আহনাফ টুপি খুঁজে পাচ্ছে না। কী মুশকিল এমন সময় টুপি না পেলে কেমন লাগে। আহনাফ রাগ হচ্ছে মায়ের প্রতি, কোথায় কী রাখে কিছুই পায় না। ছেলের চেঁচামেচি শুনে শেলিনা বেগম রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এলেন, বাহ আজ দেখি একাএকাই রেডি হয়ে গেছো। আমার বাবাটা কবে এত বড় হলো?
ছেলের কপালে ভাঁজ, মা টুপিটা আগে দাও। বাবা চলে এলে এক মুহূর্ত দেরি করা যাবে না। আর পানির বোতলে পানি দিয়ো।
শেলিনা বেগম টুপি খুঁজে পেলেন। ছেলে বাজপাখির মতো ছোঁ মেরে টুপি নিয়ে মাথায় দিলো। শেলিনা বেগম ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে, বেগুনি পাঞ্জাবি, সাদা পাজামা, সাদা টুপি ছেলেকে কী সুন্দর মানিয়েছে। আসলে সব মায়ের কাছেই তার ছেলেমেয়েরা একেকজন রাজপুত্র- রাজকন্যা।
আহনাফ তার বাবার সাথে বের হয়ে গেলো। পালের বাজার থেকে অটোতে করে চলে এলো উপজেলা মোড়ে। অনেক মানুষ এসেছে, সবাই অটো ছেড়ে এবার হাঁটতে লাগলো। আহনাফের বাবা একটি পতাকা ধরিয়ে দিল ছেলের হাতে। আহনাফ জানে আজ খুব উঁচু করে ধরে রাখতে হবে পতাকাটা। আহনাফ এক হাতে বাবার পাঞ্জাবির কোনা আরেক হাতে পতাকার লাঠি ধরে আছে। এই পতাকার ভার অনেক, ইতিহাস অনেক। এতসব না জানলেও আহনাফ জানে আজ পুরো দুপুর তাকে শক্ত হাতে এটি নিয়ে হাঁটতে হবে।
এখন সামনে কেউ একজন মাইকে বলছে, ‘‘ঋৎড়স ঃযব ৎরাবৎ ঃড় ঃযব ংবধ, মাইক থেমে যাওয়ার পর সবাই একসাথে বলছে চধষবংঃরহব রিষষ নব ভৎবব!” আহনাফও বলছে। তার কেমন অন্যরকম বোধ হতে শুরু করেছে। ঘাড়ের পেছন দিক দিয়ে যেন শিতল কিছু নেমে এসে সারা শরীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে। সে আরও জোরে বলছে চধষবংঃরহব রিষষ নব ভৎবব.
আহনাফ বেশ কিছুদিন আগে একটু একটু করে জানা শুরু করেছে ফিলিস্তিন সম্পর্কে, আল আকসা সম্পর্কে। বাবা রাতে ঘুম পাড়ানোর সময় সেসব বলে। সারা দিন ব্যস্ত থাকায় এসব নিয়ে কথা হয় না। রাতেই যা একটু হয়। তবে একটু একটু করেই আহনাফ জেনে যাচ্ছে অনেক কিছু। সে স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের সেসব গল্প শোনায়। এই যে আল আকসা, তা ছিল মুসলমানদের প্রথম কিবলা, সেদিকে মুখ করেই নামাজ পড়া হতো। এখন কাবার দিকে। বাবা বলেছে, আমাদের নবী (সা.) মক্কা থেকে আল আকসায় যান এরপর সেখান থেকে সপ্তম আকাশ পেরিয়ে আল্লাহর নিকটে যান। মক্কা মদিনার পর এটিই তৃতীয় পবিত্র স্থান।
একদিন বন্ধুরা মিলে টিফিনের সময় গল্প করছিল, গল্পে গল্পে আহনাফ বন্ধুদের শোনাচ্ছিল কীভাবে আল আকস উমর (রা.) নেতৃত্বে আসে।
তখন রাফিন উৎসুকভাবে একটু বিস্তারিত জানতে চাইল,
আহনাফ শুরু করল বলা যতটুকু সে জানে, একদিন, খলিফা ওমর (রা.) মদিনা থেকে জেরুজালেম যেতে রওনা হন। তখন শহরটি খ্রিস্টানদের ছিল, কিন্তু তারা বলেছিল, ‘শুধু মুসলিমদের খলিফা শহরের চাবি নিবে।’
খলিফা ওমর (রা.) এক সাধারণ উট নিয়ে গিয়েছিলেন, কোনো বড় বাহিনী বা রাজকীয় সাজসজ্জা ছাড়াই। শহরে ঢোকার সময় উটের লাগাম ধরে তিনি নিজেই হাঁটছিলেন। তিনি বললেন, ‘ইসলাম আমাদের সম্মান দিয়েছে।’
শহরে পৌঁছে খ্রিস্টানদের ধর্মীয় নেতা তাকে শহরের চাবি দেন। খলিফা ওমর (রা.) দেখেন আল আকসা মসজিদ যেখানে ছিল, সেই জায়গাটা ময়লায় ভর্তি। তিনি নিজে ময়লা পরিষ্কার করেন এবং সেখানে মসজিদ নির্মাণ করেন, যা আজকের আল আকসা মসজিদ।
রাফিন বলল, তাহলে আমাদের সবার তো উচিত ফিলিস্তিনের মানুষের পাশে থাকা।
আহনাফ খুবই জোর দিয়ে বলল, অবশ্যই থাকতে হবে, এটা আমাদের দায়িত্ব।
-কিন্তু আমরা কী করতে পারি? এত দূর থেকে?
- অনেক কিছু করার আছে। আমাদের দোয়া করতে হবে। আমাদের মতো ছোট শিশুদের যেন আল্লাহ নিরাপদে রাখে। তারপর ইসরায়েলি পণ্যগুলো কেনা থেকে বিরত থাকতে হবে।
-কেন? এসব কিনলে সমস্যা কী?
- আমরা ইসরায়েলি পণ্য কিনলে ওদের যে লাভ হয়, তা দিয়েই তো ফিলিস্তিনে রকেট হামলা করে, বোমা ফেলে।
- বুঝেছিরে, তাহলে আমরাও দায়ী ওদের মৃত্যর জন্য যেহেতু আমরা এগুলো সব সময় কিনি।
-হ্যাঁ আর কিনস না কেউ। আমিও কিনব না। বাবা বলছে বাড়িতে আর কখনো ওদের কোম্পানির জিনিসপত্র আনবে না।
আজ আহনাফ সশরীরে ফিলিস্তিনি হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিলে এসেছে। সবাই হাঁটছে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। ছোট থেকে বড় সব বয়সি মানুষে ভরে উঠেছে মোড়। আহনাফ ভালো করে দেখতে পাচ্ছিল না তাই বাবা ওকে কাঁধে তুলে নিলেন। এখন সব দেখা যাচ্ছে। কারও হাতে ফিলিস্তিনের পতাকা কারও হাতে বাংলাদেশি। সে আরও উঁচু করে ধরল।
বাবার সাথে হাঁটতে হাঁটতে আহনাফ করুণ গলায় বলল, বাবা চলো না আজ সবাই হাঁটতে হাঁটতে ফিলিস্তিন চলে যাই। দেখ কত মানুষ, সবাই গেলে আর কেউ সাহস পাবে না ওদের মারতে।
- সেতো অনেক দূর। হেঁটে হেঁটে যাওয়া যাবে না।
আহনাফ বায়না করেই যাচ্ছে, এতক্ষণে ওদের আশপাশের বেশ কয়েকজন মানুষ বেপারটা লক্ষ করে বাবা ছেলের কথা শুনছে। ওর একি কথা, আস্তে আস্তে হাঁটতে থাকলে তো একসময় পৌঁছাবই।
ছোট ছেলের নিঃস্বার্থ চাওয়া, কে পূরণ করবে, কে দেখবে তার ভিতর কতটা দগ্ধ হয়েছে, তার ক্ষত কতটা গভীর!
ভিড় ঠেলে এক বয়স্ক লোক এগিয়ে এসে অশ্রুসিক্ত চোখে আহনাফকে বলে গেল, বাবা তুমি এই জমানার ওমর হয়ো।