বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়ায় বসবাসকারী স্নেহা সাচার গরমে অভ্যস্ত। কারণ, তিনি তার জীবনের অর্ধেক কাটিয়েছেন দিল্লিতে। বলা বাহুল্য, দিল্লি পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণতম শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। কিন্তু স্নেহা যখন দিল্লিতে বড় হচ্ছিলেন, সেই দিনগুলোর চেয়ে বর্তমান সময়ে অনেক বেশি গরম অনুভূত হয়। ক্লিন কুলিং কোলাবোরোটিভের হয়ে কাজ করা এ নারী বলেন, আজকাল নির্দিষ্ট কিছু মাসে গাড়িতে যাতায়াতও অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছে। তা ছাড়া বাড়তে থাকা তাপমাত্রা বাইরে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য তো আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। স্নেহা বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন সত্যিই মানুষের জীবিকা অর্জনের সক্ষমতাকে প্রভাবিত করছে।’
বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, ভবন শীতল রাখার অনেক কম প্রযুক্তি আজকাল বিদ্যমান, যার মধ্যে বায়ুপ্রবাহের জন্য নকশা অন্যতম। অন্যদিকে বাইরে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য এমনকি তাপ এবং আর্দ্রতা থেকে ২০ মিনিটের বিরতি রাখা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে তাদের জন্য একটি সুপরিকল্পিত শীতলীকরণ কেন্দ্র, এ পার্থক্যটা তৈরি করে দিতে পারে। কিন্তু এর বাইরেও পৃথিবীতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বাড়তে থাকায় সক্রিয় শীতলীকরণ ক্রমবর্ধমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
তবুও বিদ্যমান শীতলীকরণ যন্ত্রগুলোর গুরুতর অসুবিধা রয়েছে। তন্মধ্যে একটি শীতলীকরণ তরল (Refrigerant), অর্থাৎ যে তরলটি তাপ স্থানান্তরের প্রক্রিয়ায় তরল থেকে গ্যাসে রূপান্তরিত হয় এবং ফিরে আসে। সিস্টেম থেকে এগুলো লিক হওয়া সাধারণ ঘটনা, যা দক্ষতা এবং সম্ভাব্য স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে। আজকাল সাধারণত শীতলীকরণ তরল হিসেবে হাইড্রফ্লুরোকার্বন (HFCs) ব্যবহার করা হয়, যা উচ্চ বৈশ্বিক উষ্ণায়ন সম্ভাবনাময় কৃত্রিম গ্যাসের এক গ্রুপ। যা কার্বন ডাইঅক্সাইডের চেয়েও শক্তিশালী। সুতরাং বিকল্প শীতলীকরণ তরলগুলোকে আরও জলবায়ুবান্ধব সংস্করণে প্রতিস্থাপন প্রয়োজন। কিন্তু কম বৈশ্বিক উষ্ণায়ন সম্ভাবনাময় বিকল্পগুলোরও সমস্যা রয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ, প্রোপেন দাহ্য। অ্যামোনিয়া বিষাক্ত। কার্বন ডাইঅক্সাইড উচ্চচাপে কাজ করে, যার জন্য বিশেষ সরঞ্জামের প্রয়োজন হয়। তবে অনেক জায়গায় HFCs-এর ব্যবহার কমানো হচ্ছে, এক্ষেত্রে বিকল্প শীতলীকরণ তরল গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। স্নেহা বলেন, আমাদের এখনো শীতলীকরণ তরল প্রয়োজন। কারণ আমরা আজ এসি হিসেবে যে প্রযুক্তি পণ্য সম্পর্কে জানি, সমাধান হিসেবে সেটিই থাকবে, অন্তত আগামী দশকে। তবে দীর্ঘমেয়াদে, কিছু বিজ্ঞানী এমন শীতলীকরণ যন্ত্রের দিকে তাকিয়ে আছেন যেখানে তরল শীতলীকরণ তরল প্রয়োজন হয় না। আর RMI-এর ভবন এবং ভূমি-ব্যবহার প্রকল্প পরিচালক লিন্ডসে রাসমুসেন সেগুলোকে ‘বৈপ্লবিক প্রযুক্তি’ বলে অভিহিত করেন।
সলিড-স্টেট কুলিং : এক নতুন দিগন্ত
বৈপ্লবিক শীতলীকরণ প্রযুক্তির প্রধান সেট- সলিড-স্টেট কুলিং (Solid-state cooling)। যা তাপমাত্রা পরিবর্তন ঘটাতে কঠিন পদার্থ এবং অতিরিক্ত শক্তি ব্যবহার করে। সেই অতিরিক্ত শক্তি চাপ, ভোল্টেজ, চৌম্বক বা যান্ত্রিক চাপ হতে পারে। লিন্ডসে রাসমুসেন বলেন, সলিড-স্টেট ডিভাইসগুলো ক্রমবর্ধমান উন্নতির চেয়ে আরও বেশি কিছু করতে পারে। কারণ এরা সুপার-দূষণকারী শীতলীকরণ তরলই বাদ দেয় না, বরং তারা সিস্টেমের উন্নত দক্ষতাও প্রদান করতে পারে। ম্যাগনোথার্মের সিইও এবং সহপ্রতিষ্ঠাতা তিমুর সিরমান বলেন, ‘এটি সহজাতভাবে নিরাপদ। কারণ এটি বিষাক্ত নয়, এটি একটি ধাতু এবং খুব কম চাপে কাজ করে।’ ম্যাগনেটোকেলোরিক কুলিংয়ের ধারণা বহু বছর ধরে প্রচলিত, তবে এর বাণিজ্যিকীকরণ তুলনামূলকভাবে নতুন।
থার্মোইলেকট্রিক কুলিং : নীরব ও অনডিমান্ড
উন্নয়নাধীন আরেকটি প্রযুক্তি থার্মোইলেকট্রিক কুলিং (Thermoelectric cooling)। এতে ডিভাইসের দুদিকের মধ্যে তাপ স্থানান্তর জড়িত। বৈদ্যুতিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে, তাপ প্রবাহের দিকে স্থানান্তরিত হয়। ডেটা সেন্টার, সুপার মার্কেট এবং অন্যান্য ভবনে ফোনোনিক কুলিং ডিভাইস এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। তাদের কুলিং ডিভাইসগুলো কম্পিউটার চিপের মতো একই উপায়ে তৈরি করা হয়, তাপ স্থানান্তরের জন্য অর্ধপরিবাহী পদার্থ ব্যবহার করে। থার্মোইলেকট্রিক ডিভাইসগুলো সহজেই চালু বা বন্ধ করা যায়। এটি খরচ, শক্তি ব্যবহার এবং স্থানের প্রয়োজনীয়তা কমাতে সাহায্য করে।
ইলাস্টোক্যালোরিক কুলিং : ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
অন্য ধরনের সলিড-স্টেট কুলিং হলো ইলাস্টোক্যালোরিক কুলিং (Elastocaloric cooling)। এটি ইলাস্টোক্যালোরিক পদার্থে যান্ত্রিক চাপের মাধ্যমে তাপমাত্রা পরিবর্তন অর্জন করে, যা চাপ প্রয়োগের সঙ্গে ঠান্ডা বা গরম হতে পারে। ইউরোপের চারটি দেশের গবেষকরা SMACool নিয়ে কাজ করছেন, ইলাস্টোক্যালোরিক এয়ার কন্ডিশনার, যা নির্দিষ্ট ধাতব সংকর ধাতু দিয়ে তৈরি ধাতব টিউব ব্যবহার করে। যদিও এর সর্বোচ্চ দক্ষতা এখনো প্রচলিত এয়ার কন্ডিশনারগুলোর চেয়ে কম, তবে এর লক্ষ্য এসি এর শক্তি দক্ষতাকে হারানো। সেক্ষেত্রে অব্যাহত রয়েছে। হংকংয়ের গবেষক দল সম্প্রতি এসির বিকল্প তৈরি করেছে, যা 1,284W-এর শীতলীকরণ ক্ষমতা অর্জন করেছে, যা প্রথমবার ইলাস্টোক্যালোরিক ডিভাইস 1,000W-এর সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এতে তাপ স্থানান্তরের জলের পরিবর্তে গ্রাফিন ন্যানোফ্লুইড ব্যবহার করা হয়েছে।
তথ্যসূত্র : বিবিসি