সাম্প্রতিক সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিকারুননিসা নূন স্কুলের এক শিক্ষার্থীর ভিডিও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। ভিডিওটিতে মেয়েটি নিজের বয়ফ্রেন্ড, উপহার এবং এ বিষয়ে বাবা-মায়ের জানাশোনা নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছে। তার গলায় ছিল আত্মবিশ্বাস, চোখে উচ্ছ্বাস এবং কথায় ছিল এক ধরনের স্বাভাবিকতা।
ঘটনাটি সামাজিক মাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে কেউ বলেছে, ‘নতুন প্রজন্মের খোলামেলা সাহস’, আবার কেউ বলেছে, ‘এটাই সামাজিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত রূপ।’ কিন্তু আসলে আমরা কী দেখলাম? একটি ভিডিও, নাকি এক প্রজন্মের বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ার পরিণতি?
আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই এই মেয়েটির প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। সে কোনো অপরাধ করেনি। বরং সে আমাদের সময়ের এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি। সে যা বলেছে, তা হয়তো তার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়েছে; কারণ তার চারপাশের পৃথিবীটাই এখন এমনভাবেই সাজানো, যেখানে ব্যক্তিগত আর প্রকাশ্য জীবনের সীমারেখা প্রায় মুছে গেছে।
একটি ভিডিওকে কখনই এককভাবে বিচার করা যাবে না। এর পেছনে থাকে পরিবেশ, পারিবারিক সম্পর্ক, শিক্ষার ধরন এবং সমাজের মূল্যবোধের প্রতিফলন। মেয়েটির বক্তব্য যতটা বিস্ময়ের, তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো সে কেন ভাবল, এ কথাগুলো জনসম্মুখে বলা যেতে পারে এবং কেন মনে করল এতে কোনো সমস্যা নেই।
আমাদের সমাজে বর্তমানে দুটি প্রবণতা পাশাপাশি চলছে। একদিকে প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিকতা যেখানে শিশু-কিশোররা শৈশব থেকেই স্মার্টফোন, ইউটিউব, টিকটক ও ইনস্টাগ্রামের জগতে বড় হচ্ছে; অন্যদিকে পরিবার ও বিদ্যালয়ের নৈতিক শিক্ষার ঘাটতি যেখানে মানসিক বিকাশের বদলে প্রতিযোগিতা এবং পারস্পরিক তুলনাই হয়ে উঠেছে প্রধান লক্ষ্য। ফলে আমাদের তরুণ প্রজন্ম এক ধরনের বিভ্রান্তিকর বাস্তবতায় বেড়ে উঠছে। তারা জানে ‘কীভাবে’ কিছু করতে হয়, কিন্তু বোঝে না ‘কেন’ তা করা উচিত কিংবা অনুচিত। তারা আত্মবিশ্বাসী, কিন্তু আত্মবিশ্বাসের সীমানা বোঝে না; খোলামেলা, কিন্তু সংযমহীন। এই বিভ্রান্তিটাই আমাদের সমাজে এখন সবচেয়ে বড় অশনিসংকেত।
এখানে প্রথমেই প্রশ্ন আসে পরিবারের ভূমিকা কোথায়?
আমরা সন্তানদের জন্য সেরা স্কুল, সেরা টিউটর, দামি ফোন ও পোশাক নিশ্চিত করি, কিন্তু তাদের জন্য সময় দিতে পারি না। পরিবারের মধ্যকার কথোপকথন এখন প্রায় বিলুপ্ত। বাবা-মা কাজের চাপে ক্লান্ত, সন্তান নিজের জগতে বন্দি। অথচ পরিবারই হচ্ছে প্রথম ও সবচেয়ে কার্যকর শিক্ষার প্রতিষ্ঠান। একজন শিশুর নৈতিক ও মানসিক বিকাশ শুরু হয় পরিবার থেকেই। সে বাবা-মায়ের আচরণ দেখে শেখে, তাদের ভালোবাসা ও শাসনের ভারসাম্য থেকেই বোঝে কোনটা গ্রহণযোগ্য, কোনটা নয়। তাই যখন সন্তান কোনো বিষয়ে বিভ্রান্ত হয়, তার মূল কারণ অনেক সময় বাবা-মায়ের অনুপস্থিতি বা উদাসীনতা।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাও প্রায় পুরোপুরি ফলাফলকেন্দ্রিক। স্কুলে শেখানো হয় কীভাবে নম্বর বাড়াতে হয়, কিন্তু শেখানো হয় না কীভাবে মানুষ হতে হয়। নৈতিকতা, আত্মসম্মান, লজ্জাবোধ, অনলাইন আচরণ এসব বিষয় কেবল বইয়ের পাতায় থাকে, বাস্তব জীবনের চর্চায় নয়।
শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণভাবে মানসিক বিকাশ বা সামাজিক আচরণ নিয়ে কথা বলেন না, কারণ পাঠ্যসূচি ও পরীক্ষার চাপে এর কোনো জায়গাই থাকে না। ফলে এই বয়সে যখন মানসিক কৌতূহল কিংবা জানার আগ্রহ তৈরি হয়, তখন তরুণরা ইন্টারনেট থেকেই তার উত্তর খোঁজে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আজ তরুণ প্রজন্মের আত্মপ্রকাশের প্রধান ক্ষেত্র। তাদের কাছে ‘দেখানো’ বা Show off মানেই ‘বেঁচে থাকা’। এই দেখানোর সংস্কৃতি আসলে এক ধরনের প্রতিযোগিতাকে কতটা সাহসী, কে কতটা খোলামেলা, কে কতটা ‘আধুনিক’। এ সংস্কৃতির ভিতরে তারা ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছে লজ্জা, সংযম ও সীমাবোধের ধারণা।
কিন্তু আমরা যদি এ প্রজন্মকে কেবল তিরস্কার করি, তাহলে ভুল করব। কারণ তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি হঠাৎ করে তৈরি হয়নি, এটা এসেছে আমাদের সমাজের পরিবর্তন, মিডিয়ার প্রভাব এবং পরিবারের উদাসীনতার সম্মিলিত ফল হিসেবে।
অতএব এই ভিডিওটিকে আমরা কোনো কিশোরীর ব্যক্তিগত ভুল হিসেবে নয়, বরং সমাজ ও পরিবার উভয়ের ব্যর্থতা হিসেবে দেখতে পারি।
আমাদের এখন দরকার আত্মসমালোচনার সময়।
আমরা কি সন্তানদের সঙ্গে পর্যাপ্ত কথা বলি?
তাদের সমস্যাগুলো শুনি, না শুধু নির্দেশ দিই?
আমরা কি তাদের শেখাই, আত্মসম্মান মানে কী?
আমরা কি নিজের আচরণ দিয়ে উদাহরণ দিই?
অভিভাবকদের প্রয়োজন সন্তানদের সঙ্গে সম্পর্কের মধ্যে বিশ্বাস ও সংলাপের পরিবেশ তৈরি করা। সন্তান যেন বুঝতে পারে বাবা-মা তার পাশে আছেন, বিচার করার জন্য নয়, বোঝার জন্য। যদি এ সম্পর্ক তৈরি হয়, তাহলে সন্তান কোনো ভুলপথে গেলেও দ্রুতই ফিরে আসতে পারে।
একই সঙ্গে স্কুলগুলোকেও নতুন করে ভাবতে হবে কীভাবে তারা শিক্ষার্থীদের শুধু পরীক্ষার জন্য নয়, জীবনের জন্য প্রস্তুত করতে পারে। নৈতিকতা, সম্পর্ক, অনলাইন আচরণ ও মানসিক বিকাশ নিয়ে আলোচনা এখন শিক্ষার অপরিহার্য অংশ হওয়া উচিত।
প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন দরকার। কেবল কড়াকড়ি নিষেধাজ্ঞা নয়, দিকনির্দেশনা দিতে হবে। সন্তানকে শেখাতে হবে অনলাইনে তার প্রতিটি পোস্ট বা ভিডিও তার ব্যক্তিগত পরিচয়ের অংশ হয়ে থাকে এবং সেটার দায়ও তাকে নিতে হয়।
সুতরাং এটা বলা জরুরি যে, এই মেয়েটি কোনো অপরাধ করেনি। সে শুধু এমন একসময়ে জন্মেছে, যেখানে প্রকাশকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, কিন্তু এর পরিণাম কিংবা আত্মসমালোচনা শেখানো হয় না। তাকে বিচার নয়, বরং বোঝার প্রয়োজন।
ভিকারুননিসার সেই কিশোরীর ভিডিও হয়তো এক দিন ভুলে যাবে সবাই, কিন্তু সেটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের সন্তানরা যত না ভুলপথে যাচ্ছে, তার চেয়ে বরং আমরাই তাদের দিকনির্দেশনা দিতে ভুলে গেছি।
আজ দরকার নতুন এক সমাজ-ভাবনা যেখানে আত্মপ্রকাশ থাকবে, কিন্তু মর্যাদাবোধও থাকবে; স্বাধীনতা থাকবে, কিন্তু দায়িত্ববোধও থাকবে; ভালোবাসা থাকবে, কিন্তু মূল্যবোধের ভিত্তিতে। যদি আমরা সেটা গড়ে তুলতে পারি তাহলে আগামী প্রজন্ম আর ক্যামেরার সামনে নয়, নিজেদের অন্তরে সত্যিকারের আত্মবিশ্বাস খুঁজে পাবে।
লেখক : ট্রেনিং প্রিন্সিপাল, সিটি ব্যাংক পিএলসি