বর্তমান বিশ্বে তথ্যপ্রযুক্তি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ এবং নগরায়ণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভাবনীয় অগ্রগতি হয়েছে। সর্বত্র আধুনিকতা ও ডিজিটাল ছোঁয়ায় পরিবর্তনের আবহাওয়া গতিশীল হচ্ছে প্রতিনিয়ত। শান্তির জন্য মানুষ উড়ে যাচ্ছে দেশ-বিদেশে। কিন্তু শান্তি নামক কাক্সিক্ষত বস্তুটি আজ নাগালের বাইরে। পৃথিবীর বস্তুবাদীরা যেখানেই শান্তি ও মুক্তির নীড় গড়ার স্বপ্ন আঁকছে, সেখানেই বিধ্বস্ত হচ্ছে অশুভ হস্তের হিংস্র থাবায়। আধুনিক পৃথিবী শান্তি ও মুক্তির পরিবর্তে শুনছে মরণাস্ত্রের ঝনঝনানি। শান্তির চিরশত্রু যুদ্ধ-বিগ্রহকে মানুষ নিজেদের অঙ্গ হিসেবে পরিণত করছে। পৃথিবীটাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অশান্তির দাবানলে আবদ্ধ হচ্ছে গোটা বিশ^। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হিসাব কষে, সচেতন মহলে যুদ্ধ থেকে বিরত থাকার শুভবুুদ্ধি উদয় হয়েছিল। যে ভাবনা থেকে গঠন হয় জাতিসংঘ। জাতিসংঘের মূল উদ্দেশ্য ছিল শান্তি নিশ্চিত করা, যুদ্ধ মুক্ত পৃথিবীর নিশ্চয়তা সম্ভব করা। তবে যুদ্ধবিগ্রহ মুক্ত শান্তিপূর্ণ পৃথিবীর সম্ভাবনা ক্রমেই অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। আজ মানুষ বাঁচানোর চিন্তার পরিবর্তে মানুষ মারার পরিকল্পনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানব নিধন ও যুদ্ধবিগ্রহের বাজেট হচ্ছে অসীম, অপরিমিত।
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় হাজার হাজার মানুষ মরছে, চলছে নির্বিচারে গণহত্যা। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাস্তুচ্যুত করে মানবজাতির জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে ভয়াবহ পরিস্থিতি। ইরান-ইসরায়েল পাল্টাপাল্টি হামলায় হতাহত হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। তছনছ হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন জনপদ। ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ অনেক অনেক স্থাপনা। এ সংঘাত বিশ্ববাসীর মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। পৃথিবীজুড়ে বেড়েই চলছে অস্ত্র প্রতিযোগিতা। আর মানুষের জীবন হয়ে উঠছে আরও দুর্বিষহ। বিশেষ করে নারী ও শিশু অধিকহারে বিপদগ্রস্ত হচ্ছে। অকাতরে জীবন দিচ্ছে যুবকরা। খাদ্য ও চিকিৎসাবঞ্চিত হচ্ছে লাখ লাখ জনতা।
ইসলাম সব ধরনের সংঘাতকে অসমর্থন করে। কোনো ধরনের অস্ত্রবাজি, সন্ত্রাস, আগ্রাসন ও জুলুম-নির্যাতনকে প্রশ্রয় দেয় না। বরং ইসলাম নারী, শিশু ও ধন-সম্পদের নিরাপত্তার জন্য যুদ্ধ করার নির্দেশ দেয়। নির্দেশ দেয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলা ও আত্মরক্ষার জন্য। মহান প্রভু ঘোষণা করেন, ‘তোমাদের কী হলো যে, তোমরা সংগ্রাম করবে না আল্লাহর পথে এবং অসহায় নর-নারী এবং শিশুদের বাঁচানোর জন্য? যারা বলছে, হে আমাদের প্রতিপালক! এই জনপদ যার অধিবাসীরা অত্যাচারী, তা হতে আমাদের অন্যত্র নিয়ে যাও। তোমার পক্ষ থেকে কাউকে আমাদের অভিভাবক করো এবং তোমার পক্ষ থেকে কাউকে আমাদের সহায়ক করো’ (সুরা আন নিসা-৭৫)।
প্রকৃত মুসলমান শুধু নিজের শান্তি ও নিরাপত্তা চায় না। বরং অন্যদের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষা করে। রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘মুমিন ব্যক্তি সেই, যার কাছ থেকে মানুষের জান ও মাল নিরাপদ থাকে’ (সহিহ বুখারি)।
রসুলুল্লাহ (সা.) কখনো যুদ্ধ কামনা করেননি। বরং যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি ইরশাদ করেন, ‘তোমরা শত্রুর সঙ্গে সাক্ষাৎ কামনা করো না। বরং আল্লাহর কাছে নিরাপত্তা কামনা করো। আর যদি সাক্ষাৎ অনিবার্য হয়, তবে ধৈর্য ধরো’ (সহিহ মুসলিম)। শত্রুপক্ষ যদি শান্তির প্রস্তাব দেয় অথবা শান্তি চুক্তিতে সম্মত হয়, তবে মুসলমানদের তা গ্রহণ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন, ‘তারা যদি শান্তির প্রতি ঝোঁকে, তবে তুমিও তার প্রতি ঝুঁকে পড়ো এবং আল্লাহর ওপর ভরসা করো’ (সুরা আল আনফাল-৬১)। রসুলুল্লাহ (সা.) ওমরাহ হজ পালন করার উদ্দেশে ১৪০০ সাহাবি সঙ্গে নিয়ে পবিত্র মক্কার উদ্দেশে যাত্রা করেন। হোদায়বিয়া নামক স্থানে পৌঁছার পর মক্কাবাসীরা রসুল (সা.)-কে মক্কায় প্রবেশে বাধা দেয়। রসুলুল্লাহ (সা.) তাদের বোঝানোর জন্য হজরত ওসমান (রা.)-কে মক্কায় প্রেরণ করেন, ‘আমি যুদ্ধ করার জন্য আসি নাই, আমি শুধু ওমরাহ হজ পালন করার জন্য এসেছি। আমি ওমরাহ পালন করে চলে যাব।’ কিন্তু তারা সেই সুযোগ দেয়নি। মহানবী (সা.) যুদ্ধ পরিহার করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় সম্মত হন। পৃথিবীর বুকে শান্তির পতাকা উড়বে, সবাই উদারতার পরিচয় দেবে, এটাই ইসলামের শিক্ষা। রসুল (সা.)-এর আদর্শ। মানুষ যেদিন এ আদর্শ অনুসরণ করবে সেদিন পৃথিবী তার কাক্সিক্ষত শান্তি সলিলে জেগে উঠবে। আর মানুষ ফিরে পাবে তাদের হারানো মানবতা।
♦ লেখক : গবেষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বসুন্ধরা, ঢাকা