আমি তখন ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি, বয়স সাড়ে ১৭ বছর। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে, তখন আমি আতঙ্কিত হয়ে রেডিওতে খবর শুনছিলাম। ঠিক রাত ১২টা ১ মিনিটে রেডিওতে ঘোষণা আসে- শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন এবং সবাইকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তার নির্দেশে আমিও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার সংকল্প করি। প্রথমে আমি ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে প্রশিক্ষণ নিই, পরে আমাদের মধুপুরে নিয়ে যাওয়া হয় কালিহাতি ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়ার জন্য। তবে ময়মনসিংহে পাকিস্তানি বাহিনী প্রবেশ করলে আমরা স্থান ত্যাগ করি। এরপর ফুলবাড়ীয়া, রাঙ্গামাটি, কাওরাইদ হয়ে নদী পার হয়ে টোক নামক স্থানে পৌঁছাই। সেখানে কুমিল্লার দুজন বিডিআরের সঙ্গে পরিচিত হই এবং তাদের সঙ্গে নৌকাযোগে রওনা হই। এরপর নরসিংদীর সাতচূড় গ্রামে সিরাজুল ইসলাম নামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিই। সেখানে দেখি মেজর নজরুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমাকে ৫১ জনের একটি দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর মেজর নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে আমরা ভৈরব হয়ে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হবিগঞ্জ হয়ে ভারতের কাছাড় জেলার হাঁপানিয়া ক্যাম্পে পৌঁছি। হাঁপানিয়া ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বাছাই করে পালাডোবা ট্রেনিং সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমরা ২৯ দিনের কঠোর সামরিক প্রশিক্ষণ নিই। এরপর আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য সীমান্তবর্তী এলাকায় পাঠানো হয়। সর্বপ্রথম আমরা সিলেটের আজমপুরে এসে পৌঁছি। তখন আমরা ৩ নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিলাম, যার দায়িত্বে ছিলেন মেজর কে এম শফিউল্লাহ। আমরা আজমপুর, ধর্মনগর ও মুকুন্দপুরে যুদ্ধে অংশ নিই। তবে সবচেয়ে বড় যুদ্ধটি হয় হাঁটুভাঙায়। হাঁটুভাঙার যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী শতাধিক সেনা নিয়ে ভারী অস্ত্রসহ আমাদের ওপর হামলা চালায়। আমাদের কাছে তখন ভারী অস্ত্র ছিল না তবে যুদ্ধকৌশলে আমরা এগিয়ে ছিলাম। মিত্রবাহিনী যুক্ত হওয়ার পর মর্টারের মতো ভারী অস্ত্র আমরা হাতে পাই। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি গ্রুপ তিন দিক থেকে এসে একত্রিত হয়। বিকাল ৪টা থেকে শুরু হয়ে রাত ২টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। আমাদের পরিকল্পনা ছিল শত্রুর রসদ ফুরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা। সেই পরিকল্পনাই কাজ করে। মিশন শেষ করে আমরা আবার ভৈরব হয়ে রায়পুরায় চলে আসি। সেখানে মাস্টারবাড়িতে আশ্রয় নিই। সম্ভবত ৭ বা ৮ ডিসেম্বরের ঘটনা এটি। এরপর ৯ ডিসেম্বর নরসিংদী মুক্ত হয়। আমরা তখনই বিজয় উদযাপন করি। ওই মাস্টারবাড়িতেই আমাদের অস্ত্র জমা দিই। ১২ ডিসেম্বর আমি বাড়ির উদ্দেশে রওনা হই। ভৈরব থেকে ট্রেনে করে ময়মনসিংহ ফিরে আসি। সবাই ভেবেছিল আমি শহীদ হয়েছি। আমার জন্য কান্না করতে করতে আমার মায়ের চোখের দৃষ্টিশক্তি কমে গিয়েছিল।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, শ্রুতিলিখন : সৈয়দ নোমান, ময়মনসিংহ।