মন খারাপের দেশে হঠাৎ করেই শুরু হয়েছে উত্তেজনা। উত্তেজনা বললে ভুল হবে। এটা টানটান উত্তেজনা, প্রবল উত্তেজনা, সীমাহীন উত্তেজনা ইত্যাদি অনেক বিশেষণ যুক্ত করলে যা হয় তেমনি একটি অবস্থা এখন বাংলাদেশে বিরাজ করছে। পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালে বাংলাদেশের মতো একটি অভ্যুত্থান হয়ে গেল। নেপালি প্রধানমন্ত্রী অলি হেলিকপ্টারে করে পালালেন। আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারা হলো। অর্থমন্ত্রীকে রাস্তায় ফেলে উদম করে বেদম প্রহার। নির্বিচার ব্যাংক ডাকাতি, দেশজুড়ে সরকারি-বেসরকারি ভবনে আগুনের যে লেলিহান শিখা নেপালকে গ্রাস করেছে তার উত্তাপ বাংলাদেশেও চলে এসেছে।
আমরা সবাই কমবেশি জানি যে বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা-ভুটান-মালদ্বীপ ও নেপাল নিয়ে গত দুই দশক ধরে চীন ও ভারত পরস্পর রশি টানাটানি করছে। আমেরিকা তাদের সুবিধামতো দাবার চাল দিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমারের অবস্থা উল্লিখিত পাঁচটি দেশের চেয়ে ভয়াবহ। সেখানে মার্কিন মদতে যুদ্ধ চলছে। চীন ভারত সব পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে নিজেদের ক্ষয়ক্ষতি সামাল দিতে পারলেও বাংলাদেশ পারছে না। প্রায় ১৫ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী, সীমান্তে আরাকান আর্মি এবং আমাদের দেশের মধ্য দিয়ে আরাকান আর্মির জন্য করিডর দেওয়ার বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল চাপের কারণে সরকার দেশ-জাতি এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে প্রবল উত্তেজনা চলছে।
উল্লিখিত অবস্থার মধ্যে ডাকসু নির্বাচন হয়ে গেল যা দেশের চলমান রাজনীতির সব হিসাবপত্র উল্টে দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জামায়াত-শিবিরের ঐতিহাসিক বিজয় স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনা। ১৯৭১ সাল থেকে জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে যে ধারাবাহিক প্রচার-প্রপাগান্ডা চালানো হচ্ছে এবং মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে যেসব ইতিহাস রচিত হয়েছে তার সবচেয়ে উর্বর ভূমি হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-উন্মেষ এবং সূচনা এই বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকেই হয়েছে। আবার মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির ভয় ও আতঙ্কের আঁধার হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে প্রসিদ্ধি পেয়েছে সেখানে হঠাৎ করেই জামায়াত-শিবিরের বিজয় দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য, রাজনীতি-অর্থনীতি, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে।
আমাদের দেশের জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান, আওয়ামী লীগ শাসনের অবসান এবং আওয়ামী দোসরদের পলায়নের পর সবার আশা-আকাক্সক্ষার বিমূর্ত প্রতীক হয়ে পড়েছিল গণতন্ত্র এবং নির্বাচন। গত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলসমূহ এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যে চেষ্টা-তদবির করে আসছে তার মূল লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্য নানামুখী সংস্কার প্রস্তাব এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, জুলাই আগস্ট বিপ্লবের মূল আদর্শ থেকে আমরা সম্ভবত বিচ্যুত হতে চলেছি যার শুরুটা হলো ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে।
আওয়ামী লীগের পতনে প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র যারপরনাই ত্যক্তবিরক্ত এবং ভারত ইতোমধ্যেই তাদের নানামুখী বক্তব্য, কূটনৈতিক তৎপরতা এবং রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত দ্বারা ড. ইউনূস সরকারের প্রতি নিজেদের অবন্ধুসুলভ মনোভাব প্রকাশ করেছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতের যে আঞ্চলিক রাজনীতির স্বার্থ তারা সংরক্ষণ করে সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ হলো তাদের সবচেয়ে উর্বর ভূমি। সমুদ্রবন্দর, ভারতীয় সাত রাজ্যের সঙ্গে বিশাল সীমান্ত এবং বঙ্গোপসাগরের কথা বিবেচনা করলে বাংলাদেশই ভারতের সবচেয়ে বড় কৌশলগত মিত্র অথবা শত্রু। পাকিস্তান জমানার পুরোটা সময় ভারত তৎকালীন পূর্ববঙ্গকে যবনভূমি অর্থাৎ শত্রুভূমি হিসেবে ধ্যান জ্ঞান করে পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষানীতি প্রণয়ন করেছিল এবং তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তারা নজিরবিহীন সাহায্য-সহযোগিতা করেছিল।
স্বাধীনতার পর ভারত সর্বদা চেষ্টা করেছে বাংলাদেশের সরকার, প্রশাসন, অর্থনীতি এবং সীমান্তের ওপর সর্বোচ্চ প্রভাব বিস্তার করার জন্য এবং তাদের সেই প্রচেষ্টা সর্বোচ্চ সফলতা পেয়েছিল ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের আগস্টের ৫ তারিখ অবধি। তারপরের ঘটনা আমরা কমবেশি সবাই জানি। এ মুহূর্তে আওয়ামী লীগের কয়েক লাখ নেতা-কর্মী ভারতে রয়েছেন। স্বয়ং শেখ হাসিনা ভারত সরকারের রাজকীয় মেহমানরূপে দিল্লিতে বসে যে রাজনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছেন, তা হররোজ বাংলাদেশে নানারকম অস্থিরতা তৈরি করে চলেছে।
ড. ইউনূসের সরকার অবশ্য ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্বাভাবিক করার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু সম্পর্কের বরফ কিছুতেই গলছে না। উল্টো নেপালে চীনপন্থি সরকারের পতনে দিল্লিতে যে নতুন উল্লাস দেখা দিয়েছে তাতে করে দিল্লি-ঢাকা সম্পর্ক এবং আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গ জনমনে নতুন আতঙ্ক তৈরি করেছে।
আলোচনার এই পর্যায়ে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে কিছু বলব। কিন্তু তার আগে চীন, পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং আমেরিকার ডিপ স্টেট পলিসি নিয়ে কিছু বলা আবশ্যক। বিভিন্ন দেশের সরকার পরিবর্তনে মার্কিন সরকার যে অর্থ ও লোকবল নিয়োগ করে সেটাই ডিপ স্টেট পলিসি হিসেবে পরিচিত। পাকিস্তানে ইমরান খানের পতন, শ্রীলঙ্কার রাজা পাকসে সরকারের পতন এবং বাংলাদেশের শেখ হাসিনার পতনের পর নেপালের অলি সরকারের পতনে ডিপ স্টেট পলিসি দায়ী বলে দশমুখে আলোচনা চলছে। আমেরিকা তিনটি উদ্দেশ্য নিয়ে এসব কর্ম করে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তাদের প্রথম টার্গেট চীনের আধিপত্য খর্ব করা। দ্বিতীয়ত নিজেদের কর্তৃত্ব অথবা তাদের মিত্র ভারত অথবা পাকিস্তানের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা তা-সর্বশেষ হবে সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে সর্বোচ্চ বাণিজ্য সুবিধা আদায়। বাংলাদেশে মার্কিন ডিপ স্টেটের ক্ষেত্রে আমেরিকা ভারত এবং পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্রকে প্রতিযোগিতার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। অন্যদিকে তারা সরাসরি চীনকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে না মূলত মিয়ানমার রোহিঙ্গা এবং আরাকান সমস্যার কারণে। এখন পর্যন্ত মিয়ানমারে শতভাগ চীনা কর্তৃত্ব রয়েছে যা মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশ, ভারত কিংবা আমেরিকার কোনো প্রস্তুতি নেই। ফলে বাংলাদেশের বেসামরিক বিষয়াদি, রাজনীতি এবং বাণিজ্য নিয়েই আমেরিকা ব্যস্ত রয়েছে। অন্যদিকে চলমান রাজনীতি এবং ভবিষ্যৎ সরকারের ওপর প্রভুত্ব স্থাপনের জন্য ভারত ও পাকিস্তানকে ওপেন লাইসেন্স দিয়েছে যেখানে আপাতদৃষ্টিতে ভারত পিছিয়ে পড়েছে এবং পাকিস্তান অনেকটা এগিয়ে গেছে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক