নদীয়া নগর ও বঙ্গরাজ্য বিজেতা মুহাম্মদ বখতিয়ার আলখলজি ঘোর ও গরমসির রাজ্যের খলজি সম্প্রদায়ের লোক ছিলেন। তবকাত নাসিরি গ্রন্থের ভাষায় তিনি একজন কর্মঠ, দ্রুত গতিসম্পন্ন, সাহসী, দুঃসাহসী, বিজ্ঞ ও দক্ষ ব্যক্তি ছিলেন। তার ওইসব গুণপনা তাকে অল্প সময়ে খ্যাতির শিখরে নিয়ে যায়। তবে তার শেষজীবন সুখের ছিল না। তিনি যত তড়িৎগতিতে সাফল্য লাভ করেন, তত দ্রুতগতিতে তার পতন হয়। নদীয়া বিজয়ের মাত্র দুই বছরের মধ্যে তিনি নায়ক থেকে খলনায়কে পরিণত হন। তার ক্ষিপ্রতা ও তড়িৎগতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ যেমন তার জয়ের অন্যতম কারণ ছিল, তেমনি তার উপযুক্ত গুণপনাই তাকে পতনের দিকে নিয়ে যায়। কিন্তু বঙ্গ বিজয়ের আগে যে গুণপনা তার সাফল্যের কারণ ছিল তা হঠাৎ করে কেন তাকে ব্যর্থতার দিকে নিয়ে গেল; ওই কারণ অনুসন্ধান করলে বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনি সামনে আসে। তার উপযুক্ত সব গুণপনা থাকা সত্ত্বেও তিনি বিশ্বাসঘাতকতার কাছে হেরে যান। তার শক্তিশালী সামরিক বাহিনী ধ্বংস হয়ে যায়। তিনি জনপ্রিয় শাসক থেকে ঘৃণিত-পতিত ব্যক্তিতে পরিণত হন।
বাংলা অঞ্চল ছিল বিশ্বাসঘাতকদের স্বর্গভূমি। মহারাজা লক্ষণ সেন নিজেও বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হন। তার দুর্নীতিপরায়ণ সভাসদদের ষড়যন্ত্রে বখতিয়ার খলজির কাছে তিনি পরাজিত হন। ফলে বখতিয়ার খলজির পক্ষে সহজে তার রাজ্যের অধিকাংশ এলাকা দখল করা সম্ভব হয়। নদীয়া অধিকারের পর বখতিয়ার খলজি বঙ্গ ও সকনত রাজ্যের জমি তার অধিকারে নেন। ওই রাজ্যদ্বয় তার শাসনভুক্ত করে তিনি নদীয়া নগর ধ্বংস ও লখনৌতিতে রাজধানী স্থাপন করেন। ১২০৫ সালে বখতিয়ার খলজি লখনৌতি অধিকার করে রাজধানী স্থাপন করার পর লখনৌতি থেকে তিব্বতে সামরিক অভিযানে যান। ওই অভিযানের পুরো ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, তিনি বিশ্বাসঘাতকতায় পড়ে সর্বস্বান্ত হন। মাত্র শতাধিক সৈন্য নিয়ে কোনোমতে বেঁচে লখনৌতিতে ফেরেন। তিব্বত অভিযানের সময় তিনি যে ১০ হাজার অশ্বারোহী সৈন্যের বহর তৈরি করেছিলেন তা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে একদা খ্যাতিমান সেনাপতি হলেও বখতিয়ার খলজি শেষজীবনে ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দারে পরিণত হন।
তিনি কামরূপ হয়ে তিব্বত অভিযানে যান। ওই সময়ের পাল বংশের শাসক বিদ্যাদেবের বংশধর রাজা পৃথু কামরূপ শাসন করছিলেন। রাজা পৃথু বখতিয়ার খলজির তিব্বত অভিযানের খবর পেয়ে তার কাছে দূত প্রেরণ করেন। ওই দূত বখতিয়ার খলজিকে কামরূপের রাজা পৃথুর বার্তা পৌঁছে দেন। ওই বার্তায় কামরূপের রাজা পৃথু বখতিয়ার খলজিকে ওই বছর তিব্বত অভিযানে না যাওয়ার অনুরোধ করেন। যদি এ বছর তিব্বত অভিযানে না গিয়ে আগামী বছর যান তবে তিনি বখতিয়ার খলজির সঙ্গে ওই অভিযানে যাবেন; বখতিয়ার খলজি কামরূপের রাজা ওই অনুরোধ আমলে না নিয়ে তার সহচর আলী মেচের সহায়তায় তিব্বত অভিযানে যান। ফলে কামরূপের রাজা রুষ্ট হন। তবে তিনি বাইরে তা প্রকাশ করেননি। তিনি প্রকাশ্যে বখতিয়ার খলজির প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব বজায় রাখেন। কামরূপের রাজা পৃথুর ওই দুমুখো নীতি বখতিয়ার খলজিকে ফাঁদে ফেলে। তিনি কামরূপের রাজার বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাবে আস্থা রাখায় তার পতন হয়। ব্যর্থ তিব্বত অভিযান শেষে তিনি যখন কামরূপ হয়ে লখনৌতিতে ফিরছিলেন তখন কামরূপে তার পুরো সেনাবাহিনী ধ্বংস হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে কামরূপের রাজার বিশ্বাসঘাতকতার সঙ্গে তার একজন তুর্কি আমির ও একজন খলজি আমিরের বিশ্বাসঘাতকতারও দায় ছিল। কামরূপের গোহাটিতে অবস্থিত প্রাচীন সিলহাকো সেতু সামরিক দিক দিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেনাপতি বখতিয়ার খলজি ওই সেতুর সামরিক গুরুত্ব উপলব্ধি করে তার একজন তুর্কি ও একজন খলজি আমিরকে পাহারায় নিযুক্ত করেন। বখতিয়ার খলজি কামরূপ ছেড়ে তিব্বতের পথে রওনা হওয়ার পর ওই দুজন আমির নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে ওই সেতুর পাহারা ছেড়ে চলে যান। ওই সুযোগে কামরূপের রাজা পৃথুর সৈন্যরা ওই সেতুটি ধ্বংস করে। সিলহাকো সেতুর সর্বশেষ পরিস্থিতি বখতিয়ার খলজির জানা ছিল না। রাজা পৃথুর কাছে কামরূপে আকস্মিক পরাজয়ে বখতিয়ার খলজি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। তার মানসিক অবস্থা এতটা খারাপ হয় যে তিনি রোগাক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হন। তার দুঃসাহসী ও দুর্ধর্ষ আমির আলী মর্দান বখতিয়ার খলজির অসুস্থতার খবর শুনে ছুটে আসেন। বখতিয়ার খলজি আলী মর্দানকে নারকোটি অঞ্চলের জায়গিরদার নিযুক্ত করেছিলেন। বখতিয়ার খলজির তখনো দু-চারজন যে শুভাকাক্সক্ষী ছিলেন তারা আলী মর্দানের ওই ছুটে আসাকে তার নিয়োগকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতার প্রকাশ হিসেবে দেখেছিলেন। কিন্তু আলী মর্দানের মনে ভিন্ন বাসনা ছিল। তিনি বখতিয়ার খলজির অসুস্থতার সুযোগে তার কাছে গিয়ে তার মুখের চাদর সরিয়ে প্রথমে নিশ্চিত হন তিনি বখতিয়ার খলজি কি না, তারপর আকস্মিক ছুরিকাঘাতে তাকে হত্যা করেন। বখতিয়ার খলজির আলী মর্দানকে জায়গিরদার নিযুক্তির প্রতিদান দেন তাকে হত্যা করে।
♦ লেখক : সহকারী অধ্যাপক ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়