সিনেমা হলে দর্শক ফেরাতে প্রথমেই দরকার মানসম্মত ও সৃজনশীল চলচ্চিত্র। হালকা বিনোদনে ভরপুর বাণিজ্যিক সিনেমা মুক্তি পেলেও তা এখন আর হল ভরাতে পারে না। একসময় রুচিসম্মত পারিবারিক সিনেমা মুক্তি পেত, যা দেখতে দর্শক পরিবার নিয়ে হলে আসত। বাজে চিত্রায়ণ, খারাপ অভিনয়, উৎকট নাচ ও গানসমৃদ্ধ আইটেম গান প্রভৃতিই যেন এখন একটি বাণিজ্যিক সিনেমার প্রধান অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তাই নিজে বা পরিবার অথবা বন্ধুবান্ধব নিয়ে সিনেমা হলে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে রুচিশীল দর্শক। এ ছাড়া বেশ কয়েকবছর ধরে সিনেমার স্ক্রিপ্টের ক্ষেত্রে রয়েছে সৃজনশীলতার অভাব। ভালো গল্প বলিয়েদের সংখ্যা কমতে কমতে এখন যেন তা তলানিতে। স্ক্রিপ্ট লেখকদের প্রযোজকরা ধরিয়ে দেন তামিল-তেলেগু সিনেমার কিছু দৃশ্য, বলাই হয় সেগুলো থেকে নকল করে স্ক্রিপ্ট বানাতে হবে। স্ক্রিপ্ট লেখকরাও জীবিকার তাগিদে এসব দিয়েই তৈরি করেন জগাখিচুড়ি টাইপের সিনেমা। যার না থাকে কোনো শুরু, না থাকে কোনো শেষ। দর্শক মাঝে মাঝে বুঝতেই পারেন না, তারা কী দেখছেন? কেন দেখছেন? নতুন করে নতুন কিছু যেন বলার নেই। এ গণ্ডি থেকে বের হতে হবে। আমাদের গল্প আমাদেরই বলতে হবে। অন্যের কিছু অনুকরণ করে হয়তো ক্ষণিকের জন্য চমক দেওয়া যায়।
তবে তা থেকে স্থায়ী প্রাপ্তির খাতার যোগফল শূন্যই রয়ে যায়। চলচ্চিত্রের কাহিনি যত জীবন ঘনিষ্ঠ হবে তা তত বেশি দর্শক টানবে। হচ্ছে উল্টো, এখন ঢাকাই বাংলা সিনেমা বাস্তবতা বিবর্জিত, অদ্ভুত এক ফ্যান্টাসির রাজ্যে বিচরণ করছে। শিল্পীর পোশাক বা লোকেশন দেখে বোঝার উপায় নেই সে কোন জনগোষ্ঠীর বা কোন সমাজ-সংস্কৃতির। জগাখিচুড়িতে এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক। পর্যাপ্ত ও মানসম্মত ছবির অভাবে নব্বই দশকের মধ্যভাগ থেকেই সিনেমা হল বন্ধ শুরু হয়েছে। সেই বন্ধের ধারা এখনো অব্যাহত। একই সঙ্গে সব সিনেমা হল আধুনিকায়ন না হওয়ায় সেখানে যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না দর্শক। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত দেশে থাকা ১ হাজার ৪৩৫টি সিনেমা হলের স্থলে এখন আছে ৫০টির মতো। এসব কারণে চরম লোকসানে আছেন সিনেমা হল মালিকরা। এ অবস্থার উত্তরণ কীভাবে সম্ভব? সে কথাই বলেছেন সিনেমা হল মালিকরা।
সিনেমা হল আধুনিক সুযোগসুবিধায় গড়ে তুলতে হবে
কাজী শোয়েব রশীদ, [সাবেক সভাপতি, চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি]
সিনেমা হল টিকিয়ে রাখতে হলে সিনেমা হলের কাঠামো বদলে ফেলতে হবে। আধুনিক সুযোগসুবিধায় গড়ে তুলতে হবে। অন্যদিকে পর্যাপ্তসংখ্যক ও মানসম্মত ছবি নেই এ কারণে দর্শক সিনেমা হলবিমুখ। ফলে লোকসানের কবলে পড়ে আমাদের নাকাল হতে হচ্ছে প্রায় এক দশক ধরে। এভাবে লোকসান গুনে কি সিনেমা হল টিকিয়ে রাখা সম্ভব? বিশাল জায়গায় প্রায় হাজার আসনের সিনেমা হল রাখার আর কোনো অর্থ নেই। এখন যা করতে হবে তা হলো, সিনেমা হলগুলো ভেঙে সেখানে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করতে হবে। সেই বাণিজ্যিক ভবনে থাকবে ২০০ থেকে ৩০০ আসনের একাধিক সিনেমা হল। কিন্তু সিনেপ্লেক্স নয়, কারণ সিনেপ্লেক্সে ব্যয় বেশি, টিকিটের দামও বেশি। তাই মালিকপক্ষ এবং দর্শক দুইয়ের জন্যই তা অনুকূল হবে না। শহর ও মফস্বলের সাধারণ দর্শক উচ্চমূল্যে টিকিট কিনে ছবি দেখতে পারবে না। সাধারণ দর্শক সিনেপ্লেক্সের বেশি দামের টিকিটে ছবি দেখবে না। সিনেমা হল ও সিনেপ্লেক্সের দর্শক আলাদা। সিনেপ্লেক্সে একশ্রেণির দর্শক সময় কাটাতে যায়। গ্রামগঞ্জে এখন যাত্রাপালা, মঞ্চনাটক, জারি, সারি গানের আসর, সার্কাস, পুতুলনাচ বলতে কিছু নেই। তাদের যদি সিনেমার মাধ্যমে বিনোদন দেওয়া না যায় তাহলে তো তারা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়বে।
পর্যাপ্ত মানসম্মত ছবি চাই
মিয়া আলাউদ্দীন, [কর্মকর্তা, চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি]
সিনেমা হল বাঁচাতে আগে ছবির অভাব পূরণ করতে হবে। আর ছবি হতে হবে মানসম্মত এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ। এ ছাড়া সহজ শর্তে নির্দিষ্ট পরিমাণে বিদেশি ছবি আমদানি করতে দিতে হবে। যৌথ প্রযোজনার নীতিমালা আবার সবার চাহিদা অনুযায়ী প্রণয়ন করতে হবে। সিনেমা হল সংস্কারে শর্তহীন ঋণ দিতে হবে। সিনেমা হলের বিদ্যুৎ বিল বাণিজ্যিক নয়, শিল্পনীতির আওতায় নিতে হবে। সিনেমা হলে প্রজেক্টর স্থাপন, সংস্কার ও সরকারের উদ্যোগে দেশের ৬৪টি জেলায় সিনেপ্লেক্স নির্মাণ করতে হবে।
উপমহাদেশীয় ছবি দরকার
ইফতেখার নওশাদ, [কর্ণধার, মধুমিতা সিনেমা]
পর্যাপ্ত পরিমাণে মানসম্মত দেশি ছবির ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে উপমহাদেশীয় ছবিও আমদানি করতে সরকারের অনুমতি দরকার। তাছাড়া সিনেমা হল সময়োপযোগী করে সাজাতে হবে। দরকার সিনেমা হল আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর করে গড়ে তোলা। একই সঙ্গে থাকবে ফুডকোর্ট ও বাচ্চাদের খেলার স্থান। এভাবে পর্যাপ্ত ছবি ও সিনেমা হলের আধুনিকায়নের মাধ্যমে দর্শক ফিরিয়ে আনতে পারলে হল বাঁচবে।