গণ অভ্যুত্থানের পর গত আট মাসে দেশে অনেক রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। ২০ এপ্রিল পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন পেতে আবেদন করেছে ৬৫টি রাজনৈতিক দল। নিবন্ধনের সময় বাড়ানোর জন্য আবেদন করেছে আরও ৪৬টি দল। গঠনপ্রক্রিয়ায় রয়েছে আরও বেশ কিছু দল। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নতুন দলের আগমন ইতিবাচক হলেও প্রচলিত ধারায় বেশির ভাগের টিকে থাকা চ্যালেঞ্জিং হবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তবে বাংলাদেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নিজেদের শক্ত অবস্থান জানান দেওয়ার বিষয়ে আশাবাদী নতুন এই দলগুলো।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. এ কে এম মতিনূর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে কোনো ব্যক্তির রাজনৈতিক দল গঠনের অধিকার রয়েছে। বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখতে হবে। আর এখন চলছে রাজনৈতিক দল খোলার মৌসুম। এই দলগুলোর বেশির ভাগের জন্যই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকা চ্যালেঞ্জিং হবে। এর পেছনে মূল কারণ হবে তাদের জনসম্পৃক্ততার অভাব। ৫ আগস্টের আকাঙ্ক্ষাকে তারা কতটুকু ধারণ করছে তার ওপরও নির্ভর করবে রাজনীতির মাঠে কতটুকু পারফরম্যান্স তারা দেখাতে পারবে।
রাজনীতিতে আসা নতুন দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় রয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি। দুই মাস আগে আত্মপ্রকাশ করা দলটি এখন নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনের শর্ত পূরণে কাজ করছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি নামক যে রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম থেকে দলটি তৈরি হয়েছে, সেগুলোও বর্তমানে সচল আছে। রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি প্ল্যাটফর্মগুলো থেকে নতুন ছাত্র সংগঠন ‘বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ’ তৈরি হয়েছে।
এ ছাড়াও নতুন রাজনৈতিক দল নিয়ে আত্মপ্রকাশের কথা রয়েছে এনসিপির গঠনপ্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে আসা শিবিরের সাবেক নেতাদের নতুন সংগঠন ‘ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ’ এর।
নতুন দলগুলোর মধ্যে একটি হলো- বাংলাদেশ আ-আম জনতা পার্টি। গত ১৭ এপ্রিল আত্মপ্রকাশ করেছে এই দলটি। এর প্রধান ডেসটিনির মোহাম্মদ রফিকুল আমীন। অর্থ পাচার ও ডেসটিনি ট্রি প্লান্টেশনের মামলায় ১২ বছর কারাভোগের পর গত ১৫ জানুয়ারি জেল থেকে বের হওয়ার তিন মাসের মাথায় নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করলেন। দল গঠনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে গণমাধ্যমকে তিনি জানান, এই রাজনৈতিক মঞ্চকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে তিনি তার ওপর ঘটা জুলুমের কথা রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের কাছে পৌঁছে দিতে চান।
দলের সদস্যসচিব ফাতিমা তাসনিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশে বর্তমানে রাজনৈতিক বিপ্লব চলছে। আমাদের লক্ষ্য এই বিপ্লবে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে সুস্থ ধারার ও গঠনমূলক রাজনৈতিক পরিবেশ নির্মাণ করা। জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা। দেশের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে আমরা দলের হয়ে সর্বোচ্চ অবদান রাখতে চাই।
নতুন আত্মপ্রকাশ করা দলগুলোর মধ্যে আলোচনায় রয়েছে- জনতা পার্টি বাংলাদেশ। দলটির প্রধান নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। গত ২৫ এপ্রিল রাজধানীর একটি পাঁচতারকা হোটেলে অনুষ্ঠিত হয় দলটির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠান। দলের মহাসচিব সাংবাদিক শওকত মাহমুদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রতিটি গণ-অভ্যুত্থান, বিপ্লব ও আন্দোলনের পর ওই সংগ্রামী চেতনায় নতুন নতুন রাজনৈতিক দলের অভ্যুদয় ঘটে। মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের চেতনা, ৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান সর্বোপরি ২০২৪-এর জুলাই বিপ্লবের চেতনায় আগামীর বাংলাদেশকে গড়ে তোলা এখনকার প্রধান রাজনৈতিক কর্তব্য। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ এখন নানামুখী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যুগোপযোগী পদক্ষেপ নিতে আমরা কাজ করব। আমাদের লক্ষ্য- নতুন বাংলাদেশে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তি বিনির্মাণ করা।
গত ২০ মার্চ সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে ‘জনতার দল’। দলটির সদস্যসচিব আজম খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নতুন দল হিসেবে ভালো সাড়া পাচ্ছি। আমাদের দলে নানা পেশাজীবী শ্রেণির সদস্যরা রয়েছেন। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাজনীতিতে নতুনত্ব ও গুণগত পরিবর্তন আনতে আমরা কাজ করছি। সৎ, যোগ্য এবং জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য এমন সব প্রার্থী বাছাই করছি। আমরা চাই সংসদে কিছু ভালো মানুষ পাঠাতে, যারা দেশের জন্য কাজ করবে। এরই মধ্যে ৩৫টি আসনে আমরা প্রার্থী খুঁজে পেয়েছি।
বাংলাদেশ জাস্টিস পার্টির (বাজাপা) সভাপতি ড. সৈয়দ জাভেদ মো. সালেহউদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা নতুন কোনো রাজনৈতিক দল নই। আমার পিতা ব্যারিস্টার সৈয়দ কামরুল ইসলাম মো. সালেহউদ্দিন ১৯৮১ সালে এই দলটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি পাকিস্তান আমলে আওয়ামী লীগের এমএলএ ছিলেন। ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে ফরিদপুর-৩ আসন থেকে স্বতন্ত্র এমপি নির্বাচিত হন। আওয়ামী আমলে আমরা বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১২ দলীয় জোটে ছিলাম। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এবার স্বতন্ত্রভাবে আমরা শক্তিশালী একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেদেরকে তুলে ধরতে চাই।
নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে আবেদন করেছে এমন দলের তালিকায় আছে- বাংলাদেশ মুক্তি ঐক্যদল। দলটির ঠিকানা- ফরিদপুরের বোয়ালমারী। দলের সভাপতি মো. নুর ইসলাম শিকদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা ১০ দফার একটি ইশতেহার নিয়ে কাজ করছি। আমাদের লক্ষ্য সংসদে গিয়ে দেশের নিত্য-নৈমিত্তিক সমস্যাগুলোর সমাধান করা। দ্রব্যমূল্য জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসা। ‘বাংলাদেশ জাগ্রত জনতা পার্টি’র সভাপতি সাইফুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অচিরেই আমরা নতুন কিছু নিয়ে জনগণের সামনে আসব। আমাদের উদ্দেশ্য মানবসেবা করা। কর্মমুখী রাজনীতির প্রসার ঘটিয়ে আমরা বেকার সমস্যার সমাধান করব। দলের নেতা-কর্মীদের স্বাবলম্বী করে তুলব।
নতুন আত্মপ্রকাশ করা আলোচিত দলগুলোর তালিকায় আরও রয়েছে- বাংলাদেশ নতুনধারা জনতার পার্টি, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পার্টি (বিজিপি), জাতীয় বিপ্লবী পরিষদ, দেশ জনতা পার্টি, আমজনতার দল, নিউক্লিয়াস পার্টি অব বাংলাদেশ (এনপিবি), জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক পার্টি, ওয়ার্ল্ড মুসলিম কমিউনিটি, সমতা পার্টি, বাংলাদেশ জনপ্রিয় পার্টি (বিপিপি), বাংলাদেশ জন-অধিকার পার্টি, জনতার বাংলাদেশ পার্টি, গণতান্ত্রিক নাগরিক শক্তি, ভাসানী জনশক্তি পার্টি, সার্বভৌমত্ব আন্দোলন, বাংলাদেশ সংস্কারবাদী পার্টি (বিআরপি), বাংলাদেশ মুক্তির ডাক ৭১, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক শক্তি, বাংলাদেশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (বিএসডিপি)।