ইরানের রাজধানী তেহরানে আকাশপথে সর্বাত্মক হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। গতকাল স্থানীয় সময় ভোররাত ৩টার পর ‘চিরশত্রু’ ইসরায়েল ইরানে মুহুর্মুহু এ হামলা চালায়। ইরানের প্রতিশোধের ভয়ে দেশ ছেড়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। গতকাল রাতে পাল্টা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে ইরান। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের খবরে বলা হয়, দেশটির রাজধানী তেহরানে ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডের (আইআরজিসি) সদর দপ্তরে হামলার পর আগুন জ্বলতে দেখা গেছে মধ্য ইরানের নাতানজ পারমাণবিক স্থাপনায়। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ভেস্তে দিতে ইসরায়েল ইরানে ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ নাম দিয়ে হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। অবশ্য পারমাণবিক লক্ষ্যবস্তুর পাশাপাশি তেহরান এবং অন্যান্য শহরের আবাসিক এলাকায় ইসরায়েল হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিবিসি, আলজাজিরা, রয়টার্স ও ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম এ তথ্য জানিয়েছে। হামলার নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ।
ইরানের পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ইসরায়েলে : ইরানের সরকারি বার্তা সংস্থা জানিয়েছে, ইরানের পক্ষ থেকে ইসরায়েলকে জবাব দেওয়া শুরু হয়েছে। ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে কয়েক শ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে। আলজাজিরা জানিয়েছে, ইসরায়েলের ভূখণ্ড লক্ষ্য করে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের মধ্যেই দেশটির তেল আবিব শহরে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তরের পাশে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। ইসরায়েলের সংবাদমাধ্যম চ্যানেল ১৩ এই খবর জানিয়েছে।
ইসরায়েল হাওম নামের আরেকটি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, মধ্য ইসরায়েলের সাতটি জায়গায় ইরান থেকে উড়ে আসা রকেট পড়েছে।
ইসরায়েলের অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস জানিয়েছে, তেল আবিবের মেট্রোপলিটন এলাকার সাতটি জায়গায় হামলা হয়েছে। এরইমধ্যে মেট্রোপলিটন এলাকা থেকে আহত অন্তত পাঁচজনকে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। তাঁদের মধ্যে একজন বেশ খানিকটা আহত হয়েছেন। অপর চারজন হালকা আহত হয়েছেন।
ইসরায়েলের এ আকস্মিক হামলায় ইরানের সশস্ত্র বাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি, ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর প্রধান কমান্ডার মেজর জেনারেল হোসেইন সালামিসহ আরও বেশ কয়েকজন সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। নিহতের তালিকায় রয়েছেন কয়েকজন পরমাণু বিজ্ঞানীও। হামলায় সব মিলিয়ে ৭০ জন নিহত ও ৩ শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন।
ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন আইআরআইএনএন নিশ্চিত করেছে, ইসরায়েলি হামলায় সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল বাঘেরি নিহত হয়েছেন। পৃথক হামলায় আইআরজিসির প্রধান মেজর জেনারেল সালামিও নিহত হন। বাঘেরি ইরানের সর্বোচ্চ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন। ইসরায়েলের নজিরবিহীন হামলায় নিহত দ্বিতীয় উচ্চপদস্থ ব্যক্তি তিনি। এ ছাড়া ‘খাতাম আল-আনবিয়া’ সদর দপ্তরের কমান্ডার মেজর জেনারেল গোলাম আলী রশিদও একই হামলায় নিহত হয়েছেন। পরমাণু বিজ্ঞানী ও ইসলামিক আজাদ ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ-মেহদি তাহরাঞ্চি এবং পরমাণু বিজ্ঞানী ও ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থার সাবেক প্রধান ফেরাইদুন আব্বাসিও পৃথক হামলায় নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। প্রত্যক্ষদর্শী ও রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের সংবাদকর্মীরা জানান, তারা নিহতদের মধ্যে নারী ও শিশুর লাশ দেখতে পেয়েছেন।

ইরানের রাজধানী তেহরানে স্থানীয় সময় ভোর ৩টার দিকে আলজাজিরার সংবাদদাতারা বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পান। দেশটির রাজধানীতে ৬ থেকে ৯টি বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে। তারা ব্যক্তিগতভাবে কমপক্ষে দুটি বিস্ফোরণের কথা নিশ্চিত হয়েছেন। তবে এ বিস্ফোরণগুলো একটি নির্দিষ্ট স্থানে নয় বরং শহরের বিভিন্ন অংশে ঘটেছে। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বিস্ফোরণের বিভিন্ন স্থানের ফুটেজ দেখিয়েছে। স্পষ্টভাবে ঘটনাস্থল থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখা গেছে। আলজাজিরার সংবাদদাতা জানান, আমরা এখন পর্যন্ত রাজধানীর পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন অংশ, মহাল্লাতি ও শহরের উত্তর-পূর্ব অংশে হামলার খবর শুনেছি। এগুলো আবাসিক এলাকা হিসেবে পরিচিত এবং সামরিক কর্মকর্তা ও তাদের স্বজনরা এসব এলাকার বাসিন্দা। কিছু ফুটেজ থেকেও ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, ভবনগুলো সম্পূর্ণ আবাসিক। অন্যান্য বেসামরিক নাগরিকও এখানে থাকেন। ইরান জানিয়েছে, তাদের বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা যে কোনো কিছুর জন্য শতভাগ প্রস্তুত। গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বলে জানিয়েছে ইরান।
দেশ ছেড়েছেন নেতানিয়াহু : দেশ ছেড়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ইরানে ভয়াবহ হামলার জেরে প্রতিশোধের হুমকি দিয়েছে তেহরান। সেই ভয়ে নেতানিয়াহুকে অজ্ঞাত স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েলি গণমাধ্যম। ধারণা করা হচ্ছে, তাকে গ্রিসে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ইরনা নিউজ এ খবর দিয়েছে। এর আগে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম নেতানিয়াহুর উড়োজাহাজের একটি ছবি প্রকাশ করে। ছবিতে দুটি জঙ্গিবিমানের পাহারায় নেতানিয়াহুর উড়োজাহাজকে অজ্ঞাত গন্তব্যের দিকে যেতে দেখা গেছে। ইসরায়েলি টেলিভিশন চ্যানেল১২ জানিয়েছে, বিমানটি গ্রিসের রাজধানী এথেন্সে অবতরণ করেছে।
পাল্টা হামলা চালাতে ইসরায়েলে ১০০ ড্রোন পাঠাল ইরান : ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফি ডেফরিন বলেছেন, ‘পাল্টা হামলা চালাতে ইসরায়েলের দিকে প্রায় ১০০ ড্রোন পাঠিয়েছে ইরান। তবে তাদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সেগুলো প্রতিহত করতে কাজ করছে।’ গতকাল দুপুরে এপি ও বিবিসির প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। এফি ডেফরিন বলেন, গত রাতের হামলায় ইরানি সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ, ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসির কমান্ডার ও ইরানের জরুরি কমান্ডের কমান্ডার নিহত হয়েছেন। এর আগে ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমও জানিয়েছিল, রেভল্যুশনারি গার্ডের প্রধান হোসেইন সালামি নিহত হয়েছেন। এ হামলার পর ইসরায়েলে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। দেশটির দাবি, তেহরানকে পরমাণু অস্ত্র তৈরি থেকে বিরত রাখার জন্য এ হামলা চালানো হয়। ইরানের গণমাধ্যম ও প্রত্যক্ষদর্শীরা বেশ কয়েকটি স্থানে বিস্ফোরণের তথ্য দিয়েছেন, যার মধ্যে আছে তেহরানের মূল ইউরেনিয়াম পরিশোধন কেন্দ্র। তবে ইসরায়েলি হামলায় কী অস্ত্র ব্যবহার হয়েছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। ইতোমধ্যে তেহরানের প্রতিশোধমূলক পাল্টা হামলার প্রস্তুতিতে ইসরায়েলে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। সম্ভাব্য ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ঠেকাতে দেশটি প্রস্তুত। আগে রেকর্ড করে রাখা ভিডিওবার্তায় ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, ‘আমরা ইসরায়েলের ইতিহাসের ক্রান্তিলগ্নে এসে পৌঁছেছি।’ তিনি বলেন, ‘পরমাণু অস্ত্র তৈরিতে নিয়োজিত ইরানের বিজ্ঞানী, দেশটির ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি ও নাতানজ ইউরেনিয়াম পরিশোধনাগার লক্ষ্য করে এ সামরিক অভিযান শুরু হয়েছে। এ অভিযান বেশ কিছুদিন ধরে চলতে পারে বলে আভাস দেন নেতানিয়াহু।’ তিনি আরও বলেন, এ হামলা ইরানের পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণের মূল কেন্দ্র নাতানজ শহরে চালানো হয়েছে। তিনি বলেন, ইরানি বোমা তৈরির সঙ্গে জড়িত বিজ্ঞানীদেরও আমরা নিশানায় রেখেছি। যত দিন প্রয়োজন, তত দিন এ অভিযান অব্যাহত থাকবে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী জানিয়েছে, ২০০টির বেশি যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে ১০০টিরও বেশি লক্ষ্যবস্তুতে ৩৩০টিরও বেশি মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে।
ইরানে নতুন করে হামলা চালাল ইসরায়েল : ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর তাবরিজে একটি সামরিক বিমানবন্দরে নতুন করে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। স্থানীয় সময় গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টায় হামলাটি চালানো হয় বলে জানিয়েছে ইরানের আধা-সরকারি সংবাদ সংস্থা তাসনিম নিউজ এজেন্সি। সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেছে, তাবরিজের কাছাকাছি বিমানবন্দর এলাকা থেকে আকাশে ঘন ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠছে। নতুন এ হামলায় ইরানের দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চলীয় শহর শিরাজে অবস্থিত একটি ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণ কারখানা ধ্বংস হয়েছে বলে জানা গেছে। হামলায় অন্তত ৮ জন নিহত হয়েছেন।
আতঙ্কে ইসরায়েলে খাবার ও পানি মজুতের হিড়িক, আশ্রয় খুঁজছে বাংকারে : ইরানের সম্ভাব্য পাল্টা হামলার আশঙ্কায় জেরুজালেমসহ গোটা ইসরায়েলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। জেরুজালেমে বিভিন্ন সুপার মার্কেটের তাকগুলো দ্রুত খালি হয়ে যাচ্ছে। কারণ মানুষ খাবার ও পানি মজুত করতে শুরু করেছে। ভোররাতে স্থানীয় সময় আনুমানিক ৩টার দিকে (বাংলাদেশ সময় ১টা), দেশজুড়ে সাইরেন বেজে ওঠে এবং ফোনে সতর্কবার্তা পাঠানো হয়। সেখানে সবাইকে আশ্রয় কেন্দ্রের কাছে থাকতে বলা হয়েছে। ইসরায়েলের জরুরি পরিষেবা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা দেশজুড়ে রক্ত সংগ্রহ ও সরবরাহ কার্যক্রম চালু করছে। কিছু হাসপাতাল ইতোমধ্যে সুস্থ রোগীদের ছেড়ে দিচ্ছে, যাতে জরুরি পরিস্থিতিতে হাসপাতালগুলো প্রস্তুত থাকে। অন্যদিকে পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি শহরগুলোতে অনির্দিষ্টকালের জন্য লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। সবকিছুই ইরানি প্রতিশোধের প্রস্তুতি হিসেবে দেখা হচ্ছে। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, ইরান ১০০টি ড্রোন ইসরায়েলের দিকে পাঠিয়েছে বলে তারা ধারণা করছে। এ পরিস্থিতিতে গোটা অঞ্চলজুড়ে উদ্বেগ ও আতঙ্ক বিরাজ করছে এবং যুদ্ধ পরিস্থিতির আশঙ্কা ক্রমেই বাড়ছে। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী জানিয়েছে, তারা বর্তমানে ‘পূর্ণ যুদ্ধ প্রস্তুতি’ অবস্থায় রয়েছে। দেশজুড়ে সীমান্ত এলাকায় ব্যাপক সেনা মোতায়েন করা হয়েছে এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলো যে কোনো মুহূর্তে ইরান থেকে পাল্টা হামলার জবাব দিতে প্রস্তুত রয়েছে।
ইরানের পাল্টা হামলার আশঙ্কায় ইসরায়েলের বিভিন্ন শহরে এখন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বহু মানুষ স্বজনদের নিয়ে ছুটে যাচ্ছে আশ্রয় কেন্দ্রে। কেউ কেউ আবার নিজেদের ঘরের নিচে থাকা বাংকারে অবস্থান করছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্কিত শিশুদের ছবি এবং বাজারে জরুরি পণ্যের জন্য হুমড়ি খাওয়া মানুষের ভিডিও। আঞ্চলিক ভূরাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো একমাত্র দেশ হলো ইরান। দীর্ঘদিন ধরেই ইরান ইসরায়েলি দমনপীড়ন ও নৃশংসতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, যা পশ্চিমা বিশ্বের বহু রাষ্ট্রের অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পশ্চিমারা বরাবরই ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে উদ্বিগ্ন। তবে ইরান বারবার বলছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে। তারা কোনো পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে না এবং এমন পরিকল্পনাও তাদের নেই। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ইরানের অধিকার রয়েছে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার তত্ত্বাবধানে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করার। এমনকি তাদের মনে হলে, আত্মরক্ষার প্রয়োজনে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের অধিকার তাদের থাকা উচিত এমন আলোচনা এখন অনেক ইরানি বিশ্লেষকই তুলে ধরছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ইরানকে পশ্চিমারা প্রায় প্রতিনিয়ত অভিযুক্ত করছে। ইরানকে এক ধরনের স্থায়ী আসামির আসনে বসানো হয়েছে। প্রতিটি পদক্ষেপেই তাদের দায়ী করা হচ্ছে, যার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।
জাতিসংঘ : জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস ‘সর্বোচ্চ সংযম’ প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে কোনো ধরনের সামরিক উত্তেজনা তিনি সমর্থন করেন না। বিশেষভাবে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েলের হামলা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তিনি।
বাংলাদেশ : ইরানে ইসরায়েলের সামরিক হামলার নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ। গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, এ হামলা জাতিসংঘ সনদ, আন্তর্জাতিক আইন এবং ইরানের সার্বভৌমত্বের চরম লঙ্ঘন। এর মাধ্যমে আঞ্চলিক ও বিশ্বশান্তির ওপর ঝুঁকি তৈরি হয়েছে এবং নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এর প্রভাব হতে পারে সুদূরপ্রসারী। বাংলাদেশ এ ঘটনায় সব পক্ষকে সংযত থাকার এবং উত্তেজনা বাড়ায়-এমন যেকোনো কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানায়। পাশাপাশি, কূটনৈতিক উপায়ে মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় ভূমিকা প্রত্যাশা করে বাংলাদেশ।
চীন : চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, তারা এ ঘটনার ‘গভীর পরিণতি’ নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং পরিস্থিতির ওপর নিবিড়ভাবে নজর রাখছে। মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান বলেন, সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে উত্তেজনা বৃদ্ধির পথ পরিহার করতে হবে। চীন জানিয়েছে, তারা সংকট নিরসনে গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে প্রস্তুত।
তুরস্ক : তুরস্ক ইসরায়েলের হামলাকে ‘আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন ও কূটনৈতিক পথকে অস্বীকার’ বলে অভিহিত করেছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, এ ধরনের হামলা প্রমাণ করে, ইসরায়েল শান্তিপূর্ণ সমাধান চায় না।
ওমান : পারমাণবিক আলোচনায় মধ্যস্থতাকারী দেশ ওমান এ হামলাকে ‘বিপজ্জনক ও বেপরোয়া উত্তেজনা’ বলে অভিহিত করেছে। ‘ইসরায়েল অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলছে,’ বলা হয়েছে ওমানের বিবৃতিতে।
যুক্তরাষ্ট্র : যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেছেন, ইসরায়েল আত্মরক্ষার স্বার্থে একতরফাভাবে পদক্ষেপ নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এ হামলায় জড়িত নয়। তবে তিনি ইরানকে হুঁশিয়ার করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সেনা বা স্বার্থকে লক্ষ্যবস্তু বানালে ফল ভালো হবে না। এদিকে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ইরান পারমাণবিক চুক্তিতে না এলে ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করবে।
যুক্তরাজ্য : ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা এখন অগ্রাধিকার। উত্তেজনা প্রশমন জরুরি।
ফ্রান্স : ফ্রান্স সব পক্ষকে ‘উত্তেজনা না বাড়ানোর আহ্বান’ জানিয়েছে, যদিও ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারকে সমর্থন করেছে। ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।’
সৌদি আরব : সৌদি আরব এ হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেছে, এ বর্বর আক্রমণ ইরানের সার্বভৌমত্ব ও আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। তারা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছে।
কাতার : কাতার হামলাকে ‘ভয়াবহ উসকানি’ এবং আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন বলে আখ্যা দিয়েছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জরুরি ভিত্তিতে হস্তক্ষেপ করতে হবে।
অস্ট্রেলিয়া : পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেনি ওং বলেন, এ সংঘর্ষ মধ্যপ্রাচ্যকে আরও অস্থির করে তুলছে। আমরা সংলাপ ও কূটনৈতিক সমাধানকে উৎসাহ দিচ্ছি।
নিউজিল্যান্ড : প্রধানমন্ত্রী ক্রিস্টোফার লাকসন ইসরায়েলের হামলাকে ‘অপ্রত্যাশিত ও অপ্রয়োজনীয় উসকানি’ বলেছেন।
জাপান : পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাকেশি ইওয়াইয়া বলেন, আলোচনার সময় এমন সামরিক হামলা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলবে।
এখনই চুক্তি করুন নইলে বড় হামলা-ইরানের প্রতি ট্রাম্প : ইরানে ইসরায়েলের ব্যাপক হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তেহরানকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন এবং পারমাণবিক কার্যক্রম নিয়ে অবিলম্বে চুক্তিতে পৌঁছানোর আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি সরাসরি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, এখনই চুক্তি করতে হবে, না হলে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।
বিশ্বজুড়ে দূতাবাস বন্ধ করে দিচ্ছে ইসরায়েল : ইরানে হামলার পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ইসরায়েল বিশ্বব্যাপী তার সব কূটনৈতিক মিশন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে অবস্থিত ইসরায়েলি দূতাবাস এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছে।
বন্ধ তিন দেশের আকাশসীমা : হামলার পরই ইরান ছাড়াও আকাশসীমা বন্ধ করেছে প্রতিবেশী দেশ ইরাক এবং জর্ডান। এসব দেশের আকাশপথ ব্যবহার করে গন্তব্যে যেতে পারছে না কোনো উড়োজাহাজ। ফলে বিশ্বজুড়ে বহু ফ্লাইট ব্যাহত হচ্ছে। শুক্রবার রাত পর্যন্ত ইউরোপের দেশগুলো থেকে আসা এবং ইউরোপ অভিমুখী প্রায় ১ হাজার ৮০০ ফ্লাইট ব্যাহত হয়েছে। এর মধ্যে ৬৫০টি ফ্লাইট বাতিল হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে ইউরোকন্ট্রোল।