বাংলাদেশের বেশিরভাগ রোগী ডাক্তারদের বিশ্বাস করেন না। আস্থা ও ভরসাও করেন না। কথাটা শুনতে যতই খারাপ লাগুক না কেন বাস্তবতা হলো এটাই। দীর্ঘ সাড়ে তিন দশকের ডাক্তারি জীবনের অভিজ্ঞতার নির্যাস এটা।
যখন সেই নব্বই দশকের শুরুতে চিকিৎসা জীবন শুরু করেছিলোম তখন মন ছিল পবিত্র, মানুষের জন্য জান উজাড় করে (২৬ লাখ তত্বের জনকের মত উজাড় করা নয় নিশ্চয়!) দেবার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
এখনো মনে আছে- ১৯৯০ সালে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে ভোরবেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে একজন যুবক প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়ে কাতরাচ্ছে। সঙ্গে আত্মীয়স্বজন কেউ নেই। শুধু একজন সহকর্মী। রোগীর রক্তচাপ কমে এসেছে, অক্সিজেনের মাত্রা নিম্নমুখী। তাঁর ভয়ার্ত আর্তনাদ-স্যার আমাকে বাঁচান! (যদিও আমি স্যার জাতীয় কেউ নই!)। আমি সামান্য ইন্টার্ন চিকিৎসক । আড়াই হাজার টাকা ভাতার দরিদ্র ইন্টার্ন।
সহকর্মীকে বললাম একটা ভলিউম এক্সপ্যান্ডার (এক প্রকার স্যালাইন) পুশ করতে। সারারাত জাগা কর্মক্লান্ত দৌড়ে গেলাম ব্লাড ব্যাংকে। রোগীর সাথে নিজের রক্তের গ্রুপ মিলে গেল। দ্রুত রক্ত দান করলাম। সে যাত্রায় রোগীটি বেঁচে গিয়েছিলেন। আমার বিশ্বাস মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে দিনরাত পরিশ্রম করা শতশত ইন্টার্ন চিকিৎসক আজও জীবন বাজি রেখে কাজ করে চলেছেন। অসহায় আর্তমানবতার সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন।
তারপর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলো। বিসিএস ক্যাডারে দীর্ঘদিন চাকরি করতে গিয়ে কত তিক্ত অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হলো। সরকারি অফিসে ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ হয়নি। দলবাজি করিনি বলে সরকারি কোনও আনুকূল্য পাইনি। যখন দেখলাম যে, দুর্নীতি দলাদলি আর প্রশাসনিক নির্যাতন সহ্য সীমা অতিক্রম করেছে তখন সাধের বিসিএস ক্যাডার এর চাকরি ছেড়ে দিলাম।
যেহেতু চিকিৎসা পেশাকে ভালোবেসেছি, রোগীর প্রতি অমানবিক হইনি, তাই জীবনে টিকে থাকার লড়াই এ কখনো ভীত হইনি। তবে এই দীর্ঘ সময়ে শত সহস্র মানুষের সান্নিধ্য ও ভালোবাসা পেয়েছি। মানুষের বিচিত্র অনুভূতি, চরিত্র এবং আস্থাহীনতা প্রত্যক্ষ করেছি। দেশের স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নানান চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজকের এই অবস্থানে পৌঁছাতে পেরেছি।
সেই ২০০০ সালেও এদেশের মানুষ সামান্য একটা এনজিওগ্রাম করার জন্য কলকাতা দিল্লি ব্যাংকক করেছে। আর আজকে হৃদরোগের প্রায় সমস্ত চিকিৎসাই আমরা দেশে বসে নিতে পারছি। বাইপাস বা ওপেন হার্ট সার্জারি আজকে নব্বই দশকের অ্যাপেনডিক্স অপারেশনের মত সহজ ও সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
তাই বলে কি মানুষের বিদেশযাত্রা বন্ধ হয়েছে? না তা বলা যাবে না । কিছু মানুষের হাতে অনেক কাঁচা টাকার সমাহার ঘটেছে। তারা প্রয়োজনে এবং অপ্রয়োজনে দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। সেই অধিকার সবারই রয়েছে। কিন্তু জরুরি চিকিৎসা তো আপনাকে এখানেই নিতে হবে। নইলে ক্ষতিটা আপনার হবে, আপনার পরিবারের হবে। এরকম একটা ঘটনার কথা আজকে আপনাদেরকে বলবো।
গতকাল (১ মে) ছিল বিশ্ব শ্রমিক দিবস। মে দিবস। সব অফিস আদালত বন্ধ। কিন্তু শরীরের কার্যক্রম তো বন্ধ থাকে না। তাই ছুটির দিনেও আমাদেরকে হাসপাতালে যেতে হয়। ভর্তি করা রোগীর সেবা দিতে হয়। জরুরি রোগীদের জরুরি সেবা দিতে হয়। সব কাজ শেষ করে বাসায় চলে আসবো এই সময় পঞ্চাশ বছরের এক ভদ্রলোক চেম্বারে ঢুকলেন। আমার এক পুরাতন রোগীর রেফারেন্স নিয়ে এসেছেন।
চেহারার দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলাম যে, তিনি অসুস্থ বোধ করছেন। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। চোখে মুখে অস্বস্তি। আগের রাত থেকে বুকে ব্যথা শুরু। প্রথমে গ্যাস্ট্রিক মনে করে ওষুধ খেয়েছেন। কিন্তু কোনও ফল হয়নি। ঘেমে যাচ্ছিলেন। উপায় না পেয়ে প্রথমে সরকারি জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে গেলে চিকিৎসক ইসিজি করে দেখেন যে হার্ট অ্যাটাক। দ্রুত ভর্তি হতে বললেন। সেখানে সাধ্যের বাইরে বহু রোগী ভর্তি থাকেন প্রতিদিন। পরিবেশ নোংরা। তাই তিনি ভর্তি না হয়ে হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালে গেলেন।
সেখানকার চিকিৎসক একই কথা বলায় তিনি চলে গেলেন ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে। সেখানেও একই কথা। ডাক্তারের কথায় তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। তার হয়েছে গ্যাস, অথচ ডাক্তার বলছেন হার্ট অ্যাটাক! এদেশের ডাক্তাররা কসাই । গ্যাসকে বলে হার্ট অ্যাটাক! অতএব বাড়ি চলো!
রাত কেটে দিন এলো। কিন্তু তার গ্যাস ভালো হয় না। শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। আশেপাশের পরিচিত মানুষদের সাথে যোগাযোগ করেন। তাদের মধ্যেই একজন ছিলেন আমার পুরনো রোগী। অবশেষে তার পরামর্শে আমার কাছে আসা।
-আপনি কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে তিনটি হাসপাতাল ভিজিট করেছেন। সবাই বলেছেন আপনার হার্ট অ্যাটাক। আপনার উপসর্গ, ইসিজি পরিষ্কার বলে দিচ্ছে আপনার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।
হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ জীবন বিপন্নকারী রোগ। হার্টের রক্তনালী বন্ধ হয়ে মাংসপেশির রক্ত চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে হার্ট ড্যামেজ করে। এই ক্ষতি সারা জীবনের জন্য। দ্রুত বন্ধ হয়ে যাওয়া রক্তনালী খুলে দিতে না পারলে জীবন বিপন্ন হতে পারে এবং ধীরে ধীরে হার্টের পাম্পিং ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকবে। এখনই ভর্তি হয়ে যান।
- আমাকে ওষুধ লিখে দিন। আমি ব্যাংককে গিয়ে চিকিৎসা নিবো। আমার ডাক্তার আছে।
- সে আপনি যাবেন। কিন্তু জরুরি চিকিৎসাটা এখনই নিতে হবে। নইলে আপনার ক্ষতি হয়ে যাবে।
- না, আপনি ওষুধ লিখে দিন। বাংলাদেশের হাসপাতালে আমি ভর্তি হবো না।
এরপর আমার আর বলার কিছু থাকে না। যতটুকু সম্ভব চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দিলাম। আজকে সকালে আমার পুরোনো রোগী মেসেজ দিয়ে জানালেন- “আপনার গতকালের রোগী ভোর রাতে অনন্তলোকে যাত্রা করেছেন! “
লেখক : সিনিয়র কার্ডিওলজিস্ট ও সিসিইউ ইনচার্জ, ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হসপিটাল, ধানমণ্ডি, ঢাকা।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ