ভাবমূর্তি সংকটে দেশে দেশে মার্কিন পণ্য বয়কটের হিড়িক পড়েছে। বিশ্বজুড়ে দীর্ঘ দিন ধরে আমেরিকার সাংস্কৃতিক প্রভাব ব্যবসা সম্প্রসারণে দেশটির কোম্পানিগুলোকে বড় ধরনের সহায়তা করেছে। এর একটি উদাহরণ এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, সেটি হচ্ছে- বার্লিন ওয়াল ভাঙার পর কোকা-কোলার লোগো খচিত লরিতে করে বিনামূল্যে পানীয় বিতরণ সেই সময়ের প্রতীকী ঘটনা হয়ে ওঠে। পূর্ব বার্লিনে হাজার হাজার মানুষ কোকা-কোলার বোতল হাতে নিয়ে মার্কিন পুঁজিবাদের স্বাদ গ্রহণ করে। এরই ধারাবাহিকতায় ওই অঞ্চলে কোকা-কোলার বিক্রিও দ্রুত বাড়ে।
তবে এখন সেই ‘আমেরিকানা’ বিদেশে বিক্রি করা ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে। গত মাসে ডেনমার্কে কোকা-কোলা বয়কট শুরু হয়। দেশটির স্থানীয় বিকল্প ‘জলি কোলা’র প্রতি ঝুঁকছে অনেকেই। কোকা-কোলার এই সংকটের পেছনে কারণ হিসেবে উঠে এসেছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কর্মকাণ্ড। গ্রিনল্যান্ড নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী বক্তব্য, অগোছালো বাণিজ্যনীতি ও ‘সম্প্রসারণবাদী’ মনোভাব বিশ্বের অনেক দেশেই আমেরিকার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব বাড়িয়েছে।
নিরা ডেটা নামের একটি গবেষণা সংস্থা ‘অ্যালায়েন্স অব ডেমোক্রেসিস’-এর জন্য পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বের ১০০টি দেশে এক লাখের বেশি মানুষের মধ্যে আমেরিকার প্রতি বিরূপ মতামতের হার ইতিবাচক মতামতের তুলনায় ৫ পয়েন্ট বেশি, যা আগের বছরের তুলনায় স্পষ্ট অবনতি এবং চীনের চেয়েও পিছিয়ে পড়া এক ধরনের অবস্থান।
মার্কিন ব্র্যান্ড বয়কটের হিড়িক
এই নেতিবাচক মনোভাব এরই মধ্যে আমেরিকান কোম্পানিগুলোর বৈদেশিক বিক্রয়ে প্রভাব ফেলছে। কানাডায় ক্ষোভ সবচেয়ে তীব্র— বিশেষ করে ট্রাম্প দেশটিকে ‘যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম রাজ্য’ বানাতে চাওয়ার পর থেকে। এক জরিপে দেখা গেছে, ৬১ শতাংশ কানাডীয় নাগরিক আমেরিকান পণ্য বর্জন করছেন।
অন্টারিও ও কুইবেক প্রদেশে সরকার-চালিত মদের দোকান থেকে আমেরিকান ব্র্যান্ডের অ্যালকোহল সরিয়ে ফেলা হয়েছে, যার ফলে জ্যাক ড্যানিয়েলস-এর মতো ব্র্যান্ডগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কানাডার বাজারে টিকে থাকতে ক্রাফট হেইঞ্জ কোম্পানি জানাচ্ছে, তাদের পণ্যের বড় অংশই স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত।
ডেনমার্কেও দেখা যাচ্ছে একই প্রবণতা। দেশটির সবচেয়ে বড় খুচরা বিক্রেতা ‘স্যাইলিং গ্রুপ’ দোকানে ইউরোপীয় মালিকানাধীন ব্র্যান্ডগুলো আলাদাভাবে চিহ্নিত করছে, যাতে গ্রাহকরা আমেরিকান পণ্য এড়িয়ে চলতে পারেন।
এমন পরিস্থিতি ইউরোপের অন্যান্য অংশেও প্রতিফলিত হচ্ছে। সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো উদাহরণ ইলন মাস্কের গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলা। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে ইউরোপে টেসলার গাড়ি নিবন্ধন ৪০ শতাংশের বেশি কমেছে।
ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ১০০-পয়েন্ট স্কেলে আমেরিকান পণ্য এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা ছিল ৮০ পয়েন্ট, যেখানে বেশিরভাগই ‘রুচিগত কারণে’ এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, শুধু দাম নয়।
কোম্পানিগুলোর উদ্বেগ
এই প্রবণতা আমেরিকার জন্য উদ্বেগের কারণ। আমেরিকান কোম্পানিগুলোর বৈদেশিক বিক্রয় আয় বছরে আট ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি। যদিও সব কোম্পানি একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
‘মর্নিং কনসাল্ট’-এর বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রযুক্তি, গাড়ি এবং খাদ্য-সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর প্রতি জনমত বেশি সংবেদনশীল। কিন্তু হসপিটালিটি, লজিস্টিকস বা স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে তা তুলনামূলক কম। অর্থাৎ, কেউ হয়তো প্রতিবাদস্বরূপ চিটোস বাদ দেবে, কিন্তু ফাইজারের ক্যান্সারের চিকিৎসা না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেবে না। গুগল বা ইনস্টাগ্রামের মতো সেবারও বিকল্প নেই বললে চলে।
তবু আমেরিকান কোম্পানিগুলোকে নতুন বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে—তাদের যে জাতীয় পরিচয় একসময় ছিল মূল শক্তি, সেটিই এখন অনেক জায়গায় দুর্বলতা হয়ে উঠছে। সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট
বিডি প্রতিদিন/একেএ