টানা তিন বছরের সংকট কাটিয়ে ডলারের বাজারে এখন স্বস্তির হাওয়া বইছে। স্থিতিশীল রেমিট্যান্স প্রবাহ ও রপ্তানি আয়ের জোয়ারে টাকার বিপরীতে ডলার কিছুটা দুর্বল হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে গত দেড় মাসে এক বিলিয়ন ডলার কিনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি ১৩ জুলাই থেকে গতকাল পর্যন্ত ১০ দফা নিলামে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি সংগ্রহ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অতীতে জ্বালানি, সার ও খাদ্য আমদানির বিল মেটাতে রিজার্ভ থেকে ২৫ বিলিয়নের বেশি ডলার বিক্রি করতে হয়েছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি উল্টো। টাকার দ্রুত অবমূল্যায়ন ঠেকাতে এবং বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার কিনে তার মজুত বাড়াচ্ছে।
গত বছরের আগস্টে ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বৈদেশিক মুদ্রা সংকট কাটাতে বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু করা হয়। এর পাশাপাশি নেওয়া হয় আরও কিছু উদ্যোগ। এতে ধীরে ধীরে সংকট কেটে যায়, রিজার্ভ বাড়তে শুরু করে এবং ডলারের দরও কমে আসে। আইএমএফ কর্মসূচির শর্ত পূরণে বাজারভিত্তিক বিনিময় হার কার্যকর করার পর ব্যাংকগুলো নিজেদের মধ্যে নিয়মিত ডলার লেনদেন করছে। এতে প্রবাসী আয়ের ডলার কেনায় তারা অনেকটা সতর্ক হয়েছে, ব্যবসায়ীরাও আগের তুলনায় কিছুটা কম দামে ডলার পাচ্ছেন। উদ্বৃত্ত ডলার নিলামের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক কিনে নিচ্ছে। গতকাল ডলারের সর্বোচ্চ দাম ছিল ১২১ দশমিক ৭৮ টাকা ও সর্বনিম্ন ১২১ দশমিক ৬৬ টাকা। ডলারের গড় দাম ছিল ১২১ দশমিক ৭২ টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, গত বুধবার পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩১ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলারে। এক বছরে রিজার্ভ বেড়েছে প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া গত বুধবার রেমিট্যান্স এসেছে ১৪৫ মিলিয়ন ডলার। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি প্রবাহ বাড়ায় এই উন্নতি সম্ভব হয়েছে। তবে এখনো পুরোপুরি মুক্ত হয়নি আমদানি। ডলার সংকটের সময় যেসব পণ্যে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছিল, সেগুলোর বড় অংশই বহাল আছে। গাড়ি, ইলেকট্রনিকস, স্বর্ণ, বিলাসপণ্য, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ও পানীয়সহ নানা আমদানিতে এখন ভোগান্তিতে পড়ছেন ব্যবসায়ীরা।
এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে মোট ৬১ বিলিয়ন বা ৬ হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে, যা এর আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চেয়ে ৭ শতাংশ কম। আগের অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ৬ হাজার ৫১৪ কোটি ডলারের পণ্য। আমদানি কমার তালিকায় রয়েছে সিমেন্টের কাঁচামাল ক্লিংকার, সয়াবিন তেল, প্রাণী খাদ্য তৈরির কাঁচামাল সয়াবিন বীজ। লোহার কাঁচামালের দ্বিতীয় প্রধান উৎস পুরোনো জাহাজের আমদানিও কমেছে। এ ছাড়া আমদানি কমার তালিকায় রয়েছে ডিজেল, অপরিশোধিত জ্বালানি তেল, ইউরিয়া সার, গম, পণ্য পরিবহনের জাহাজ ইত্যাদি। বাংলাদেশের বৃহত্তম বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ডলার সংকট যখন ছিল তখন আমরা বেশ বিপাকেই ছিলাম। এখন রিজার্ভ বাড়ায় সেই দুশ্চিন্তা আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে। তবে বন্দরে আমদানি করা পণ্যের ওপর পোর্ট ডেমারেজের অর্থ আগের চেয়ে ১০ গুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। সেটা এক মাসের জন্য স্থগিত। সেটা বাড়বে। এতে আমরা সংকটে পড়ব।’ ইলেকট্রনিক্স পণ্য আমদানিকারক লুৎফর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ডলার পাওয়া গেলেও ব্যবসার খরচ এত বেড়েছে যে টিকে থাকাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ডলারের দাম আরও কমলে আমরা স্বস্তি পাই।’ ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, অর্থনীতিতে গতি ফেরাতে হলে আমদানি বাড়ানোর বিকল্প নেই। তাদের মতে, সব ধরনের বিধিনিষেধ তুলে দিলে দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের কাছে ইতিবাচক বার্তা যাবে। এতে ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগ ও সম্প্রসারণে আগ্রহী হবেন, যা অর্থনীতিকে চাঙা করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।