ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্যকে (২৫) হত্যার ঘটনায় জড়িত তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে শাহবাগ থানা পুলিশ। গ্রেপ্তাররা হলো- তামিম হাওলাদার (৩০), সম্রাট মল্লিক (২৮) এবং পলাশ সরদার (৩০)। তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রেপ্তাররা পেশায় হকার। তবে রাতে ছিনতাইসহ নানা অপরাধে লিপ্ত। জানা যায়, নিহত সাম্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি স্যার এ এফ রহমান হল ছাত্রদলের সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক পদেও দায়িত্ব পালন করছিলেন।
গত মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভিতর দিয়ে মোটরসাইকেল চালিয়ে আসার সময় সাম্যর মোটরসাইকেলের সঙ্গে তাদের মোটরসাইকেলের ধাক্কা লাগে। শুরু হয় তর্কাতর্কি। মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা পলাশ একপর্যায়ে তার সঙ্গে থাকা ছুরি দিয়ে আঘাত করতে থাকে সাম্যকে। দুর্বৃত্তদের কাছ থেকে বন্ধুকে রক্ষায় এগিয়ে আসে বায়েজিদ ও সামী। তারা তাদের ওপরও চড়াও হয়। গুরুতর অবস্থায় রাত ১২টার দিকে সাম্যকে তার বন্ধুরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। পরে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় পলাশ, তামিম এবং সম্রাটকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ ঘটনায় গতকাল সকালে নিহতের মেজো ভাই শফিকুল ইসলাম সৈকত বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় মামলা করেছেন। গ্রেপ্তার মো. তামিম হাওলাদার মাদারীপুর সদরের এরশাদ হাওলাদারের ছেলে, কালাম সরদারের ছেলে পলাশ সরদার (৩০) ও ডাসার থানার যতীন্দ্রনাথ মল্লিকের ছেলে সম্রাট মল্লিক (২৮)। সম্প্রতি পলাশ সরদার মাদারীপুর থেকে ঢাকায় এসে তামিমের বাসায় উঠেছে। পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার মাসুদ আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গ্রেপ্তাররা দিনে হকারি করলেও রাতে নিয়মিত নেশা করে। গ্রেপ্তাররা অসুস্থ থাকায় (গতকাল) তাদের রিমান্ড শুনানি হয়নি। সম্ভাব্য সবগুলো কারণ মাথায় রেখেই আমরা তদন্ত করছি। এখনই কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তবে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি দেখছি। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন সোওরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্ক এলাকায় মাঝেমঝেই দেখা যায় গ্রেপ্তারদের। তবে ফার্মগেট এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে লুঙ্গি বিক্রি করে তারা। সম্রাট মল্লিক এবং তামিম হাওলাদার রাজাবাজার এলাকায় পরিবারের সঙ্গে থাকে। ইতোমধ্যে পলাশও লুঙ্গি বিক্রির সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। অন্য সময়ের মতো মঙ্গলবার রাতেও মাদকসেবনের জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কালীমন্দির এলাকায় গিয়েছিল তারা।
আটক তিনজনই নানা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যার ঘটনায় আটক তিনজনের গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরে। তিনজনই এলাকায় বিভিন্ন সময়ে নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিল। হাসিনা সরকার পতনের আগে তামিম ও পলাশ গ্রামে নিজ বাড়িতেই থাকত। স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সঙ্গে চলাফেরা করত। আর সম্রাট মাদকাসক্ত বলে স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে। স্থানীয়রা জানান, ঝাউদি ইউনিয়নের শিমুলতলা এলাকার এরশাদ হাওলাদারের ছেলে তামিম ও কালাম সরদারের ছেলে পলাশ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা সোহেল খাঁ ও রুবেল খাঁ গ্রুপের লোক। এদের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে কাজ করত তারা। আওয়ামী লীগের দলীয় কোনো পদ-পদবি না থাকলেও দলটির ছত্রছায়ায় থাকত তারা এবং চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়িত। ৫ আগস্টে পট পরিবর্তনের পর তারা ঢাকায় চলে যায়। বাড়ি ফেরেনি। অন্যদিকে, ডাসারের যতীন্দ্রনাথ মল্লিকের ছেলে সম্রাট মল্লিক মাদকাসক্ত হিসেবে এলাকায় পরিচিত। বেশ কিছুদিন আগে মসজিদের মাইক লাগানো নিয়ে এলাকায় ছাত্রদের মারধর করে সে। এনিয়ে ডাসার থানায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে স্থানীয় সাজ্জাদ হোসেন নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘এরা ভালো পরিবারের ছেলে না। চাঁদাবাজি, মাদকের সঙ্গে জড়িত। আগে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতার লাঠিয়াল গ্রুপের সদস্য ছিল। এখন এলাকা ছেড়ে ঢাকায় থাকে। রাকিবুল ইসলাম নামে ডাসারের এক বাসিন্দা বলেন, শুনেছি ঢাকার ৩০০ ফিট, টিএসসিসহ বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি করে গ্রুপটি। এদিকে, আটকদের বিষয়ে মাদারীপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আদিল হোসেন বলেন, ‘আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি ওদের বিরুদ্ধে এখানকার থানায় কোনো মামলা রয়েছে কি না। আর ডাসার থানার ওসি শেখ মো. এহতেশামুল ইসলাম জানান, সম্রাটের বিরুদ্ধে ডাসার ও ডিএমপির রূপনগরসহ বিভিন্ন থানায় তিনটি মাদক মামলা রয়েছে। তার বিষয়ে আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি।
গ্রামের বাড়িতে সাম্যের দাফন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থী ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্যের গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার ধুকুরিয়া বেড়া ইউনিয়নের সড়াতৈল গ্রামে স্বজনদের মধ্যে চলছে মাতম। সাম্যকে নির্মমভাবে হত্যা করায় পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। গত রাতে সাম্যর লাশ ঢাকা থেকে গ্রামে আনার পর রাত ১০টায় সড়াতৈল জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে দাফন করা হয়। দেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে নানান প্রশ্ন তুলছেন স্বজনরা। তারা এ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তার ও ফাঁসির দাবি জানিয়েছেন। সাম্য ওই গ্রামের ফরহাদ সরদারের ছেলে। তার মা কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। চার ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার ছোট। পরিবারের সবাই ঢাকায় বসবাস করেন। সাম্য হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে জেলা ছাত্রদল বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে।