‘ওয়ামাল হায়াতুদ দুনিয়া ইল্লা লায়িবুও ওয়ালহবুন। অর্থ, দুনিয়ার জীবন খেল তামাশা এবং প্রতারণা ছাড়া কিছুই নয়।’ (সুরা হাদিদ, ২০) আয়াতে দুনিয়ার জীবনকে ‘মাতাউল গুরুর- মিথ্যা ভোগবিলাস ছাড়া কিছুই নয়’ বলা হয়েছে। আফসোস! ক্ষণস্থায়ী জীবনের ক্ষণস্থায়ী সুখের জন্য কী পাগলের মতোই না ঘুরে বেড়াচ্ছে মানুষ। দিন নেই, রাত নেই, সকাল নেই, দুপুর নেই চলছে মানুষের নিরন্তর ছুটে চলা। চলতে চলতে একটা সময় মানুষ হঠাৎ করে নিজেকে আবিষ্কার করে অন্য এক মানুষরূপে। শৈশবের হাসি খুশি মানুষটি আজ যৌবন হারিয়ে বার্ধক্যে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু শৈশবের সেই নির্মল-শুদ্ধ আত্মাটি আজ আর নেই। পাপের ধুলোয় শুদ্ধ আত্মা আজ বড় বেশি কদাকার হয়ে গেছে। আত্মা এত বেশি কালো হয়ে গেছে যে পৃথিবী ক্ষণস্থায়ী; এই কথাটিও আজ আর তার মন বিশ্বাস করতে চায় না। এমন সময় হঠাৎ একদিন ঘোর ব্যস্ততার মাঝেই তার সামনে এসে হাজির হয় মালাকুল মউত  হজরত আজরাইল (আ.)। মৃত্যুর ফেরেশতা তাকে বলে, ‘হে আল্লাহর বান্দা! প্রস্তুত হয়ে যাও, তোমার সময় এসে গেছে।’ মহাব্যস্ত আল্লাহর বান্দা তখন বলবে, ‘কে আপনি? কীসের সময় হয়েছে?’ মৃত্যুর ফেরেশতা বলবে, ‘আল্লাহর বান্দা! তুমি কি তোমার প্রকৃত ঠিকানা ভুলে গেছ? ভুলে গেছ মৃত্যু নামক বাহনের কথা?’
ফেরেশতার মুখে মৃত্যুর কথা শুনে এবার টনক নড়বে তার। মনে পড়বে, বহুবার সে মৃত্যু নামক শব্দটি শুনতে শুনতে জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে দাঁড়িয়েছে। তার বাবা, মা, ভাই, বোন কত প্রিয়জনকে সে মাটির নিচে চাপা দিয়ে এসেছে! এবার সে বুঝতে পারবে তারও সময় এসে গেছে। যখনই সে বুঝতে পারবে তাকে মরতে হবে, সঙ্গে সঙ্গে ভিতর জগতে একধরনের ভয়ংকর ঝড় তার আপাদমস্তক কাঁপিয়ে তুলবে। হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী (রহ.) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ দাকায়েকুল আখবার লিখেছেন, ‘মৃত্যুর ফেরেশতা যখন বান্দাকে প্রস্তুত হওয়ার কথা বলবে, বান্দা তখন আজরাইলকে দেখে ভয়ে বিহ্বল হয়ে পড়বে। মূলত আজরাইল ফেরেশতার বিকট আকৃতিই তার ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াবে কিন্তু তার চেয়েও বড় ভয় অপেক্ষা করছে মৃত্যু পথযাত্রীর জন্য।’ ইমাম গাজ্জালী বলেন, ‘মৃত্যু পথযাত্রীর সামনে স্বয়ং মৃত্যু এসে বীভৎস আকৃতি নিয়ে দাঁড়াবে।’ মৃত্যুর আকৃতি সম্পর্কে দার্শনিক গাজ্জালী লিখেন, ‘আল্লাহপাক মৃত্যুকে সৃষ্টি করে সত্তর হাজার শিকল দিয়ে তাকে বেঁধে রেখেছেন। মৃত্যুর পাখা ছিল সত্তর হাজার। এক পাখা থেকে আরেক পাখার দূরত্ব সত্তর হাজার মাইল। এত বিশাল বস্তুটির পাশ দিয়ে যখন ফেরেশতারা যেত তখন তারা হতভম্ব হয়ে ভাবত- জিনিসটা কী?’
যখন আদম (আ.)কে সৃষ্টি করা হলো এবং হজরত আজরাইলের (আ.) কাঁধে প্রাণিকুলের মৃত্যুর দায়িত্ব পড়ে, তখন আজরাইল (আ.) বললেন, ‘হে আল্লাহ! মৃত্যু জিনিসটা কী?’ আল্লাহপাক মৃত্যুকে ডেকে বললেন, ‘হে মৃত্যু! আমি তোমার শিকলগুলো খুলে দিলাম। এবার তুমি তোমার পাখা নিয়ে উড়তে থাক।’ সেদিন জিবরাইল, ইসরাফিল, মিকাইলের মতো ফেরেশতাদের পর্যন্ত মৃত্যুর কাছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মনে হলো। অনেক সময় ওড়ার পর যখন মৃত্যু থামল, তখন দেখা গেল সব ফেরেশতা অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়েছে। গাজ্জালী লিখেন, ‘প্রায় দুই হাজার বছর এভাবেই তারা অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল।’ হজরত জিবরাইল ফেরেশতা প্রথম মাথা তুলে বললেন, ‘হে আল্লাহ! আর কিছু কি এত মহান তোমার সৃষ্টিতে আছে?’ আল্লাহপাক বললেন, ‘তোমাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালা সবকিছুর চেয়ে বড় এবং মহান।’
এমন বিকট আকৃতির মৃত্যু যখন মানুষের সামনে এসে দাঁড়াবে, মানুষের আত্মা তখন ভয়ে এখানে-ওখানে পালানোর চেষ্টা করবে। তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে ফেরেশতারা বলবে, ফা আইনা তাজ হাবুন, আজ কোথায় পালাবে তুমি? পৃথিবীতে তুমি ছিলে সবচেয়ে ক্ষমতাধর, সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষ। তোমার ভয়ে মানুষ থরথর করে কাঁপত। তুমি মানুষকে মানুষ বলে ভাবতে না। দুর্নীতির কাঁড়ি কাঁড়ি টাকায় তুমি গাড়িবাড়ি সবই করেছ। আজ তোমার টাকাপয়সা বাড়িগাড়ি কোনো কিছুই তোমাকে মৃত্যু থেকে বাঁচাতে পারবে না। আজ তুমি কোথাও পালাতে পারবে না। এমন সময় বিরাট আকৃতির মৃত্যু মুমূর্ষুকে উদ্দেশ করে বলবে, হে আল্লাহর বান্দা! আমাকে দেখো, আমি সেই মৃত্যু! যার স্বাদ সবাইকেই গ্রহণ করতে হবে। আমি সেই মৃত্যু! যে তোমার থেকে তোমার বাবা-মাকে কেড়ে নিয়েছি। এখন আবার তোমার সন্তানদের থেকে তোমাকে কেড়ে নেব। আমি সেই মৃত্যু! যে কোটিপতি-ফকির দুজনের সঙ্গে সমান আচরণ করি। আমি সেই মৃত্যু! যে রাষ্ট্রপ্রধান আর রাষ্ট্রদ্রোহী সবার সঙ্গে সমান আচরণ করি। আমি সবাইকে মৃত্যুর যন্ত্রণাদায়ক স্বাদ আস্বাদন করাই।
লেখক : প্রিন্সিপাল, সেইফ এডুকেশন ইনস্টিটিউট