একসময় গুহায় বসবাস করত মানুষ। পাথরে পাথরে ঘষে আবিষ্কার করেছিল আগুন। হিংস্র জন্তুর আক্রমণ থেকে বাঁচতে হয়েছিল একতাবদ্ধ। সমাজবদ্ধ। মানুষের সমাজে আল্লাহ পাঠাতে শুরু করলেন নবী-রসুল। অলি-আউলিয়ারা এসে সমাজ করলেন সংশোধন। শেখালেন বিজ্ঞানসম্মত বাঁচার উপায়। বনের মানুষকে সভ্যতার আলোয় নিয়ে আসার এ বিজ্ঞান ৫০০ বছর আগেও ছিল মুসলমানদের হাতের মুঠোয়। আফসোস! বর্তমান দুনিয়ায় জ্ঞানবিজ্ঞানের কাউন্টার থেকে মুসলমানরা অনেক দূরে ছিটকে পড়েছে। ড. মরিস বুকাইলি বলেছেন, কোরআন আর বিজ্ঞান হাত ধরে হাঁটে। কিন্তু ধার্মিকদের একটা অংশ বিজ্ঞানকে ধর্মবিরোধী ভেবে এসেছ। এ জন্য ধর্ম কিংবা ধর্মগ্রন্থ দায়ী নয়। দায়ী ওই মূর্খ ধর্মান্ধরাই। ইসলাম যে কতভাবে বিজ্ঞান শেখার প্রতি উৎসাহ দিয়েছে পবিত্র কোরআনে চোখ বুলালেই তা দেখতে পাওয়া যায়। কোরআনের প্রথম আয়াত, ‘ইক্রা।’ মানে পড়ো। এখানে বিশেষ করে বিজ্ঞান পড়ার প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহতায়ালা। তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়, ‘বিসমি রাব্বিকাল্লাজি খালাক’- শব্দমালা থেকে। তাঁর নামে পড়ো, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন জমাটবাঁধা রক্ত থেকে। কী আশ্চর্য কথা! কোরআনের সূচনাতেই আল্লাহতায়ালা মেডিকেল সায়েন্সের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। যতক্ষণ পর্যন্ত এ আয়াত কেউ মেডিকেল সায়েন্সের ল্যাবে রেখে ব্যাখ্যা করতে না পারবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আয়াতের সঠিক মর্ম বোঝা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। দুনিয়াখ্যাত ভ্রƒণবিজ্ঞানী ড. কিথ এল মুর বলেন, কোরআনে বলা তথ্যটি শতভাগ সঠিক। মানবভ্রƒণের প্রাথমিক পর্যায় শুরু হয় জমাটবাঁধা রক্ত থেকে। তারপর আস্তে আস্তে বিকশিত হয়ে সে একজন পূর্ণ মানবশিশুর রূপ লাভ করে। এ বিশ্লেষণ পাওয়া যায় সুরা মুমিনুনে। আল্লাহ বলেন, ‘আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মাটির মৌল উপাদান থেকে। তারপর তাকে শুক্রবিন্দুরূপে এক নিরাপদ স্থান মায়ের পেটে রাখি। তারপর শুক্রবিন্দুকে নিষিক্ত করি ডিম্বের সঙ্গে। তারপর নিষিক্ত ডিম্বকে বিবর্তিত করি মাংসপিণ্ডে, তাতে সংযুক্ত করি হাড়। হাড়গুলোকে ঢেকে দিই মাংস দিয়ে। তারপর তাকে দিই অপরূপ রূপ। নিপুণতম স্রষ্টা আল্লাহ কত মহান!’ (সুরা মুমিনুন-১২-১৪)।
বিজ্ঞান শেখার জন্য আল্লাহতায়ালা বান্দাকে বারবার বলেছেন, ‘আওয়ালাম ইয়ানজুরু ফি মালাকুতিস সামাওয়াতি ওয়ালআরদি। আমার বান্দারা কি আকাশ ও জমিনের মাঝে যা আছে তা নিয়ে গবেষণা করে না?’ (সুরা আরাফ-১৮৫)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আফালাম ইয়ানজুরু ইলাসসামাই ফাউকাহুম বাইনাহা ওয়া যাইয়ান্নাহা ওয়ামা লাহা মিন ফুরুজ। আমার বান্দারা কি মহা আকাশ নিয়ে গবেষণা করে না? তাহলে তারা দেখত আমি কত নিপুণভাবে মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছি’ (সুরা কাফ-৬)। বান্দা যখন আকাশ গবেষাণা করবে, পৃথিবী ও পৃথিবীর সবকিছু গবেষণার চোখে, বিজ্ঞানাগারের ল্যাবরেটরিতে দেখবে তখন বান্দার ভিতরজগৎ এক অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়বে। সে কথাও আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাজিনা ইয়াজকুরুনাল্লাহা কিয়ামাও ওয়া কুয়ুদাও ওয়ালা জুনুবিহিম ওয়াতাফাক্কারুনা ফি খালকিস সামাওয়াতি ওয়াল আরদি রাব্বানা মা খালাকতা হাজা বাতিলা। সুবহানাকা ফাকিনা আজাবান্নার। আমার বান্দাদের মধ্যে যারা দাঁড়িয়ে শুয়ে এবং বসে সব সময় আমার সৃষ্টিজগৎ নিয়ে গবেষণা করে, ভাবনার সাগরে ডুবে থাকে, তারা বুঝতে পারে আমি কত বড় নিপুণ স্রষ্টা। তারা প্রার্থনার হাত বাড়িয়ে বলে, ওগো আমাদের দয়াময় প্রভু! এ জগতের একটি অণু-পরমাণুও আপনি অনর্থক সৃষ্টি করেননি। হে দয়াময় প্রভু! আপনি আমাদের আগুনের শাস্তি থেকে বাঁচান।’ (সুরা আলে ইমরান-১৯১)।
বিজ্ঞান শেখার জন্য আমাদের নবীজি (সা.) তাঁর উম্মতদের উদ্দেশ করে বলেন, ‘জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজনে তোমরা চীন দেশে যাও।’ এ হাদিসের ব্যাখ্যায় মুহাদ্দিসরা বলেন, কোরআন-হাদিসের জ্ঞান তো মদিনায়ই সমৃদ্ধ ছিল। তাহলে রসুল (সা.) উম্মতকে চীনে যেতে বলেছেন কেন? তখনকার সময়ে চীন ছিল বিজ্ঞান পাঠের জন্য প্রসিদ্ধ। তাই রসুল (সা.) সাহাবিদের উদ্দেশে বলেছেন, তোমরা প্রয়োজেন চীন দেশে গিয়ে হলেও জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা কর। আরেকটি হাদিসে রসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা গবেষণা কর। গবেষণা সঠিক হলে দুটি সওয়াব। আর গবেষণা ভুল হলে পাবে একটি সওয়াব’ (সহি বুখারি)। এ হাদিসের ব্যাখ্যায় মুহাদ্দিসরা বলেন, বিজ্ঞান গবেষণার সওয়াব সম্পর্কেও এ হাদিস প্রযোজ্য। পাঠক! বিজ্ঞান চর্চায় কোরআন ও নবীজির নির্দেশনার এক-দুটো উদ্ধৃতি দিয়েছি মাত্র। এমন হাজারো উদ্ধৃতি কোরআনের আয়াতে হাদিসের পাতায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আফসোস! বিজ্ঞানচর্চায় এত উৎসাহ-উদ্দীপনা দেওয়ার পরও বিশ্বজুড়ে মুসলমানরা বিজ্ঞানে পিছিয়ে।
লেখক : প্রিন্সিপাল, সেইফ এডুকেশন ইনস্টিটিউট