ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকেই শিক্ষা ছিল সমাজ গঠনের মৌলিক অনুষঙ্গ। নবী করিম (সা.)-এর প্রেরিত শিক্ষাব্যবস্থায় ‘ইলম’ (জ্ঞান) ছিল সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ বিষয়। কোরআনের প্রথম অবতীর্ণ আয়াতই ছিল ইকরা অর্থাৎ পড়ো। রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কায় দারুল আরকাম ও মদিনায় আসহাবে সুফফার মাধ্যমে সংগঠিতভাবে শিক্ষা বিস্তারের সূচনা করেন।
পরবর্তীকালে খুলাফায়ে রাশিদিন ও উমাইয়া, আব্বাসীয় যুগে বহু মাদরাসা, কুতুবখানা, গবেষণাকেন্দ্র গড়ে ওঠে—যেমন বায়তুল হিকমা। এখানকার পাঠক্রমে ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়াও গণিত, দর্শন, রসায়ন, চিকিৎসা, জ্যোতির্বিজ্ঞান ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত ছিল।
প্রাথমিক যুগ : কোরআনের প্রথম নির্দেশ ‘ইকরা’
ইসলামে শিক্ষার সূচনা হয় নবুয়তের সূচনাকাল থেকেই। আল্লাহ তাআলা যখন মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর ওহি অবতীর্ণ করেন, তখন প্রথম আয়াত ছিল—‘পড়ো তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা : আলাক, আয়াত : ১)
এই আয়াতে শিক্ষা ও জ্ঞানের গুরুত্ব সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। কোরআনে ‘ইলম’, ‘আক্ল’, ‘হিকমাহ’ ইত্যাদি শব্দ শতাধিকবার ব্যবহৃত হয়েছে, যা ইসলামে জ্ঞানের মাহাত্ম্য তুলে ধরে।
রাসুল (সা.)-এর যুগে শিক্ষা কার্যক্রম : ক. মক্কা পর্ব; প্রথম দারস (শিক্ষাকেন্দ্র) ছিল দারুল আরকাম, যেখানে সাহাবাদের গোপনে কোরআনের শিক্ষা দেওয়া হতো। এই সময়ে ইসলামী শিক্ষার মূল কেন্দ্র ছিল তাওহিদ, রিসালাত, আখিরাত ও নৈতিকতা।
খ. মদিনা পর্ব : মদিনায় হিজরতের পর ইসলামী শিক্ষার একটি সংগঠিত ভিত্তি গড়ে ওঠে। মসজিদে নববী হয়ে ওঠে জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র। আসহাবে সুফফা নামের একটি আবাসিক শিক্ষাগোষ্ঠী গড়ে ওঠে, যেখানে নবীজি নিজে শিক্ষা দিতেন। নারীদের শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে তিনি আলাদা সাপ্তাহিক দারস চালু করেন।
লিখিত রেকর্ডের গুরুত্ব : নবী (সা.) শিক্ষিত সাহাবাদের দিয়ে কোরআনের আয়াত লিখিয়ে রাখতেন।
তিনি বন্দি কাফিরদেরও মুক্তির বিনিময়ে মুসলিমদের লেখাপড়া শেখাতে বলেছিলেন, যা সে যুগের জন্য একটি বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গি।
খুলাফায়ে রাশেদার যুগ : চার খলিফার যুগে ইসলামী শিক্ষাকে প্রশাসনিক ও সম্প্রসারণমূলক কাঠামোয় রূপ দেওয়া হয়। মসজিদকেন্দ্রিক শিক্ষা অব্যাহত থাকে। ফিকহ, হাদিস ও তাফসির চর্চা ও সংকলনের সূচনা হয়। নবীজি ও সাহাবিদের আদর্শে গড়ে ওঠা শিক্ষাব্যবস্থা সামাজিক ন্যায়বিচার, জবাবদিহি ও ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখে।
উমাইয়া ও আব্বাসীয় যুগ : ইসলামী শিক্ষার স্বর্ণযুগ : ক. মাদরাসা ও জ্ঞানকেন্দ্র স্থাপন। এ সময় ইসলামী সভ্যতা বিস্তৃত হয় স্পেন থেকে চীন পর্যন্ত। স্থাপন হয় বিখ্যাত জ্ঞানকেন্দ্র বায়তুল হিকমা (House of Wisdom), যেখানে আরবি, গ্রিক, পারস্য ও ভারতীয় গ্রন্থ অনূদিত হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় বহু মাদরাসা, যেমন—নিজামিয়া মাদরাসা (Nizamiyya of Baghdad), যা আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বসূরি হিসেবে বিবেচিত।
শাস্ত্রানুগ ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সমন্বয় : ফিকহ, হাদিস, তাফসির, কালাম, তাসাউফের পাশাপাশি গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসা, রসায়ন পড়ানো হতো। বিখ্যাত মুসলিম পণ্ডিত যেমন—ইবনে সিনা (Avicenna), আল-খাওয়ারিজমি, আল-ফারাবি, ইবনে হায়সাম বিজ্ঞান ও দার্শনিক শিক্ষাকে বিকশিত করেন। শিক্ষার সেক্যুলার ও ধর্মীয় বিভাজন ছিল না। ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থায় ‘দ্বিন’ ও ‘দুনিয়া’কে আলাদা করা হতো না। চিকিৎসা, বিজ্ঞান, রাজনীতি—সবই ছিল ইবাদতের একটি অংশ, যদি তা মানবকল্যাণে ব্যবহৃত হতো।
ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিক রূপান্তরের পটভূমি
বিশ্বজুড়ে ঔপনিবেশিক শক্তির প্রভাব এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার আগ্রাসনে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা ধীরে ধীরে মূলস্রোত থেকে ছিটকে পড়ে। ঔপনিবেশিকরা ইসলামী জ্ঞান ও গবেষণাকে অপ্রাসঙ্গিক এবং ‘অপেশাদার’ হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করে। ফলে মাদরাসাগুলো দিনে দিনে কেবল ধর্মীয় জ্ঞানকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে এবং আধুনিক ও কর্মমুখী জ্ঞান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
অন্যদিকে, পাশ্চাত্য শিক্ষায় ধর্মহীনতা, বস্তুবাদ এবং মানবকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব বেড়ে চলে। এর ফলে মুসলিম সমাজে দুটি শিক্ষা ধারার মধ্যে একটি বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হয়—একটি আধুনিক ও কর্মমুখী, কিন্তু নৈতিক ও আধ্যাত্মিকতাহীন; অন্যটি নৈতিক ও ধর্মীয়, কিন্তু বাস্তব জীবন ও কর্মক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক।
আধুনিক রূপান্তরের প্রয়োজনীয়তা
১. শিক্ষা ও বাস্তব জীবনের সংযোগ : বর্তমানে বেশির ভাগ মাদরাসা শিক্ষার্থীরা মূলধারার পেশাগত ক্ষেত্রে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়, কারণ তাদের পাঠ্যক্রমে কর্মমুখী ও যুগোপযোগী বিষয় অনুপস্থিত। এটি একদিকে বেকারত্ব বাড়ায়, অন্যদিকে ইসলামী শিক্ষার প্রতি আগ্রহও কমিয়ে দেয়।
২. প্রযুক্তির প্রসার ও ইসলামিক শিক্ষা : বর্তমান যুগ তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর। অনলাইন কোর্স, ভার্চুয়াল লাইব্রেরি ও ডিজিটাল ক্লাসরুম এখন শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। ইসলামী শিক্ষাকে যদি এই আধুনিক প্ল্যাটফর্মে উপস্থাপন না করা হয়, তবে তা প্রাসঙ্গিকতা হারাবে।
৩. বিশ্বায়নের যুগে আন্তর্ধর্মীয় সংলাপ : আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলিমরা যখন ইসলামের মূল দর্শন ও মূল্যবোধ সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে, তখন তারা ইসলাম সম্পর্কে ভুল ব্যাখ্যা বা ভুল অনুশীলনে জড়িয়ে পড়ে। ফলে ইসলাম সম্পর্কে সঠিক ধারণা প্রতিষ্ঠায় আধুনিক ভাষা ও বিশ্লেষণ পদ্ধতির মাধ্যমে ইসলামী শিক্ষা উপস্থাপন জরুরি।
৪. ইসলামিক জ্ঞানে গবেষণার প্রয়োজনীয়তা : আধুনিক বিশ্বব্যবস্থা ক্রমেই নতুন নতুন সমস্যার জন্ম দিচ্ছে। যেমন—Bioethics, AI, Climate change, Banking ethics ইত্যাদি। এসব প্রশ্নে ইসলামের আলোকিত দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে হলে গবেষণানির্ভর ইসলামী চিন্তাবিদ দরকার।
ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিক রূপান্তরে সমস্যাবলি
১. পাঠ্যক্রমের বিভাজন : মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থায় এখনো অনেক ক্ষেত্রে উপনিবেশিক যুগের পাঠ্যক্রম চালু রয়েছে। সাধারণ ও মাদরাসা শিক্ষার মধ্যে সমন্বয়হীনতা শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করছে এবং একটি দ্বৈত শিক্ষা পদ্ধতির সৃষ্টি করছে।
২. প্রযুক্তির স্বল্প ব্যবহার : অনেক মাদরাসায় এখনো বিদ্যুৎ বা ইন্টারনেট সুবিধা নেই, আধুনিক শ্রেণিকক্ষ নেই, মাল্টিমিডিয়া ব্যবস্থার ব্যবহার নেই। এতে শিক্ষার্থীরা সময়োপযোগী দক্ষতা অর্জনে ব্যর্থ হয়।
৩. প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব : মাদরাসার শিক্ষকদের অনেকে ইসলামী বিষয়ে দক্ষ হলেও আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতি, শিক্ষাতত্ত্ব, শ্রেণিকক্ষ পরিচালনা, প্রযুক্তি ব্যবহার সম্পর্কে অজ্ঞ।
৪. চাকরির বাজারে অযোগ্যতা : অনেক ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা সরকারি বা বেসরকারি চাকরিতে আবেদন করতে পারে না, কারণ তারা জাতীয় বা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী স্বীকৃত নয়। ৫. গবেষণার অনগ্রসরতা : অনেক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা নেই বললেই চলে। যেগুলো আছে, সেগুলোও মূলত পুনরাবৃত্তিমূলক, তাত্ত্বিক এবং সমসাময়িক সমস্যার সঙ্গে সংযোগহীন।
আধুনিক রূপান্তরের ইতিবাচক দিক ও উদাহরণ
১. মালয়েশিয়া ও তুরস্কের ইসলামী
বিশ্ববিদ্যালয় : মালয়েশিয়ার International Islamic University Malaysia (IIUM) এবং তুরস্কের Istanbul Sabahattin Zaim Universit উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে আধুনিক বিজ্ঞান, ব্যবসা, আইন, মেডিক্যাল শিক্ষা ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করা হয়।
২. অনলাইন ইসলামিক শিক্ষা প্ল্যাটফর্ম : Bayyinah TV, Al-Madina Institute, Qalam Institute, Yaqeen Institute প্রভৃতি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ইসলামী জ্ঞানকে নতুনভাবে উপস্থাপন করছে। তরুণরা এই মাধ্যমে সহজেই ইসলামী শিক্ষায় যুক্ত হচ্ছে।
৩. পাঠ্যক্রমে সমন্বয়ের চেষ্টা : বাংলাদেশে দাখিল ও আলিম স্তরে বিজ্ঞান, তথ্য-প্রযুক্তি ও ইংরেজি অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে একটি যুগোপযোগী পাঠ্যক্রমের প্রাথমিক রূপ গড়ে উঠেছে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও রূপান্তরের দিকনির্দেশনা
১. দ্বৈত শিক্ষাব্যবস্থার অবসান : একটি সমন্বিত ইসলামিক কারিকুলাম গঠন করে, যেখানে কোরআন, হাদিস, ফিকহসহ বিজ্ঞান, গণিত, অর্থনীতি, দর্শন থাকবে।
২. ইসলামিক চিন্তায় গবেষণার অগ্রগতি :AI, Bioethics, Islamic Economics, Environmental Ethics ইত্যাদি বিষয়ে ইসলামী গবেষণাকে উৎসাহিত করতে হবে। ইসলামী চিন্তাবিদরা সমসাময়িক সমস্যার সঠিক জবাব দিতে পারবেন।
৩. শিক্ষক উন্নয়ন প্রশিক্ষণ : মাদরাসার শিক্ষকদের আধুনিক প্রশিক্ষণ, ICT স্কিল, পাঠদান কৌশল বিষয়ে নির্বিচারে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
৪. ফতোয়া, হালাল বিনিয়োগ, শরিয়া পরামর্শে পেশাগত চাহিদা তৈরি : বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ইসলামী স্কলারদের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। একাডেমিকভাবে দক্ষ ইসলামী শিক্ষার্থীরা এসব ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে পারেন।
সুপারিশ : ১. মাদরাসা ও সাধারণ শিক্ষার সমন্বয় সাধনে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ বাড়ানো। ২. ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রযুক্তিনির্ভর পাঠদান, গবেষণা ও আন্তর্জাতিক সংযোগ স্থাপন। ৩. আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে ইসলামী মূল্যবোধ সমন্বয়ে একাডেমিক রোডম্যাপ প্রণয়ন। ৪. জাতীয় পর্যায়ে ইসলামিক স্কলারদের নিয়ে গবেষণা তহবিল গঠন। ৫. ইসলামী শিক্ষাকে গ্লোবাল ভাষায় উপস্থাপন করতে ইংরেজি ও অনলাইন পোর্টাল প্রসার।
ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা একটি সুপ্রাচীন, মৌলিক ও মূল্যবোধভিত্তিক ব্যবস্থা। আধুনিক বিশ্বের চাহিদা অনুযায়ী এ ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী না করলে তা প্রাসঙ্গিকতা হারাবে এবং মুসলিম সমাজ নেতৃত্বহীন হয়ে পড়বে। তবে সমস্যা থাকা সত্ত্বেও রূপান্তরের জন্য সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত। প্রয়োজন সময়োপযোগী চিন্তাচেতনা, গবেষণাধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি এবং একটি ঐক্যবদ্ধ ও গ্লোবাল প্ল্যাটফর্ম—যেখানে ইসলামী শিক্ষা আবার সমাজের মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠবে।
লেখক : পিএইচডি গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রভাষক, রাজশাহী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ।
বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ