নিরপরাধ ব্যক্তিদের জড়িয়ে মামলার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বিতর্কিত হয়ে পড়ছে জুলাই-আগস্টের রোমহর্ষক ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাগুলো। বাদীরা এজাহারে উল্লিখিত অধিকাংশ মানুষকেই চেনেন না। এসব ঘটনার লাগাম টানতে না পারায় প্রশ্ন উঠছে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর ভূমিকা নিয়েও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি মামলায় শত শত ব্যক্তিকে আসামি করা হচ্ছে। প্রকৃত অপরাধীর সঙ্গে কৌশলে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে নিরীহ-নিরপরাধ ব্যক্তিদের নামও। এই মামলা ঘিরে গড়ে উঠেছে ভয়ংকর চাঁদাবাজ চক্র। এ কারণে দুর্বল হয়ে পড়ছে মামলার মেরিট। এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারে পলাতক শেখ হাসিনাসহ মামলায় থাকা ভয়ংকর অপরাধীরা। বানোয়াট-ধান্দাবাজির এসব মামলার বাদীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি সংশ্লিষ্টদের।
মামলা দিয়ে নিরীহ মানুষকে হয়রানির বিষয়টি স্বীকার করেছেন খোদ পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম। প্রকৃত চিত্র উঠে এসেছে তাঁর বক্তব্যে।
গত সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘মামলা মিথ্যা না, মামলা সত্যই। তবে আসামির সংখ্যা বাড়িয়ে দেওয়ার জায়গাটা আমরা বন্ধ করতে পারছি না। আইনেও এই সীমাবদ্ধতা আমাদের রয়েছে। ৫ আগস্টের পর দেখা গেছে, অপরাধ হয়তো করেছে পাঁচজন কি দশজন, কিন্তু অসৎ উদ্দেশ্যে, অর্থ আদায়ের জন্য, কাউকে হয়রানি করার জন্য, ভয় দেখিয়ে ৩০০ লোকের নামে মামলা দিয়ে দিয়েছে।’ আইজিপি বলেন, ‘আমরা মামলা দিয়ে কাউকে হয়রানির জায়গাটা বন্ধ করতে চাই। এজন্য আমিও অনেক সময় থানায় ফোন দিয়ে কথা বলছি।’ আসামি করে হয়রানি করা হলে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানোর অনুরোধ করেন তিনি।
খোজ নিয়ে জানা গেছে, অনেক মামলার বাদী আসামিকেই চেনেন না। আসামিরাও চেনেন না বাদীকে। মামলায় ফাঁসানোর নাম করে টার্গেট করা ব্যক্তিদের কাছ থেকে একটি চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। এতে অস্বীকৃতি জানালেই জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে মামলায়। মসজিদ কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্ব গড়িয়েছে জুলাই-আগস্টের মামলায়। একটি পক্ষকে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে অন্য এলাকার মামলায়। তবে কিছু মামলায় ইতোমধ্যে অনেক বাদী নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে নিরপরাধ ব্যক্তিদের নাম এজাহার থেকে বাদ দিতে আদালতে হলফনামাও দিয়েছেন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মুসতাসীম তানজীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অসৎ উদ্দেশ্যে ভুয়া মামলা দায়ের কিংবা মামলা বাণিজ্য করে নিরপরাধ ব্যক্তিদের আসামি করার ঘটনা অপ্রত্যাশিত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে, শোক ও আবেগের বশবর্তী হয়ে কিংবা শোনা কথার ওপর বিভিন্নজনের নামে জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থান-সংক্রান্ত অজস্র গণমামলা হয়েছে। এতে করে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে প্রকৃত আসামিরাও জামিন কিংবা খালাস পেয়ে যাবার সুযোগ নিতে পারে। এটা বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।
অপরাধ বিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয় এসব ব্যক্তিকে মামলায় জড়ানোর বিষয়টি খুবই বিপজ্জনক। একসময় দেখা যাবে, এসব ভুক্তভোগী প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করবে। এটা সমাজে স্থায়ী নৈরাজ্য এবং অরাজকতার জন্ম দেবে। তবে তদন্তকারী কর্মকর্তার উচিত হবে তদন্ত সাপেক্ষে দ্রুততর সময়ের মধ্যে এসব নিরীহ ব্যক্তিকে মামলা থেকে বাদ দেওয়া। একই সঙ্গে বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশ করা। তিনি বলেন, যারা ভুয়া মিথ্যা মামলা করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা নিলে ভবিষ্যতে কেউ আর ভুয়া মিথ্যা মামলা করবে না। জানা গেছে, সম্প্রতি রাজধানীর গুলশান থানায় একটি হত্যা মামলা হওয়ার পর বাদী নিজেই স্বীকার করেছেন, এজাহারে আসামি যাদের করা হয়েছে, তাদের অধিকাংশকেই তিনি চেনেন না। এদের মধ্যে তিনজন এজাহারভুক্ত ব্যক্তি বাদীকে অনুরোধ করেন মামলা থেকে তাদের নাম বাদ দিতে। বাদী এতে সম্মতি দেন। তবে তিনি জানান, তার নেতার সঙ্গে কথা বলে সাত দিন পর সিদ্ধান্ত জানাবেন। সাত দিন পর ভুক্তভোগীরা বাদীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু বাদী তাদের সাফ জানিয়ে দেন, তার নেতা বলে দিয়েছেন, ‘তিনজনের নাম কাটাতে ছয় কোটি টাকা লাগবে। টাকা না দিলে নাম কাটানো যাবে না।’ ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) তালেবুর রহমান বলেন, মামলায় কারও নাম উদ্দেশ্যমূলকভাবে জড়িয়ে দেওয়া হলে পরবর্তী সময়ে তদন্ত প্রতিবেদনে সেগুলো তদন্ত সাপেক্ষে বাদ দেওয়া হবে।