সংকটের শেষ নেই ঢাকার বাইরের বিভাগ, জেলা, উপজেলার সরকারি হাসপাতালগুলোতে। একবার নষ্ট হলে আর মেরামত হয় না যন্ত্রপাতি, চালু হচ্ছে না আইসিইউ। জনবলের সংকটে খুঁড়িয়ে চলছে সেবা কার্যক্রম। জরুরি রোগীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েই রেফার্ড করা হয় ঢাকার হাসপাতালগুলোতে। প্রয়োজনীয় সেবা না পাওয়ায় ভোগান্তিতে রোগীরা, কমছে না ঢাকামুখী রোগীর স্রোত। প্রতিনিধিরা তুলে ধরেছেন হাসপাতালগুলোর নানমুখী সংকটের চিত্র।
চট্টগ্রাম : চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে পড়ে আছে অনেক অচল যন্ত্র। সংযুক্তিতে থাকা ২২ জন চিকিৎসককে একসঙ্গে বদলি করে দেওয়ায় ভেঙে পড়েছে চিকিৎসাসেবা। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আবদুল মান্নান বলেন, প্রধান সমস্যা জনবল সংকট। এর পরও রোগীর সেবা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে।
সিলেট : শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালটি সিলেটের মানুষের কাছে ‘সদর হাসপাতাল’ ও ‘পুরান মেডিকেল’ হিসেবে পরিচিত। কভিডের সময় ৮৮ জন চিকিৎসক সেবা কার্যক্রমে যুক্ত থাকলেও এখন আছেন ১৫ জন। আইসিইউ বিভাগ চলছে চিকিৎসক ছাড়া। একজন অ্যানেসথেসিওলজিস্ট দিয়ে চলছে অপারেশন থিয়েটার ও আইসিইইউ বিভাগ। চিকিৎসকের অভাবে বন্ধ রয়েছে অর্থোপেডিক্স ও চক্ষু বিভাগ। আইসিইউর ১৪টি ও ডায়ালাইসিসের দুটি বেড সচল থাকলেও হাসপাতালের ৪৩টি এয়ারকন্ডিশনের সব কটি নষ্ট।
হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মো. মিজানুর রহমান বলেন, সামর্থ্য অনুযায়ী হাসপাতালের রোগীদের সর্বোচ্চ চিকিৎসাসেবা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
গাজীপুর : শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নানা সমস্যায় জর্জরিত। সীমানা প্রাচীর এখনো তৈরি সম্পন্ন হয়নি। একমাত্র সিটিস্ক্যান মেশিনটি দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট। রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের ইনচার্জ মো. মোফাজ্জল হোসেন খান বলেন, ২০২৩ সালের ২৮ আগস্ট কাজ করা অবস্থায় বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় সিটিস্ক্যান মেশিনসহ পুরো ইউনিটটি বন্ধ হয়ে যায়। পরিচালক ডা. মো. আমিনুল ইসলাম জানান, জনবলের তুলনায় রোগী বেশি থাকায় চিকিৎসাসেবা চালাতে হিমশিম খেতে হয়।
সিভিল সার্জন ডা. মো. মামুনুর রহমান জানান, সরকার পাঁচ হাজার ডাক্তার নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছেন। নতুন ডাক্তার নিয়োগের পর এ সমস্যার সমাধান হবে।
বরিশাল : জেলা সদরের জেনারেল হাসপাতাল ও ১০ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রায় অর্ধেক চিকিৎসক পদ শূন্য। ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. সব্যসাচী দাস বলেন, শূন্যপদে চিকিৎসক পদায়নের জন্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
রংপুর : রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ১ হাজার শয্যার। প্রতিদিন চিকিৎসা নিচ্ছেন ২ হাজারের বেশি রোগী। জনবল সংকটে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসাসেবা। এনজিওগ্রাম, ডিজিটাল এক্স-রে মেশিন, সিটিস্ক্যান, কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিস মেশিন, অপারেশনের যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্তকরণ মেশিনসহ প্রায় ৪০০ মেশিন নষ্ট অবস্থায় রয়েছে। হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশিকুর রহমান জানান, জনবল এবং যন্ত্রপাতি সংকটের কারণে চিকিৎসাসেবা কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে।
রাজশাহী : রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শয্যার চেয়ে রোগী থাকছে তিনগুণ। পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফ এম শামীম আহাম্মদ জানান, হাসপাতালটি ১ হাজার ২০০ শয্যার। গড়ে প্রতিদিন আড়াই হাজারের বেশি রোগী ভর্তি থাকেন। ৬০ ওয়ার্ডের জন্য ৩৩৩ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও ২০ জন কম আছেন। নার্স সংকট না থাকলেও সহায়ক কর্মচারীর সংকট তীব্র।
মেহেরপুর : নানা সমস্যায় জর্জরিত মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতাল। চিকিৎসার জন্য চাপাচাপি করলেই কুষ্টিয়া, রাজশাহী, ঢাকায় রেফার্ড করা হয়। তত্ত্বাবধায়ক শাহারিয়া শায়লা জাহান বলেন, রেফার্ড চিকিৎসার একটি অংশ। প্রয়োজনেই রোগীকে রেফার্ড করা হয়। দেশের অন্য জেলার হাসপাতাল থেকে এখানকার হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা এখন অনেক ভালো।
চুয়াডাঙ্গা : জনবল সংকটের কারণে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে। ২৫০ শয্যার এ হাসপাতালে জনবলের অনুমোদন আছে ৫০ শয্যার। খাবারের বরাদ্দ ১০০ শয্যার। বেশির ভাগ সময় ৪০০-৫০০ রোগী ভর্তি থাকে। তত্ত্বাবধায়ক ডা. বিদ্যুৎ কুমার বিশ্বাস বলেন, সদর হাসপাতালটি ২৫০ শয্যার হলেও ৫০ শয্যার জনবলেও ঘাটতি রয়েছে। এ হাসপাতালে খাবার ও ওষুধে ১০০ শয্যার বরাদ্দ থাকলেও বর্তমানে এখানে তিন-চার গুণ বেশি রোগী সব সময় ভর্তি থাকছে।
খাগড়াছড়ি : জেলা আধুনিক সদর হাসপাতাল ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হলেও ১০০ শয্যার লোকবল নিয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। ৯ তলা নতুন ভবনের কার্যক্রমও চলছে ধীরগতিতে। চিকিৎসক র্কমচারীসহ ১০৬টি পদ খালি রয়েছে। হাসপাতালে করোনাকালে বরাদ্দ করা আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সটি জনবল না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে পড়ে আছে।
কিশোরগঞ্জ : শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের বাইরে থেকে পরীক্ষা করাতে হচ্ছে। ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. হেলিশ রঞ্জন সরকার ওষুধ ও রি-এজেন্ট সংকটের কথা স্বীকার করে বলেন, আগে যিনি পরিচালক ছিলেন তার সময়ে অর্থাৎ গত অর্থবছরে টেন্ডার হয়নি। ফলে কেনাকাটা বন্ধ ছিল। এ কারণেই এগুলোর সংকট। টেন্ডার সম্পন্ন হলেই সংকট কেটে যাবে।
নড়াইল : দীর্ঘ ছয় বছরেও নড়াইল ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের ভবন নির্মাণ কাজ সমাপ্ত না হওয়ায় চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে। জেলা গণপূর্ত বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী শরীফ জিহাদ হোসেন জানান, ভবন নির্মাণ কাজের শুরুর দরপত্র ৭ তলাবিশিষ্ট হলেও পরবর্তীতে স্বাস্থ্য বিভাগ এটিকে পরিবর্তন করে ৯ তলায় উন্নীতকরণ করায় নির্মাণকাজ সঠিক সময়ে শেষ করা যায়নি। লিফট স্থাপনেও কাজ বিলম্বিত হচ্ছে।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আবদুল গফফার বলেন, হাসপাতালটিতে চিকিৎসকসহ জনবল সংকট রয়েছে। নতুন ভবন হস্তান্তর না হওয়ায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য গুরুতপূর্ণ যন্ত্রপাতি স্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে না।
নারায়ণগঞ্জ : জেলা শহরের খানপুরে ৩০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল ৫০০ শয্যায় উন্নীত করতে নতুন ভবন নির্মাণে দুই বছরের প্রকল্প ছয় বছরেও শেষ হয়নি।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আবদুল মোতালেব বলেন, ভবন নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের থেকে নতুন ভবনটি বুঝে নেবেন।
খানপুর ৩০০ শয্যা হাসপাতালের চিকিৎসা তত্ত্বাবধায়ক ডা. আবুল বাশার বলেন, ভবনটি আপাতত আমাদেরকে ৪ তলা পর্যন্ত বুঝিয়ে দেবে বলে কথা হয়েছে।
রাজবাড়ী : জেলা সদর হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরে নেই মেডিসিন ও চক্ষু বিভাগের চিকিৎসক। দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ জলাতঙ্কের ভ্যাকসিন সরবরাহ। ১০০ থেকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও পাঁচ বছরে শেষ হয়নি নতুন ভবন নির্মাণের কাজ। জেলা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. শেখ মোহাম্মদ আবদুল হান্নান বলেন, কয়েক মাস ধরে হাসপাতালে মেডিসিন ও চক্ষু চিকিৎসক নেই। যে কারণে সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
শরীয়তপুর : ১০০ শয্যার শরীয়তপুর সরকারি আধুনিক হাসপাতালে বেশির ভাগ যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করায় নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে রোগীদের। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. হাবিবুর রহমান বলেন, হাসপাতালে দক্ষ জনবলের অভাবে দীর্ঘদিন ব্যবহার না করায় অকেজো হয়ে পড়েছে মূল্যবান সব যন্ত্রপাতি।
টাঙ্গাইল : টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলা হাসপাতাল ভবনের পূর্ণাঙ্গ কাজ শেষ না হওয়ায় ১৮ বছর ধরে ঝুলে আছে উপজেলার প্রায় আড়াই লাখ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা। শুধু অবকাঠামো নির্মাণ না হওয়ায় ৫০ শয্যার পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি হাসপাতালটি। সামান্য কাটাছেঁড়ার জন্য রোগীকে টাঙ্গাইল রেফার করা হয়।
মেডিকেল অফিসার ডা. আতিকুল ইসলাম জানান, নতুন ভবন থাকলে আরও ভালো চিকিৎসাসেবা দেওয়া সম্ভব। বাসাইল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শার্লি হামিদ বলেন, অপর্যাপ্ত অবকাঠামোর বিষয়টি জানিয়ে প্রতি তিন মাস পর পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর চিঠি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।
যশোর : যশোর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রতিদিন সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন রোগী ও তাদের স্বজনরা। টিকিট কাউন্টার, ক্যাশ কাউন্টার, চিকিৎসকের কাছ পর্যন্ত পৌঁছানো, প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও তার রিপোর্ট হাতে পাওয়া এবং ফের চিকিৎসক দেখানো- প্রতিটি পদক্ষেপেই হয়রানির শিকার হচ্ছেন তারা। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মো. হুসাইন শাফায়েত বলেন, চিকিৎসক ও নার্স যথেষ্ট আছে। ভবন সংকটের কারণে সমস্যা হচ্ছে।
কুষ্টিয়া : ধারণক্ষমতার চার গুণ রোগীকে চিকিৎসা দিতে গিয়ে ২৫০ শয্যার হাসপাতালটিই এখন রোগাক্রান্ত। আবাসিক চিকিৎসক হোসেন ইমাম বলেন, ওষুধ আসে ২৫০ শয্যার অনুপাতে। সেই ওষুধ সব রোগীকে দিতে গেলে কিছুটা সংকট হবেই।
বাগেরহাট : জেলা ২৫০ শয্যা সরকারি হাসপাতালটিতে ২২০ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও আছে ২১ জন। ১৯৯ পদই শূন্য। চিকিৎসকের অভাবে জানুয়ারি থেকে ১০ শয্যার আইসিইউ ইউনিটও বন্ধ।
তত্ত্বাবধায়ক ডা. অসীম কুমার সমাদ্দার জানান, শয্যা অনুযায়ী জনবল এখনো পাওয়া যায়নি।
নোয়াখালী : নোয়াখালীর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের সাত তলা নতুন ভবনের নির্মাণকাজ পাঁচ বছরেও শেষ হয়নি। টিনের ঘরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে চিকিৎসা নিচ্ছেন রোগীরা। গত পাঁচ বছরেও নতুন ভবন নির্মাণ কাজ না হওয়ায় ঠিকাদারের গাফিলতিকে দায়ী করছেন গণপূর্ত বিভাগ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী জানান, আমরা বারবার ঠিকাদার ও গণপূর্ত বিভাগকে মৌখিকভাবে জানিয়েছি। গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী কামরুল হাসান জানান, সব কিছু ঠিক থাকলে চলতি মাসের শেষের দিকে কাজ বুঝিয়ে নেওয়া হবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ : জনবল সংকট ও ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের ভিড়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে। অভিযোগে জানা গেছে, শিবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কতিপয় চিকিৎসক সুযোগ বুঝে বাইরে বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিকে রোগী দেখছেন। ফলে তারা প্রতিদিন কর্মস্থলে না এসেও হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করছেন। এ ব্যাপারে শিবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা অফিসার বলেন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দালাদদের দৌরাত্ম্য কমানোর জন্য উপজেলা ও পুলিশ প্রশাসনকে লিখিত আবেদন করা হয়েছে।