লোকসংগীতের বরেণ্য শিল্পী ফরিদা পারভীন কুষ্টিয়ায় বাবা-মায়ের কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন। গতকাল বাদ এশা পৌর গোরস্থানের সামনে নির্ধারিত স্থানে জানাজা শেষে তাঁকে সমাহিত করা হয়। প্রথমে বাদ মাগরিব জানাজা এবং দাফনের কথা থাকলেও ঢাকায় আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে লাশ কুষ্টিয়ায় এসে পৌঁছাতে বিলম্ব হওয়ায় পরে পরিবারের পক্ষ থেকে বাদ এশা জানাজা এবং দাফনের সময় ঘোষণা করা হয়।
এর আগে রাত সাড়ে ৮টার দিকে শিল্পী ফরিদা পারভীনকে বহন করা অ্যাম্বুলেন্সটি কুষ্টিয়া পৌর গোরস্থানে এসে পৌঁছে। সেখানে জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে তাঁকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। শিল্পীর ছেলে ইমাম নাহিল সুমনসহ পরিবারের সদস্যরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। জানাজায় অংশগ্রহণ করতে এসে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীন, বিশিষ্ট কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার, বিশিষ্ট লালন গবেষক লালিম হক, লালন একাডেমির শিল্পীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ জানাজায় অংশ নেন। প্রিয় এ শিল্পীকে শেষ বিদায় জানাতে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি উপেক্ষা করে আগে থেকেই সেখানে শত শত মানুষ ভিড় জমান। বৃষ্টিস্নাত গোরস্থানে সর্বস্তরের মানুষের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় শেষ বিদায় নেন প্রখ্যাত লালন সংগীতশিল্পী ফরিদা পারভীন। জানাজা শেষে তাঁকে পৌর গোরস্থানে সমাহিত করা হয়।
এ সময় অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বিশিষ্ট কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার সাংবাদিকদের বলেন, ফরিদা পারভীনকে শুধু শিল্পী বললে অন্যায় হবে। তাঁর অবদানটা শিল্পী হিসেবে না। তিনি ফকির লালন শাহকে পরিচিত করেছেন সারা বাংলাদেশে, এ উপমহাদেশে, সারা বিশ্বে। এর মানেটা হলো এই- এর আগে আমরা ফকির লালন সম্পর্কে জানতাম একজন পল্লিগীতি হিসেবে। আবদুল আলিম পল্লিগীতি আকারে গাইতেন। এভাবে শুনতাম। কিন্তু ফরিদা যখন গাইলেন আমরা প্রথম বুঝলাম আমরা একজন সাধকের গান শুনছি। বাংলার ভাবজগতের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষের চমৎকার গান শুনছি। এই কাজটা ফরিদা করেছেন।
তিনি প্রথম করেছেন। প্রথম যিনি করেন তাঁর কাজটা অবদানটা এমনই অসামান্য। এটা পূরণ হওয়ার যোগ্য না। ফরিদা পারভীন একটা ধারা তৈরি করে দিয়েছেন, যেই ধারা থেকে আমরা গড়ে উঠেছি। কুষ্টিয়াবাসীর জন্য সত্যিকার অর্থেই আজ দুঃখের দিন। কুষ্টিয়াকে সত্যিকার অর্থেই আমরা সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। এটা হবে উপমহাদেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক নগরী। সেই ভিত্তিটা ফরিদা পারভীন তৈরি করে গেছেন।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কুষ্টিয়া কেন্দ্রীয় পৌর গোরস্থানের খাদেম নুরু বলেন, শিল্পী ফরিদা পারভীনের বাবা কুষ্টিয়া হাসপাতালে চাকরি করতেন। সেই সুবাদে ছোটবেলায় তিনি কুষ্টিয়ায় বেড়ে ওঠেন। আমরা একই এলাকার মানুষ ছিলাম। ছোটবেলায় আমরা ফরিদা পারভীনের সঙ্গে খেলাধুলা করতাম। আমরা সমবয়সি হওয়ায় বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। বড় হওয়ার পরে তিনি কুষ্টিয়ার বাইরে থাকেন। এজন্য যোগাযোগ ছিল না। তবে দেখা হলে আমাদের কথা হতো।
এদিকে গতকাল রাজধানীতে সকাল ১১টায় প্রিয় শিল্পীকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার শুভাকাক্সক্ষী, ভক্ত, সুহৃদ ও স্বজনদের উপস্থিতিতে কানায় কানায় ভরে গিয়েছিল। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের অহংকার কিংবদন্তি শিল্পী ফরিদা পারভীনকে ফুলেল শ্রদ্ধায় সিক্ত করে বিভিন্ন ব্যক্তি, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান।
ব্যক্তিগতভাবে শ্রদ্ধা জানায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক কিংবদন্তি অভিনেতা আশরাফ উদ্দিন আহমেদ উজ্জ্বল, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম, চলচ্চিত্র নির্মাতা কামার আহমেদ সায়মন, জাতীয় কবিতা পরিষদ সভাপতি মোহন রায়হান, সাধারণ সম্পাদক রেজাউদ্দিন স্টালিন প্রমুখ। প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংগঠনিকভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস), বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ বেতার, সত্যেন সেন শিল্পী গোষ্ঠী, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, আর্কাইভ ও গ্রন্থাগার অধিদপ্তর, বাংলাদেশ রেলওয়ে, বাংলাদেশ মিউজিশিয়ান ফাউন্ডেশন, জাতীয় কবিতা পরিষদ, নিজেরা করি, অচিন পাখি সংগীত একাডেমিসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।
শ্রদ্ধা নিবেদনকালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক কিংবদন্তি অভিনেতা মেগাস্টার খ্যাত চিত্রনায়ক আশরাফ উদ্দিন আহমেদ উজ্জ্বল বলেন, কিংবদন্তি একজন সংগীতশিল্পীকে হারালাম আমরা। এই শূন্যতাকে পূরণ করার জন্য আমাদেরকে সম্মিলিতভাবে সচেষ্ট হতে হবে।
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন, ফরিদা পারভীন দুটি ক্ষেত্রে অত্যন্ত বড় শিল্পী। লালনের গান পরিবেশনায় উনার যে গায়কী, তাতে একটা ‘মধ্যবিত্ত ভাব’ আছে। এই ভাব দিয়েই তিনি মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে যান।
জাতীয় কবিতা পরিষদ সভাপতি কবি মোহন রায়হান বলেন, ফরিদা পারভীনের প্রয়াণে আজ কাঁদছে তাঁর অসংখ্য ভক্ত, কাঁদছে প্রকৃতিও। বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনে তিনি এক অনন্য অধ্যায় ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে সংগীতাঙ্গন তথা সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। যা কোনোভাবেই পূরণ হওয়ার নয়।
সাধারণ সম্পাদক কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন বলেন, লালনের গান মানেই ফরিদা পারভীন, আর ফরিদা পারভীন মানেই লালনের গান। তাঁর প্রয়াণে আমরা সবাই গভীরভাবে শোকাহত।
বৃষ্টি উপেক্ষা করেও ফরিদা পারভীনকে শ্রদ্ধা জানাতে যারা উপস্থিত হয়েছিলেন তাদের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান ফরিদা পারভীনের স্বামী বংশীবাদক গাজী আবদুল হাকিম।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি পর্ব শেষে বাদ জোহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে ফরিদা পারভীনের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।