অনেক অনেক দিন আগের কথা। তখন ডেনমার্কের বাল্টিক সাগরজুড়ে বাস করত মৎস্যকন্যা বা মার্মেইডের দল। তাদের রাজত্ব ছিল এই সমুদ্রের গভীর অতলে। সে রাজ্যের নাম ছিল মার্মেইড টাউন আর সেখানে শাসন করত এক সুন্দরী মৎস্যকন্যা। নাম তার রূপাঞ্জল ডিউ। এক দিন এক ভয়ংকর জলরাক্ষস জেরেনিমো মৎস্যকন্যার রাজ্য মার্মেইড টাউনে আক্রমণ চালিয়ে রাজকন্যা রূপাঞ্জল ডিউকে একটা সোনার খাঁচায় বন্দি করল। রাক্ষসের সেই আক্রমণে মৎস্যকন্যাদের অনেকেই মারা গেল। অনেকে প্রাণ নিয়ে এদিক ওদিক পালাল। আসলে প্রকাণ্ড আকৃতির জলরাক্ষস জেরেনিমো রাজকন্যা রূপাঞ্জল ডিউয়ের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাকে ভালোবেসে ফেলেছিল। সে প্রতিদিন সমুদ্র চষে বেড়িয়ে সামুদ্রিক মাছ, অক্টোপাস, তিমি মাছ শিকার করে খেয়ে সন্ধ্যার সময় একটি সুন্দর রাজপুত্রের আকৃতি ধারণ করে রাজকন্যা রূপাঞ্জল ডিউয়ের কাছে এসে বিনীতভাবে বিয়ের প্রস্তাব দিত। কিন্তু রাজকন্যা তাকে ঠিকই চিনতে পারত আর প্রতিবার তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করত। এভাবে দিন কাটতে লাগল। অন্যান্য মৎস্যকন্যারা বাল্টিক সাগরের তীরে তীরে ঘুরে বেড়াত আর কাঁদত। এক দিন ডেনমার্কের রাজপুত্র ইভান জোন্স এলো বাল্টিক সাগরের তীরে। সে সেখানে একটি মৎস্যকন্যাকে বসে বসে কাঁদতে দেখল। রাজপুত্র ইভান তার কাছে যেয়ে কান্নার কারণ জানতে চাইল। মৎস্যকন্যা তখন সব কথা রাজপুত্র ইভানকে খুলে বলল। শুনে রাজপুত্র খুব দুঃখ পেল। সে মৎস্যকন্যাকে কথা দিল যে জলরাক্ষস জেরেনিমোর হাত থেকে সে মৎস্যকন্যাদের রাজ্য ও রাজকন্যাকে উদ্ধার করে দেবে। এ কথা বলে সে বাল্টিক সাগরের পাড় থেকে একটা গহিন বনের ভিতর দিয়ে আপাতত চলল তার রাজ্য ডেনমার্কের ঝলমলে সুন্দর রাজধানী কোপেনহেগেনের দিকে। এদিকে বনের মধ্য দিয়ে যখন রাজপুত্র ইভান জোন্স যাচ্ছিল, তখন জলরাক্ষস জেরেনিমো তাকে দেখে ফেলে। সে একটা ভয়ংকর বাঘের রূপ ধারণ করে রাজপুত্র ইভানকে ধাওয়া করে। রাজপুত্র ইভান দৌড়ে পালাতে থাকে। হঠাৎ রাজপুত্র একটা ঝোপের মাঝে গর্ত দেখে, সেখানে লুকিয়ে পড়ে। ওই গর্তে বাস করত এক নীলপরী। সে তখন ঘুমাচ্ছিল। রাজপুত্রের গর্তে ঢোকার শব্দে নীলপরীর ঘুম ভেঙে যায়।
নীলপরী বিরক্ত ভরা কণ্ঠে রাজপুত্র ইভানকে বলল, তুমি আমার ঘরে ঢুকে আমার ঘুম ভাঙালে কেন? রাজপুত্র তখন নীলপরীকে সব খুলে বলে। নীলপরী তখন কিছুক্ষণ চোখ বুজে ধ্যান করে বলল, ওই বাঘটাই শয়তান জলরাক্ষস। সে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপ ধারণ করতে পারে। নীলপরী তখন বলল, তুমি কি সত্যিই জলরাক্ষসকে হত্যা করে মৎস্যকন্যা রূপাঞ্জল ডিউকে উদ্ধার করতে চাও? রাজপুত্র ইভান বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ চাই। নীলপরী তখন রাজপুত্র ইভান জোন্সকে একটা তলোয়ার দিয়ে বলল, এই নাও তলোয়ার, এর নাম একরার। এটি থেকে শক্তিশালী আলোকরশ্মি বিচ্ছুরিত হয়। এই আলোকরশ্মির সামনে জলরাক্ষস টিকতে পারবে না। আর এই নাও একটা লাঠি। এই লাঠিটা মাটিতে ফেলে দিলেই এটি উভচর যান হয়ে যাবে। তুমি জলে, স্থলে, আকাশে যে কোনো জায়গায় এর সাহায্যে যেতে পারবে। রাজপুত্র ইভান তখন নীলপরীকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে পথে নামল। সে লাঠিটা মাটিতে ফেলতেই একটা বড়সড়ো উভচর যান হয়ে গেল। রাজপুত্র ইভান তখন উভচর যানটিকে বাল্টিক সাগরের তলদেশে নিয়ে যেতে বলল। তারপর তারা বাল্টিক সাগরের তলদেশে সোনার খাঁচায় বন্দি মৎস্যকন্যাদের রাজকুমারী রূপাঞ্জল ডিউকে খুঁজতে লাগল। খুঁজতে খুঁজতে এক দিন রাজপুত্র ইভান একটা প্রকাণ্ড রাজপ্রাসাদের সামনে সোনার খাঁচার দেখা পেয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই সোনার খাঁচার কাছে গিয়ে রূপাঞ্জল ডিউকে বলল, তুমি একটুও ভয় পেও না। আমি এক্ষুণি তোমাকে উদ্ধার করছি। এই বলে সে একরার নামের তলোয়ার দিয়ে আলোকরশ্মির বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে সোনার খাঁচার তালা খুলে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে রূপাঞ্জল ডিউ বাইরে বেড়িয়ে এলো। সে রাজপুত্র ইভানের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। রাজপুত্র ইভানেরও ততক্ষণে রূপাঞ্জল ডিউকে ভালো লেগে গেছে। এর মধ্যেই ঘটল এক ঘটনা। রাজপুত্র ইভান যখন একরার নামের তলোয়ারটি দিয়ে সোনার খাঁচার তালা গলিয়ে ফেলছিল, জলরাক্ষস জেরেনিমোর কাছে খাঁচাটি থেকে শব্দ তরঙ্গের মাধ্যমে বার্তা চলে গেল। জেরেনিমো সব কাজ ফেলে সাগর তলের রাজপ্রাসাদের কাছে আসতে লাগল এবং দেখতে দেখতে সে সেখানে এসে পৌঁছে গেল। এসেই রাজপুত্র ইভানকে দেখে জলরাক্ষস জেরেনিমো গর্জে উঠল। সে মুখ দিয়ে এক ঝলক আগুন রাজপুত্রের দিকে ছুড়ে মারল। রাজপুত্র ইভানও তার একরার তলোয়ার জলরাক্ষসটার দিকে মেলে ধরল। একরার তলোয়ার থেকেও একঝলক আলোকরশ্মি জলরাক্ষসের ছুড়ে দেওয়া আগুনের দিকে ছুটে গেল। শুরু হলো দুই আলোকরশ্মির যুদ্ধ। ধীরে ধীরে একরার তলোয়ারের আলোকরশ্মি বিজয়ী হতে লাগল। জলরাক্ষসের ছোড়া আগুনের রশ্মি পিছিয়ে যেতে লাগল। পেছাতে পেছাতে আগুনের রশ্মি জলরাক্ষসের শরীরে পৌঁছে যেতেই তার গায়ে আগুন লেগে গেল। জলরাক্ষস আগুনের জ্বালায় চেঁচাতে চেঁচাতে জ্বলে, পুড়ে ছারখার হয়ে মারা গেল। রাজপুত্র ইভান ও মৎস্যকন্যা রূপাঞ্জল ডিউ তখন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। মৎস্য রাজকুমারীর ডাকে মার্মেড টাউন রাজ্যের মৎস্যকন্যারা সবাই একে একে ফিরে এলো। রাজ্য আবার হাসি, গানে, কোলাহলে মুখর হলো। অনেক দিন ওদের সঙ্গে থাকার পর, রাজপুত্র ইভান রূপাঞ্জল ডিউকে বলল, আমি এখনকার মতো আমার দেশে ফিরে যাচ্ছি। কিছু দিন পরে বাবা, মা’কে নিয়ে আসছি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। এ কথা শুনে রূপাঞ্জল ডিউর ফর্সা, সুন্দর চেহারা রাঙা হয়ে উঠল।