আমাদের ইতিহাসে কিছু দিন আছে, যেগুলো সময়কে অতিক্রম করে যুগের প্রেক্ষাপট তৈরি করে। ৭ নভেম্বর তেমনই এক দিন। ১৫ আগস্ট-পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে এ দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী অধ্যায়। এ দিনটি শুধু একটি রাজনৈতিক পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণ ছিল না; এটি ছিল জাতীয় আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধারের, রাষ্ট্রকে পুনর্বিন্যাস করার এবং গণমানুষের শক্তি পুনরায় সংগঠিত করার দিন। এ দিনটি প্রমাণ করে, রাষ্ট্রের সংকটঘন মুহূর্তে জনগণের অন্তর্নিহিত শক্তি এবং সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা একত্র হলে জাতি নতুন পথ খুঁজে পায়। সেই পথের কেন্দ্রবিন্দুতে উদিত হন মহান স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান-একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, একজন সংগঠক এবং সর্বোপরি একজন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক, যাঁর সিদ্ধান্ত ও কর্ম আমাদের আজকের রাষ্ট্রকাঠামোর ভিত্তি স্থাপন করেছে।
৭ নভেম্বরের পর জিয়াউর রহমান কোনো প্রতিহিংসার রাজনীতি করেননি; তিনি বিভাজনের মাঠে দাঁড়িয়ে ঐক্যের বীজ বপন করেছিলেন। তখনকার পরিস্থিতিতে তাঁর প্রথম লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রযন্ত্রকে স্থিতিশীল করা, প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্গঠন এবং মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা। মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল হান্টিংটনের সেই কথাটি তাঁর শাসনদর্শনে প্রতিফলিত হয়- ‘Order precedes liberty.’ জিয়া জানতেন, ভোটের মাধ্যমে শাসন তখনই অর্থবহ হবে যখন রাষ্ট্রের কর্মক্ষমতা পুনরুদ্ধার হবে। তিনি সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন, বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনেন এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণকে নতুন দিগন্তে নিয়ে যান। এ সিদ্ধান্তগুলো ইতিহাসে তাঁর বিচক্ষণতা ও রাষ্ট্রদৃষ্টির প্রমাণ হয়ে থাকবে। জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্রদর্শন ছিল অত্যন্ত বাস্তবমুখী। তিনি আবেগ নয়, বাস্তবতার ভিত্তিতে শাসনের নীতি তৈরি করেন। পুনরুদ্ধার করেন বহুদলীয় গণতন্ত্রের অধিকার, চালু করেন গণভোট ও সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্ব যাচাইয়ের প্রক্রিয়া এবং জাতীয় রাজনীতিকে অভিজাতদের কবল থেকে বের করে এনে জনগণের দুয়ার পর্যন্ত পৌঁছে দেন। তাঁর উদ্যোগেই রাজনীতিতে নতুন প্রজন্ম এবং নতুন নেতৃত্বের আত্মপ্রকাশ ঘটে। তাঁর কথার প্রতিধ্বনি এখনো শোনা যায়- ‘রাজনীতি মানুষের কল্যাণের জন্য।’
অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে জিয়ার ভূমিকা ছিল মাইলফলক। যুদ্ধবিধ্বস্ত, রেশননির্ভর, রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত অর্থনীতিকে তিনি আত্মনির্ভরশীল ও উৎপাদনমুখী অর্থনীতির পথে নিয়ে যান। মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশ ছিল একটি ক্লান্ত, ক্ষতবিক্ষত অর্থনীতি-রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত কাঠামোতে আবদ্ধ, খাদ্য ও বৈদেশিক অনুদানের ওপর নির্ভরশীল; বাংলাদেশকে বলা হতো দুর্ভিক্ষের দেশ। জিয়া সেখানেই দাঁড়িয়ে দেখিয়েছেন, বাংলাদেশ আত্মমর্যাদার সঙ্গে দাঁড়াতে পারে; শুধু প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা, পরিশ্রম এবং মুক্ত অর্থনৈতিক সুযোগের বিস্তার। খাল খনন ও নদী পুনঃখননের মাধ্যমে বন্যার সময় পানি ধরে রেখে এক ফসলি জমিতে তিন ফসলের আবাদ প্রচলন করলেন জিয়াউর রহমান। উচ্চ ফলনশীল ধান, সেচ সম্প্রসারণ, সার ও কৃষিঋণ এবং গ্রামীণ যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন তাঁর কৃষিবিপ্লবের ভিত্তি স্থাপন করে। তাঁর সময়ের কৌশলেই বাংলাদেশ খাদ্যনির্ভরতার দিকে অগ্রসরণ হতে শুরু করে। একই সঙ্গে তিনি প্রবাসী শ্রমবাজার উন্মুক্ত করেন, যা আজ আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস। আজকের রেমিট্যান্সভিত্তিক স্থিতিশীল অর্থনীতির মূল বীজ রোপণ করেছিলেন তিনিই। জিয়াউর রহমানের ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ কোনো সংকীর্ণ পরিচয়ের রাজনীতি ছিল না; বরং এটি ছিল একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রদর্শন- যেখানে সমতল ও পাহাড়, বাঙালি ও নৃগোষ্ঠী, গ্রাম ও শহর, বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষকে একই মালায় গাঁথার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বুঝতেন, জাতি গঠনের শক্তি আসে বৈচিত্র্যকে সম্মান করার মধ্য দিয়ে। একে অপরকে পাশে নিয়ে ভবিষ্যৎ নির্মাণের অঙ্গীকারের মধ্যে। মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধসহ নৃতাত্ত্বিক সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে মূলধারায় মর্যাদা দেওয়া ছিল তাঁর রাষ্ট্রদর্শন। তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই নিহিত ছিল একটি ‘রেইনবো স্টেট’ ধারণা- যেখানে সব নাগরিকের পরিচয়, বিশ্বাস ও ইতিহাস সমান মর্যাদা পায় এবং জাতীয় পরিচয় গঠিত হয় সম্মিলিত চেতনার ভিত্তিতে। জিয়ার বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ তাই ভাষা বা ভূগোলের চৌহদ্দিতে সীমাবদ্ধ নয়; এটি ছিল স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং বহুত্ববাদী সম্মিলন-চেতনার মূল্যবোধ, যা আমাদের জাতিসত্তাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
রাষ্ট্র পরিচালনার পাশাপাশি জিয়া আন্তর্জাতিক কূটনীতিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীন পরিচয়কে সম্মানের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্বমঞ্চে। মুসলিম বিশ্ব, প্রতিবেশী রাষ্ট্র এবং বৈশ্বিক শক্তিগুলোর সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তাঁর নীতির কেন্দ্রে ছিল মর্যাদাসম্পন্ন, ভারসাম্যের এবং স্বার্থরক্ষার কূটনীতি। আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার, উন্নয়ন সহযোগিতা ও আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করে তিনি বাংলাদেশকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মানচিত্রে প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করেন। পরবর্তীকালে দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা গঠনে তাঁর ভূমিকা অনন্য। জিয়াউর রহমানকে সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান ইউ বা মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদের সঙ্গে তুলনা করা হয় প্রায়ই- কারণ তিনি ছিলেন উন্নয়ন-বাস্তববাদে বিশ্বাসী, কঠোর শৃঙ্খলা, দূরদর্শিতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি নির্মাণে অটল। দক্ষিণ কোরিয়ার পার্ক চুং-হির মতো তিনি জানতেন, জাতির অগ্রগতি কেবল স্লোগানে আসে না-এটি আসে কঠোর সংগঠন, দক্ষ পরিকল্পনা এবং দক্ষ মানুষের নেতৃত্ব থেকে।
আজ বাংলাদেশের রাজনীতির বাস্তবতা আমাদের আবার ৭ নভেম্বরের চেতনা স্মরণ করিয়ে দেয়। গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, আইনের শাসন, বাকস্বাধীনতা ও সুশাসনের জন্য জাতি জুলাই গণ আন্দোলনের মাধ্যমে আবার এক ঐতিহাসিক পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যাশা করে সেই নেতৃত্বকে- যে নেতৃত্ব জাতিকে বিভক্ত নয়, ঐক্যবদ্ধ দেখতে চায়; যে নেতৃত্ব ক্ষমতার প্রদর্শনে নয়, জনগণের সেবায় বিশ্বাস করে। রাষ্ট্রের শক্তি আসে জনগণের সম্মতি থেকে এবং জাতির মর্যাদা রক্ষা পায় রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি, স্বাধীনতা ও ন্যায়ভিত্তিক শাসনের মাধ্যমে।
৭ নভেম্বরের চেতনা কোনো প্রতিহিংসার ভাষা নয়, কোনো বিভাজনের ডাক নয়। এটি জাতীয় পুনর্জাগরণ, আত্মমর্যাদা এবং গণমানুষের ক্ষমতায়নের প্রতীক। জিয়াউর রহমানের ইতিহাস আমাদের শিখিয়ে দেয়- রাষ্ট্রদর্শন মানে কেবল শাসন নয়; এটি ভবিষ্যৎ নির্মাণের কঠিন দায়িত্ব, সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণের নৈতিক শক্তি এবং জনগণের প্রতি অবিচল বিশ্বাস।
শহীদ জিয়া দেখিয়েছেন, রাষ্ট্রনেতার শক্তি ব্যক্তিগত বিলাসে নয়, নৈতিকতা, সততা এবং আত্মনিবেদনে। তাঁর জীবনে ব্যক্তিগত সম্পদ সঞ্চয়ের কোনো ইতিহাস নেই; তিনি রেখে গেছেন নীতি, শৃঙ্খলা এবং জাতীয়তাবাদী মর্যাদার উদাহরণ। আজ বিএনপির প্রতিশ্রুতি সেই উত্তরাধিকার রক্ষা করা- প্রতিহিংসা নয়, পুনর্গঠন; বিভাজন নয়, ঐক্য; ক্ষমতার দখল নয়, জনগণের বিশ্বাস পুনরুদ্ধার। এ কারণেই ৭ নভেম্বর শুধু অতীতের স্মৃতি নয়; এটি বর্তমানের অনুপ্রেরণা এবং ভবিষ্যতের অঙ্গীকার।
৭ নভেম্বর আমাদের শিখিয়েছে-জাতিকে পিছিয়ে দেওয়া যায় না, আর জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে বন্দি রাখার শক্তি কোনো স্বৈরশাসনের নেই। বাংলাদেশ আবার জেগে উঠবে- গণতন্ত্রের শক্তিতে, জনগণের আস্থায় এবং জাতীয় মর্যাদার অটল বিশ্বাসে। আগামী নির্বাচনে জনগণ কথা বলবে-তাদের ভোটের অধিকার দিয়ে, তাদের মর্যাদা দিয়ে, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা দিয়ে। সেই দিনটি হবে শুধু একটি দলের বিজয় নয়; এটি হবে গণতন্ত্রের বিজয়, নাগরিকের বিজয় এবং রাষ্ট্রের পুনর্জন্ম। দেশ আবার দাঁড়াবে আইন, অধিকার, উন্নয়ন ও সুশাসনের ভিত্তিতে- যেমন জিয়া দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন।
লেখক : বিএনপির সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক