যাচ্ছে দেশটির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এবং একইসঙ্গে প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত। সামরিক শক্তি বাড়ানোর উত্তর কোরিয়ার এই প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন করে আলোচনা তৈরি করেছে।
স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে, পশ্চিম উপকূলের নামপো শিপইয়ার্ড কমপ্লেক্সে প্রায় ১৪০ মিটার (৪৬০ ফুট) দৈর্ঘ্যের একটি গাইডেড মিসাইল ফ্রিগেট নির্মাণাধীন রয়েছে। জাহাজটি এখন ফিটিং আউট পর্যায়ে আছে- অর্থাৎ এর অভ্যন্তরীণ অবকাঠামো প্রস্তুত হচ্ছে এবং অস্ত্র ও অন্যান্য সরঞ্জাম স্থাপন করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই যুদ্ধজাহাজে থাকতে পারে ভিএলএস লঞ্চ সিস্টেম, যা থেকে ভূমি-আকাশ বা সমুদ্রে লক্ষ্য করে মিসাইল নিক্ষেপ করা সম্ভব হবে। উত্তর কোরিয়ার নৌবাহিনীর ইতিহাসে এমন ক্ষমতা আগে দেখা যায়নি।
যদিও দেশটির নৌবাহিনী সাধারণত উপকূলবর্তী অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকে, তবুও এই জাহাজ নির্মাণ দেশটির সামুদ্রিক আধিপত্য বিস্তারের সংকেত দিচ্ছে। সামরিক আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে এটিকে কৌশলগত অগ্রগতি বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এর আগে, উত্তর কোরিয়া একটি পারমাণবিক চালিত সাবমেরিনও উন্মোচন করেছিল, যা ৬ হাজার থেকে ৭ হাজার টন ওজনের এবং ১০টি পারমাণবিক মিসাইল বহনে সক্ষম। এইসব পদক্ষেপ উত্তর কোরিয়ার শক্তি প্রদর্শন এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অবস্থান পুনঃনির্ধারণের স্পষ্ট ইঙ্গিত।
যুদ্ধজাহাজ নির্মাণের চ্যালেঞ্জ
যে কোনও জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে আধুনিক যুদ্ধজাহাজ তৈরি করা সম্ভব হলেও এটি একটি জটিল চ্যালেঞ্জ, যা যোগাযোগ, ইলেকট্রনিক্স, অস্ত্র, এবং বৈদ্যুতিন ও শব্দ সেন্সর প্রযুক্তির একত্রিতকরণকে কার্যকরভাবে সম্পাদন করতে হয়। বিষয়টি নিয়ে সাবেক মার্কিন নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন ও জাহাজ নির্মাণ বিশ্লেষক কার্ল শুস্টার বলেছেন, আধুনিক যুদ্ধজাহাজগুলো এমন একটি সংযোজন চ্যালেঞ্জ, যা সহজে অর্জন করা যায় না।
স্যাটেলাইট চিত্র পর্যালোচনা করার পর শুস্টার বলেন, এখনো এক বছর বা তারও বেশি সময় লাগবে নতুন উত্তর কোরিয়ার যুদ্ধজাহাজটির সমুদ্র পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হতে। এই জাহাজটির নির্মাণে বিলম্ব হচ্ছে এর সুপারস্ট্রাকচার, সেন্সর এবং অস্ত্র ব্যবস্থা ইনস্টল করার অভাবে।
গত মার্চে সিএনএনের সাথে এক সাক্ষাতকারে দক্ষিণ কোরিয়ার আইনপ্রণেতা কিম বিয়াং-কি প্রশ্ন করেছিলেন যে, পিয়ংইয়ং কি উন্নত যুদ্ধজাহাজ তৈরি করার প্রযুক্তিগত সক্ষমতা এবং এটির জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো অর্জন করতে পারবে কিনা?
তিনি বলেন, এত বড় একটি সামরিক যুদ্ধজাহাজ পরিচালনা করতে প্রচুর বাজেট প্রয়োজন। তাদের শুধুমাত্র যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ করতে হবে না, একটি দল তৈরি করতে হবে যারা এটি পরিচালনা করবে। এছাড়া একটি বিশাল যুদ্ধজাহাজ একা চলতে পারে না। প্রশ্ন হচ্ছে, উত্তর কোরিয়া কি এই খরচ বহন করতে সক্ষম?
অবসরপ্রাপ্ত দক্ষিণ কোরিয়ান অ্যাডমিরাল কিম আরও সতর্কভাবে বলেছেন, তিনি অবমূল্যায়ন করতে চান না, বিশেষ করে এর ক্ষতিকর ক্ষমতা নিয়ে। তিনি বলেন, যদি উত্তর কোরিয়া তার নতুন ফ্রিগেটকে হাইপারসোনিক ব্যালিস্টিক মিসাইল দিয়ে সজ্জিত করে, যেটি তারা জানুয়ারিতে সফলভাবে পরীক্ষা করেছে, তবে তা আঞ্চলিক নিরাপত্তার ওপর বিপর্যয়কর প্রভাব ফেলবে।
উত্তর কোরিয়ার নৌবাহিনীর সীমাবদ্ধতা
উত্তর কোরিয়ার নৌবাহিনীতে প্রায় ৪০০টি পেট্রোল কমব্যাট্যান্ট এবং ৭০টি সাবমেরিন রয়েছে, যা ২০২১ সালের একটি মার্কিন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে সর্বশেষ হিসেব করা হয়েছে। যদিও এই সংখ্যাটি অনেক, তবে বেশিরভাগই পুরনো এবং ছোট।
আন্তর্জাতিক কৌশলগত গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষক জোসেফ ডেম্পসে জানুয়ারিতে একটি ব্লগ পোস্টে লিখেছিলেন যে, পিয়ংইয়ংয়ের প্রধান মাত্র দুইটি সারফেস কমব্যাট্যান্ট রয়েছে। ওই নাজিন-শ্রেণির ফ্রিগেটগুলি ১,৬০০ টন ওজনের যুদ্ধজাহাজ, যা ১৯৭০-এর দশকের শুরুর দিকে নির্মিত হয়েছিল আর সেগুলি পুরনো হয়ে পড়েছে। মার্কিন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, উত্তর কোরিয়ার নৌবাহিনী কোন দ্বন্দ্বে দক্ষিণ কোরিয়া বা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রাথমিকভাবে উপকূলীয় প্রতিরক্ষা নিয়ে সীমাবদ্ধ থাকবে, কারণ তাদের নৌবাহিনী অনেকটাই পিছিয়ে।
তবে উত্তর কোরিয়ান নেতা কিম জং উন তার নৌবাহিনী আধুনিক করার জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। তারা সাবমেরিন-লঞ্চড মিসাইল এবং এগুলি বহন করতে সক্ষম সাবমেরিনও তৈরি করছে। দক্ষিণ কোরিয়ার আইনপ্রণেতা ইউ ইয়ং-ওন বলেছেন, নামপো শিপইয়ার্ডে নির্মিত যুদ্ধজাহাজটি কিমের নৌবাহিনী আধুনিক করার প্রচেষ্টার একমাত্র উদাহরণ। এছাড়া উত্তর কোরিয়ার সিনপো বন্দরেও একটি পারমাণবিক চালিত সাবমেরিন নির্মাণাধীন এবং চংজিনে আরও একটি ফ্রিগেট বা ডেস্ট্রয়ার তৈরির কাজ চলছে বলেও জানান তিনি।
তথ্য সূত্র- সিএনএন।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ