‘সকল কাঁটা ধন্য করে ফুটব মোরা ফুটবে গো’ বলে কবি যে কারণেই আশাবাদ করে থাকুন না কেন একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের আজকের বাস্তবতায় এ কথা সমভাবে প্রযোজ্য। নির্বাচনি রোডম্যাপের কণ্টকাকীর্ণ পথকে কুসুমাস্তীর্ণ করতেই এ আশাবাদ। দেশের সামগ্রিক যে অবস্থা- পণ্যমূল্য আইনশৃঙ্খলা, ধর্ষণ-হত্যার ঘটনা। গার্মেন্টে আগুনে সর্বস্বান্ত হওয়ার যে চিত্র প্রতিদিন আসছে তাতে সাধারণের মনে আশার আলো দেখার ভাবনা ছাড়া আর কিছু করার অছে বলে মনে হয় না। নির্বাচনি রোডম্যাপ অনুযায়ী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শেষের পর্যায়ে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এদিকে নির্বাচনি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সক্ষমতা পুলিশের রয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক। তিনি বলেছেন, অতীতে নির্বাচন কেন্দ্র করে পুলিশ সম্পর্কে জনমনে যে নেতিবাচক ইমেজ তৈরি হয়েছে তা থেকে বেরিয়ে আসার একটা বড় সুযোগ আগামী নির্বাচন। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে জনগণের আস্থা অর্জনে সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে। তিনি এ কথা বলছেন ঠিক এমন সময় যখন সরকারের একজন উপদেষ্টা মন্তব্য করেছেন সবাই সংঘাতের জন্য মুখিয়ে আছে, অল্প কয়েক মাসের মধ্যে দেখতে পাবেন। ইতোমধ্যে উপদেষ্টা পরিষদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন করছেন রাজনৈতিক নেতারা। রাজনৈতিক নেতাদের বিবেচনায় অভিযুক্তদের সংখ্যা আট। তারা সরাসরি উপদেষ্টাদের নাম নিয়ে তাদের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। বলা যায় বিএনপি, জামায়াত এবং এনসিপি তিন দলই মোটামুটি এ ব্যাপারে তাদের যে দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছে তাতে বোঝা যাচ্ছে নির্বাচন যখন ঘনিয়ে আসছে তখন অনেক অজানা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে। এ ছাড়াও নির্বাচনি দায়িত্ব পালনকারীদের নিয়ে বিএনপি ইসলামী ব্যাংকসহ কয়েক জায়গায় কর্মরতদের নিয়ে আপত্তি তুলেছে। জামায়াত একে অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে করেছে। কথা আরও রয়েছে, নির্বাচনকালীন সরকারের দায়িত্ব মূলত পালন করার কথা নির্বাচন কমিশনের। বিএনপি বর্তমান নির্দলীয় সরকারের পরিবর্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়েছে। সে কারণেই জটিল সমীকরণ প্রসঙ্গ।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচন সামনে রেখে বদলে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক মুডে আসার তাগিদ দিয়েছেন। কয়েকজন দলঘনিষ্ঠ উপদেষ্টাকে বাদ এবং প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে দলীয়করণমুক্ত করার কথা বলেছেন। এনসিপি নেতারা জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপিমনা উপদেষ্টা ও প্রশাসকদের বাদ দিতে আহ্বান জানিয়েছেন। এনসিপি কোনো উপদেষ্টাকে বাদ দেওয়ার কথা না বলে তারা বলেছে প্রশাসন বিএনপি ও জামায়াত ভাগাভাগি করে নিয়েছে। তারা মনে করে, গণভোট করার আগে তত্ত্বাবধায়ক অর্থাৎ নির্বাচনকালীন সরকার করা যাবে না। এসব কথা মূলত দেশের রাজনীতির মাঠে যা চাউর আছে তারই প্রতিধ্বনি। এরই মধ্যে অনিষ্পত্তিকৃত জুলাই ঘোষণা হস্তান্তর করা হয়েছে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না আগামী সরকার কারা গঠন করবে তা নিয়ে বেশ টানাপোড়েন রয়েছে। ছাত্র সংসদগুলোতে ছাত্রশিবিরের জয়ের পর জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে অনেকটা আশার সঞ্চার হয়েছে। তারা মনে করছে আগামী নির্বাচন তাদের অনুকূলে যাবে। এ আশা হয়তো অমূলক নয়। যদি তারা ব্যাপারটিতে নিশ্চিত হতে পারত তাহলে হয়তো একদিকের জটিলতা কেটে যেত। আসলে তারা এত নিশ্চিত নয়। না হওয়ার অনেকগুলো কারণের মধ্যে রয়েছে দেশের আবহ। একটি গণতান্ত্রিক বাস্তবতায় ভোট হলে সেখানে আসলে কী দাঁড়াবে সে বিষয় নিয়ে স্থির কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন। ভোট ভোটারের হাতে। তারা কাকে দেবে এ নিয়ে ধারণা করা যায় তবে সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন। যেসব জরিপ নিয়ে কাজ হচ্ছে, কথা হচ্ছে আসলে এসবের ওপর নির্ভর করা অবাস্তব। উদাহরণ হিসেবে ভারতের ভোট ফেরত জরিপের কথা বলা যেতে পারে। সেখানকার মিডিয়াগুলোতে ভোট ফেরত জরিপে যাদের জয়ের কথা বলা হয়েছিল ফলাফল উল্টে গেছে। কথা হচ্ছে যারা মতামত দিয়েছে তারা আসল কথা বলেনি। কেন বলেনি তার অনেক ব্যাখ্যা রয়েছে। মূল কথা হচ্ছে ভয়ে বলেনি অথবা প্রলোভনে বলেছে। তারা নিজেদের প্রকাশ করতে চায়নি। আসলে অন্যভাবে দেখলে বলা যায় এ ধরনের জরিপ একধরনের স্বাধীনতা হরণ, ম্যানুপুলেশনের পর্যায়ে পড়ে। এটা ভোটারের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বলেও বিবেচিত হতে পারে। কেন নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ তার পুরো ব্যাখ্যা হয়তো নেই। তবে এ কথা ঠিক যে ভোটারের মতামত চাওয়ার পেছনে কোনো যুক্তি নেই। সে যা-ই হোক, কোনো কোনো মহল মনে করছে পরিস্থিতি যদি ঝুলে যায় তাহলে আখেরে সেটি জামায়াতের পক্ষে যাবে। সে কারণে তারা নির্বাচনের ঘোষণা এবং আন্দোলনের মাঠে দুই জায়গাতেই রয়েছে। পিআর সংশোধন করে বলা হয়েছে, জোট হলেও নির্বাচন করতে হবে যার যার প্রতীকে। বিএনপি এর প্রতিবাদ করেছে। জামায়াত এটি সমর্থন করেছে। জোট থাকবে অথচ জোটের প্রতীক ব্যবহার করা যাবে না বিষয়টির অন্তর্নিহিত কিছু ‘যদি’ ও ‘কিন্তু’ রয়েছে। যদিও ব্যাপারটি সবার বেলায় প্রযোজ্য, তবু প্রশ্ন থাকে কেন? এই কেনর উত্তর হয়তো পাওয়া যাবে না। এনসিপি বলেছিল, তারা শাপলা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবে। নির্বাচন কমিশন বলেছে শাপলা দেওয়া যাবে না। শাপলার বদলে তাদের শাপলার কলি দেওয়া হয়েছে প্রতীক হিসেবে। তারা তা মেনেও নিয়েছে। এনসিপি দল হিসেবে কত বড় আজকের বাস্তবতায় সে প্রশ্ন বড় নয়। কারণ এনসিপি হচ্ছে, আগস্ট বিপ্লবের সমন্বয়কারকদের দল। তাদের করা বিপ্লবে যারা নির্বাচন করবে সে নির্বাচনে তাদের কথা শোনা হবে না সেটি হবে সত্যি দুর্ভাগ্যজনক। এনসিপি নেতারা মুখে সব কথা না বললেও তাদের অনেক ক্ষোভ রয়েছে। এ নিয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে অলোচনাতেও শোনা যায়। তারা যদি নির্বাচনে না যায় অথবা তাদের বাদ দিয়ে যদি নির্বাচন হয় সেটি হতো আরও এক কেলেঙ্কারি। এনসিপিকে বাদ দিয়ে যারা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছেন তাদের কারও কারও ব্যাপারে তাদের পক্ষ থেকে যে ক্ষোভ ও বেদনার কথা বলা হয়েছে তা বিবেচনায় নিয়ে বলতে হবে বিষয়টির সুরাহা অতীব জরুরি।
ঘোষিত নির্বাচনের অগে নির্দলীয় বনাম তত্ত্বাবধায়কের যে ইস্যু উঠেছে তাকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ কম। মানুষের মধ্যে নির্দলীয় বলে কোনো কথা নেই। কারণ সে যখন ভোট দেবে সে কোনো না কোনো দলের প্রার্থীকে ভোট দেবে। এই সমর্থনের নামই দলের প্রতি সমর্থন। ১৫ বছরের ফ্যাসিস্ট বিদায় হওয়ার পর প্রয়োজন ছিল জাতীয় সরকার গঠনের। আসলে যদি সে সময়ে একটি জাতীয় সরকার গঠন করা হতো বা যেত তারা তিন মাস ছয় মাসের মধ্যে একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে দিলে আজকে যেসব প্রশ্নের জন্ম হয়েছে তা নাও হতে পারত। মূল বিষয় ছিল, একটি স্বচ্ছ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। তার সঙ্গে যুক্ত হতে পারত বিগত সময়ে যারা ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছেন তাদের জন্য সুনির্দিষ্ট করণীয় নির্ধারণ। বলা যায়, ফ্যাসিবাদের উন্মেষ নিষিদ্ধকরণে শহীদ ও তাদের পরিবারের প্রতি করণীয় এবং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আধিপত্যবাদের প্রতিরোধে করণীয় নির্ধারণ করে দ্রুততম সময়ে একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা। শুনতে খারাপ লাগলেও এটা সত্য নির্বাচন হচ্ছে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সরকার পরিবর্তনের সবচেয়ে সহজ পথ। এই সহজ পথ প্রক্রিয়াকে যারা জটিল ও কুটিল পথে নিয়ে গিয়েছিল তারাই হলো ফ্যাসিবাদ। আজ প্রায় ১৫ মাস হয়ে যাচ্ছে দেশে নির্বাচন হতে পারেনি। এই না পারার দায়িত্ব কার? সে আলোচনায় না গিয়েই বলি মানব দেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হচ্ছে মস্তিষ্ক। কারও হাত না থাকলে দেখা যায় কারও পা না থাকলে দেখা যায়। কারও চোখ না থাকলে তাকে অন্ধ বলা হয়। আসলে কারও মাথায় গন্ডগোল থাকলে সেটি প্রকাশিত ও প্রমাণিত হয় আচরণে। তেমনিভাবে মাথা যদি ঠিক থাকে তাহলে অন্য কোনো অঙ্গে সমস্যা থাকলেও তা চালিয়ে নেওয়া যায়। যখন নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে তখন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা সেই সঙ্গে আরও কিছু বিষয় যেভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে তাকে নির্বাচনি রোডম্যাপের সঙ্গে মেলালে সংগত কিছু বিবেচনা উঠে আসে। নানা অসন্তোষের দাবাগ্নি রয়েছে বিদ্যমান বাস্তবতায়। এসবের সমাধান করার সময় এখন সরকারের হাতে নেই। এখন বিবেচ্য হচ্ছে নির্বাচন। গোটা জাতি মুখিয়ে রয়েছে একটি সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য। যেসব অলোচনা ইতোমধ্যে হয়েছে হচ্ছে তার ইতিবাচকতার অনেক বিষয় রয়েছে। বিষয় হচ্ছে, মানা না মানার অনেক আলোচনা রয়েছে। কোনটি কার পক্ষে কোনটি কার বিপক্ষে সে আলোচনা অনেক দীর্ঘ। নির্বাচনের প্রধান অংশী দলের মধ্যে যারা রয়েছে তাদের মধ্যে নির্বাচনকেন্দ্রিক ঐক্য কীভাবে অটুট করা যায় সেদিকটিতে নজর দেওয়ার দায়িত্ব মূলত বর্তমান নির্দলীয় সরকারের। ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে, এখনো আস্থার সংকটই সরকার কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সেটি যদি হয় তাহলে সে জায়গায় কাজ করা জরুরি। সে কারণেই বলছি জনগণ বড় আশায় বসে আছে নির্বাচন হবে আর তাদের সমস্যার সমাধান ঘরে আসবে। তাদের আশাকে রূপায়ণের দিকে নিয়ে যাওয়া বা যেতে পারাটাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট