বোনপো ড. কাইউম পারভেজের শ্বশুর বায়ান্নর ভাষাসৈনিক মোস্তফা রওশন আখতার। ‘এম আর আখতার মুকুল’ নামে বেশি পরিচিত এই মোহন কথাকার স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ বেতার-এর মহাপরিচালক নিযুক্ত হন। ১৯৭৫ সালের আগস্ট থেকে তাঁকে ব্রিটেনে থাকতে হয়েছে। তাঁকে ‘মুকুল ভাই’ সম্বোধন করতাম, বেয়াই হওয়ার পরও বলতাম মুকুল ভাই। তিনি আগে আমায় নাম ধরে ডাকতেন; আত্মীয় হওয়ার পর দেখা হলে বলতেন, কুটুমের কুশল কেমন?
লন্ডনে প্রবাস জীবনের একপর্যায়ে এম আর আখতার মুকুল (জন্ম : ৯ আগস্ট ১৯৩০- মৃত্যু ২৬ জুন ২০০৪)। জীবিকার জন্য যে কাজ করতেন তা রেডিওর প্রাক্তন ডিজির পক্ষে খুবই বেমানান। এজন্য তার আফসোস ছিল না। বলতেন ‘আনন্দবেদনা, হাসিকান্না, সংকট-সম্পদ আছে বলেই তো জীবনটা উপভোগ্য করে তোলার সাধনা জারি রয়েছে এই দুনিয়ায়।’ জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাড়ি যেখানে, এম আর আখতার মুকুলের বাড়িও সেখানে- বগুড়া জেলায়। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ‘চরমপত্র’ অনুষ্ঠানের পরিচালক লেখক ও কথক এম আর আখতার মুকুলকে ১৯৭৯ সালের শেষ দিকে লন্ডন থেকে ঢাকায় নিয়ে এলেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। নিয়োগ দিলেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব পদে। ওই সময়েই তাঁর বড় মেয়ে কবিতা আর আমার বোনপো পারভেজের বিয়ে হয়।
রাজধানীর শান্তিনগর থেকে প্রকাশিত সাময়িকী ‘চিত্রবাংলা’য় এম আর আখতার মুকুলের ব্যক্তিগত নিবন্ধ ছাপা হতো। মাঝেমধ্যে পত্রিকাটির অফিসে আসতেন মুকুল ভাই। সেখানে কাঁচাবয়সি সাংবাদিকদের সঙ্গে তুমুল আড্ডা দিতেন। ওই সময় দৈনিক ‘সংবাদ’-এর সংস্কৃতি পাতায় স্যার রিচার্ড অ্যাটেনবরো পরিচালিত বিখ্যাত ফিল্ম ‘গান্ধী’র ওপর আমার একটা লেখা বেরোয়। শান্তিনগরের আড্ডায় তাঁর সঙ্গে দেখা হলে তিনি লেখাটার বর্ণনাভঙ্গির তারিফ করে বলেন, ‘আস্ত একটা পাষণ্ড তুমি! নিয়মিত লেখালেখি কর না। করলে ফাটায়া দিতে পারবা।’ আরও বললেন, ভাবনাচিন্তার পাথরে খোদাই হয়ে যায় যেসব কথা, যেসব ঘটনা, যেসব ব্যক্তি, তাদের কাগজে এঁকে রাখা দেশগুলোই ক্রমাগত সামনে এগিয়ে গেছে। কাগজে এঁকে না রাখলে দেহবিনাশের সঙ্গে সঙ্গে পাথরের ওই বিষয়গুলোরও বিলুপ্তি অনিবার্য। ইতিহাস বলে, যুগে যুগে দুনিয়াকাঁপানো ঘটনাবলির উৎসমুখ রচনা করেছে কাগজে আঁকা পাথরের ছবি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে করতেন মানবজীবনে একেকটি ভাবনা এক একটি তারা হয়ে রাজত্ব করে। ২০০১ সালের স্বাধীনতা পদকে ভূষিত এম আর আখতার মুকুল বলেন, ‘ভাবনায় যা ধরা দেয় তা চটজলদি টুকে নাও। তারপর সেগুলো অন্যদের জানাও। জানাবার সময় সততার বশবর্তী থাকতে হবে। নইলে রচনাই সার/মঙ্গল বাতাবরণ পগার পার।’ দুনিয়ার পিলে চমকানো মঙ্গলবার দিনটি আমার ভাবনার পাথরে খোদাই হয়ে রয়েছে। সেটা হলো ২০০১ সালের মঙ্গলবার, মাস : সেপ্টেম্বর যাকে পশ্চিমি সংবাদমাধ্যম ‘নাইন/ইলেভেন’ নামে চাউর করেছে।
এত পলকা? : নাইন/ইলেভেনে আল-কায়েদা সন্ত্রাসী সংগঠনের ধ্বংসাত্মক অভিযান যে আমেরিকার ইজ্জত মাটিতে নামিয়ে দিয়েছে তার প্রমাণ ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘মাগা’ (মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন) প্রচারাভিযানের সাফল্য। ‘আবার আমেরিকাকে শ্রেষ্ঠতম দেশ বানাও’ আওয়াজ তুলে ২০১৬ সালের নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান দলীয় প্রার্থী ট্রাম্প বিস্ময়কর বিজয় অর্জন করেন।
নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের উত্তর ও দক্ষিণ (টুইন) টাওয়ারে আর ওয়াশিংটনে প্রতিরক্ষা সদর দপ্তর ‘পেন্টাগন’ ভবনে নাইন/ইলেভেনে আত্মঘাতী বিমান হামলা করেছিল আল-কায়েদার জঙ্গিরা। ছিনতাইকারী জঙ্গিদের সঙ্গে যাত্রীদের ধস্তাধস্তির ফলে পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের স্যাংক্সভিলে মাঠে বিধ্বস্ত হয় আরেকটি বিমান। মঙ্গলবার সকাল ৮-৪৬ থেকে ১০টা ৩ মিনিট পর্যন্ত সময়ে ১৯ জন জঙ্গির এই আত্মঘাতী হামলায় ২ হাজার ৯৭৭ ব্যক্তির প্রাণ গেছে।
সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত চারটি যাত্রীবাহী উড়োজাহাজই ছিল বেসরকারি বিমান সংস্থার। এগুলোয় ওঠার জন্য আত্মঘাতী জঙ্গিরা বিভিন্ন এয়ারপোর্ট ব্যবহার করেছে। নিরাপত্তা প্রহরার সর্বাধুনিক প্রযুক্তির চোখ ফাঁকি দিয়ে এরা যেভাবে চারটি উড়োজাহাজ ছিনতাইয়ে ‘সফল’ হয়েছে তাতে খুবই মর্মাহত আমার সহকর্মী সাংবাদিক তারিক-উল ইসলাম বলেন, ওরে আল্লাহ! আমেরিকার সিকিউরিটি সিস্টেম এত পলকা?
আমিও মর্মাহত হয়েছিলাম। তবে তারিকের মতো নয়। আমাকে ভীষণ আহত করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ জুনিয়রের ঔদ্ধত্য আচরণ। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিমান রাষ্ট্র আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বুশ নাইন/ইলেভেন সকালে ফ্লোরিডার একটি শিশু শিক্ষালয় পরিদর্শনে ছিলেন। সেখানে তার চিফ অব স্টাফ এন্ডরু কার্ড তাঁকে জানান, ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের নর্থ টাওয়ারে একটি প্লেন ঢুকে পড়েছে।’ বুশ ধরে নেন যে ওটা দুর্ঘটনা। কিন্তু আঠারো মিনিট পর এন্ডরু কার্ড প্রেসিডেন্টের কানে কানে বলেন, ‘স্যার; একটু আগে সাউথ টাওয়ারেও একটা উড়োজাহাজ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ বুশ বলেন : আমেরিকা ইজ আন্ডার অ্যাটাক!
আল-কায়েদার প্রধান নেতা ওসামা বিন লাদেন তখন তাঁর আস্তানা গেড়েছেন আফগানিস্তানের দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে। তাঁর বিশ্বস্ত সহচর খালিদ শেখ মুহম্মদ ছিলেন নাইন/ইলেভেন ঘটনার পরিকল্পক। আল-কায়েদাকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার সংকল্প ঘোষণা করেন বুশ এবং এ বিষয়ে শান্তিকামী বিশ্ববাসীর সহযোগিতা কামনা করেন। বলেন, ‘যাঁরা আমাদের সঙ্গে থাকবেন না, আমরা ধরে নেব তাঁরা আমাদের বিরুদ্ধে।’ এটা কী মহান দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের ভাষা? প্রশ্ন তোলেন সাংবাদিক-গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ। বলেন আওয়াজটা তো মহল্লার খতরনাক মাস্তানের আস্ফালনের মতো।
কাগুজে বাঘ : কাগজের ফুল সুবাসহীন। কাগুজে বাঘ নখদন্তহীন। শোনা যায়, চীনা কম্যুনিস্টরা আমেরিকাকে আস্ফালনে পারদর্শী কাগুজে বাঘ বলে উপেক্ষা করার বাতিকে ভুগতেন। চেয়ারম্যান মাও সে তুং বলতেন, দুশমনকে খাটো করে দেখো না। মনে রেখো কাগুজে ওই বাঘটির কিন্তু আণবিক দাঁত রয়েছে। আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনও আমেরিকাকে কাগুজে বাঘ মনে করতেন। মিসরীয় নাগরিক আবু ওয়ালিদ আল-মাসরি বহু দিন আফগানিস্তানে লাদেনের সহচর ছিলেন। তিনি বলেন, ১৯৮৩ সালে বৈরুতে মার্কিন সেনা ব্যারাকে আল-কায়েদার বোমা হামলায় ২৪১ জন মার্কিন মেরিনের প্রাণ যায়। এরপরই লেবানন ছেড়ে যায় মার্কিন সেনা। ১৯৯৩ সালে মোগাদিসু শহরে বোমায় ১৮ মার্কিন সেনা মারা গেলে, আমেরিকান সেনারা সোমালিয়া থেকে ভাগে। সত্তর দশকে তারা ভয়ংকর পিটুনি খেয়ে ভিয়েতনাম ছেড়েছিল। এসব ঘটনায় লাদেনের বিশ্বাস দৃঢ় হয়, ‘ঝাঁকুনি দিতে পারলে বোঁটা থেকে খসে পড়বে আপেল।’ খসে যে পড়েনি তা পরিষ্কার। তবে ঝাঁকুনিটা যে খুবই প্রবল তা-ও অনস্বীকার্য। আক্রান্ত ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে দক্ষিণ টাওয়ার পুড়তে পুড়তে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায় বিকাল ৬টায়। ২৯ মিনিট পর উত্তর টাওয়ারেরও একই দশা। সুউচ্চ ভবনটি ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থাকা আগুন তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে ধিকিধিকি জ্বলেছে।
কলেজে পড়াকালে আমাদের এলাকায় ভয়ংকর এক পেশিমানবের রাজত্ব দেখেছি। আড়ালে তাকে ‘মনা গুন্ডা’ বলা হতো। সামনে ‘মন্নান সাব’ কিংবা ‘মনা ভাই’। কনভেনশন মুসলিম লীগের নিরাপত্তাবিষয়ক ওস্তাদ মনার উচ্চতা ছ’ফুট দুই ইঞ্চি। মজবুত দেহী শ্যামলাবরণ পুরুষ। কণ্ঠস্বর গমগমে। তাকে দেখলে সবাই রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে সালাম জানায়। ছ’ফুট উঁচা ছিল আমাদের সহপাঠী মনির আহমেদ (পরবর্তীকালে ব্যবসায়ী, পারটেক্স গ্রুপের পরিচালক; অকালপ্রয়াত)। লক্ষ করি যে ছ’ফুটকে শ্রদ্ধাবনতচিত্তে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে ছ’ফুট দুই ইঞ্চি। এবং জানতে চায় ‘বালা আছেননি মনির বাই?’
ঘটনা কী? তোমারে মনার এত ভক্তি কিসের? প্রশ্ন করি আমরা। মনির বলে, ‘ছাগল মনে করে বাঘেরে থাপ্পড় মেরেছি। ব্যস্! পরানের সাজি সাজানো হয়ে গেল খেলার ফুলে।’ আর কিছু খোলাসা করে না সে। পরে গোয়েন্দা লাগিয়ে জানা গেছে, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থীবিশেষের পক্ষে সন্ত্রাস চালাতে গিয়ে মনা ভাইয়ের আক্কেল হয়েছে। মনির যে প্রার্থীর সমর্থক, সেই প্রার্থীর সব পোস্টার ছিঁড়ে ফেলে মনা হুংকার দিচ্ছিল- ‘অমুকরে ভোট দিবি। না দিলে তোগো ঠ্যাং ভাইঙ্গালামু।’ মনির এগিয়ে যায়। কষিয়ে চপেটাঘাত করতেই চিৎপাত হয়ে যায় মনা। যাকে রুখছে সে পেশাদার গুন্ডা, এটা মনিরের জানা ছিল না। সাহসী হওয়ার জন্য অজ্ঞানতা বেশ ফলপ্রদ, মার্কটোয়েন কথাটা বেহুদা বলেননি।
ম্যালেরিয়া আতঙ্ক : প্রখ্যাত সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী নিজেকে নিয়ে রঙ্গতামাশা করার চমৎকার নৈপুণ্য ধারণ করতেন। এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমার মধ্যে পাগলামি আছে। আমি হলাম টুয়েন্টিফোর পার্সেন্ট ম্যাড। সমালোচকরা বলেন, আমি হাফ ম্যাড। আমার ওয়াইফের স্থির বিশ্বাস, তার হাজবেন্ড ফুল ম্যাড।’ এম আর আখতার মুকুলও নিজের যৌবনের কাজকর্ম নিয়ে মজা করতেন। তাঁর বাবা ছিলেন পুলিশ অফিসার। পিতা চাইতেন পুত্র যেন পুলিশের কর্তা হন। কিন্তু পুত্রটি হয়েছেন দৈনিক পত্রিকার প্রতিবেদক। পিতাকে খুশি করতে তিনি পুলিশে চাকরি সন্ধান করে সফল হয়েছিলেন। তবে নিয়োগপত্র হাতে এলে সংকটের শুরু। তাঁকে পদায়ন করা হয়েছে নোয়াখালী জেলায়। ওই জেলায় তিনি কখনোই যাবেন না। কিছুতেই না। শুনেছেন ওখানে চাকরি করতে গেলে মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া হবেই। ভুগতে হবে পানিবাহিত নানারকম রোগে।
নিয়োগটা অন্য জেলায় দেওয়ার জন্য বিস্তর আবেদন-নিবেদন করেন এম আর আখতার মুকুল। কোনো ফলোদয় হলো না। ক্ষোভে-দুঃখে তিনি সরকারি চাকরিই করলেন না। তিনি লিখেছেন, ‘নোয়াখালীর প্রতি আমার বিরাগের তীব্রতা দেখে বিধাতা বোধ হয় হাসছিলেন। বহু বছর পর দেখি, আমার মেয়ে কবিতার শ্বশুরালয় নোয়াখালী জেলায়। যেখানে আমি গেলাম না, সেখানে গেল আমার কলিজার টুকরা।’ ‘রূপালী বাতাস সোনালী আকাশ’ নামে এম আর আখতার মুকুল রচিত বইটি ১৯৭৪ সালে বেরিয়েছে। ভাবনাচিন্তা খোদাই করা পাথর বলা যায় এই বইকে। জানি না, এখন বাজারে পাওয়া যাবে কিনা। বইটিতে স্থান পাওয়া ঘটনাগুলোর একটি এখানে নিবেদন করি-
পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে গড়া মোর্চা যুক্তফ্রন্টের নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক কুমিল্লায় এক জনসভায় বক্তৃতায় বলেন, ‘মুসলিম লীগ বলছে আমরা জিতলে এই প্রদেশটারে ভারতের কাছে বেইচ্চা দিমু। আরে চোরার পুত চোরারা। নয় বছর ক্ষমতায় থাইকা তোরা তো খাইতে খাইতে দেশটারে ফোক্লা কইরা দিছস। মাগনায় দিলেও তো এই মাল কেউ কিনবে না।’
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন