জাপানের দক্ষিণের একদম শেষ প্রান্তে প্রশান্ত মহাসাগরের বুক চিরে ছড়িয়ে আছে টোকারা দ্বীপপুঞ্জ। গুনে গুনে বারোটি দ্বীপ, তার মধ্যে মাত্র সাতটিতে মানুষের বসবাস। জনসংখ্যা মাত্র সাতশোর মতো। দ্বীপগুলো এতই দূরে যে, বেশিরভাগ দ্বীপে নেই কোনো হাসপাতাল। এমনকি নিকটতম চিকিৎসাকেন্দ্রও ছয় ঘণ্টার নৌপথ দূরের কাগোশিমা শহরে।
এই শান্ত দ্বীপপুঞ্জ এখন আর শান্ত নেই। গত দুই সপ্তাহে একটার পর একটা ভূমিকম্পে কেঁপে উঠছে এই জনমানবশূন্য প্রাকৃতিক শৌর্যবর্ধিত অঞ্চল। ২১ জুন থেকে শুরু; এই কয়েক দিনে নয়শ’র বেশি ছোট-বড় কম্পন ধরা পড়েছে টোকারার উপকূলবর্তী সাগরে। বুধবার আঘাত হানে একটি ৫.৫ মাত্রার ভূমিকম্প, যেন চলমান উদ্বেগের ওপর আরও একটি ছুরি চালানো।
আকুসেকিজিমা দ্বীপের ৫৪ বছর বয়সী চিজুকো আরিকাওয়া রাতে ঘুমোতে পারেন না। ঘরের জানালা দিয়ে সমুদ্রের ঢেউ দেখেন কিন্তু সেই ঢেউয়ের শব্দের ফাঁকে ফাঁকে শোনেন এক অদ্ভুত গর্জন; যেন সাগরের তলা থেকে কেউ উঠে আসছে। ‘রাতে ভূমিকম্পের আগে একটা অদ্ভুত শব্দ শোনা যায়, গম্ভীর গর্জনের মতো। খুবই ভয়ানক’ জানালেন চিজুকো। তিনি বলেন, ‘একটা সময় ছিল যখন এই দ্বীপের নির্জনতা ভালো লাগত। এখন সেটা আতঙ্কে পরিণত হয়েছে।’
দ্বীপবাসীর জীবন এমনিতেই কষ্টসাধ্য। অনেকের পেশা কৃষিকাজ বা পশুপালন। চিজুকো আর তার স্বামী গবাদি পশু পালন করেন। কিন্তু মাটিই যখন নড়বড়ে, তখন সে কাজও আর আগের মতো চলে না।
ইসামু সাকামোতো, স্থানীয় বাসিন্দাদের নেতৃস্থানীয় একজন। তিনি বললেন, প্রথমে মাটির নিচ থেকে একটা ধাক্কা লাগে, তারপর পুরো ঘর দুলে ওঠে। মনে হয় পেটের ভেতর সব ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। তিনি এখন নিজের শরীরে সবসময় একটা দুলুনি অনুভব করেন, এমনকি ভূমিকম্প না হলেও। এই 'ফ্যান্টম শক' এখন অনেক বাসিন্দার সঙ্গী।
টোকারা দ্বীপে এর আগেও ভূকম্পন হয়েছে, কিন্তু এইবারের মতো একটানা আর এত ঘন ঘন না। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, এমন প্রবল ভূকম্পনের নজির সাম্প্রতিক কালে নেই। কাগোশিমার আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে, এখনো সুনামির আশঙ্কা নেই, তবে বাসিন্দাদের যেকোনো সময় দ্রুত সরে যাওয়ার প্রস্তুতি রাখতে বলা হয়েছে।
ভূমিকম্পের আশঙ্কায় আতঙ্কিত স্থানীয় প্রশাসনও। তারা বলছে, আবাসিক হোটেলগুলো আপাতত পর্যটকদের বুকিং বাতিল করেছে। এসব হোটেলকে আপদকালীন সময়ের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের চিন্তা করা হচ্ছে। তবে পর্যটকদের এই ভূমিকম্প আতঙ্ক আরও বড় করে তুলেছে এক আজব গুজব।
একটি পুরনো মাঙ্গা কমিকস থেকে জন্ম এই গুজবের। শিল্পী রিও তাতসুকি তার ১৯৯৯ সালের বইয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ২০২৫ সালের ৫ জুলাই জাপানে ঘটবে এক ‘বিগ ওয়ান’; এক ভয়াবহ ভূমিকম্প, যা দেশের অনেক অংশ ধ্বংস করে দেবে। বইটির নতুন সংস্করণ ২০২১ সালে প্রকাশিত হবার পর থেকে গুজবের ডালপালা মেলেছে। অনেকেই এই তারিখ ঘিরে আতঙ্কিত, সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে নানা মিথ, অনেকে এমনকি ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করেছেন।
তবে ভূমিকম্প যে শুধুই গুজবের বিষয় না, তা জাপান খুব ভালোভাবেই জানে। ২০১১ সালের ৯ মাত্রার ভূমিকম্প আর তার পরবর্তী সুনামিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন ১৮ হাজার মানুষ। সেই দুঃসহ স্মৃতি এখনো তাজা। সরকার তাই অনেক দিন ধরেই আশঙ্কা করে আসছে ‘দ্য বিগ ওয়ান’ আসবেই; হয়তো আজ না, কিন্তু কাল। এবং সেই দিন জাপানে মৃত্যু হতে পারে তিন লাখের বেশি মানুষের।
এ কারণে সম্প্রতি সরকারের পক্ষ থেকে জরুরি অবকাঠামো নির্মাণ, সাগর বাঁধ, উঁচু আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ ইত্যাদি উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে তারা এটাও স্বীকার করছে; এখনো অনেক কিছু বাকি।
এদিকে টোকারায় ঘড়ির কাঁটার মতো কম্পন চলছে। কেউ জানে না পরের ভূমিকম্পটা কত বড় হবে, কখন আসবে, আসবে কোথা থেকে। শুধু জানে; রাত নামলেই ঘুম আসবে না। ছোট্ট এই দ্বীপে এখন কেউ আর নিঃশব্দে থাকতে চায় না।
সূত্র: বিবিসি
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল