তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তা ব্যবসায়ী ওহেদুর রহমান জুয়েল। করোনা (কোভিড-১৯) পরবর্তী সময় অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলাতে না পেরে বিনিয়োগের সন্ধানে নামেন। একপর্যায়ে ছুটে যান সরকারি প্রতিষ্ঠান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ফ্যাসিলিটেশন কোম্পানিতে (আইআইএফসি)। সেখানকার পরামর্শকের সঙ্গে আলোচনার পর চুক্তিও করেন তিনি। সে মোতাবেক ওহেদুর রহমানকে নিয়ে যাওয়া হয় দুবাই। রাখা হয় তারকা মানের হোটেলে। দুবাইয়ে তাকে দিয়ে খোলানো হয় প্রতিষ্ঠানও। পরামর্শক ফি নেয়া হয় ডলারে। দিনের পর দিন দুবাইয়ে রাখা হলেও বিদেশী বিনিয়োগ পাওয়া যায়নি। এ উদ্যোক্তার মতো এমন অনেক ব্যবসায়ীকেই তিনি সেখানে পান, যারা একইভাবে প্রতারণার শিকার।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) অধীনে ২০০০ সালে পরামর্শক সংস্থা হিসেবে যাত্রা শুরু করে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ফ্যাসিলিটেশন সেন্টার (আইআইএফসি)। প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশের অবকাঠামো খাতে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি) সহজতর করতে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু সম্প্রতি উদ্যোক্তা ব্যবসায়ীর অভিযোগের ঘটনায় প্রশ্নের মুখে পড়েছে সংস্থাটির ভাবমূর্তি।
জানা গেছে, সরকারি চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর আইআইএফসির এক প্রকল্পের দায়িত্বে ছিলেন প্রাক্তন যুগ্ম সচিব আহসান আব্দুল্লাহ। এ সুযোগে তিনি ব্যবসায়ী জুয়েলের সঙ্গে পরিচিত হন। বিদেশী বিনিয়োগ আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দুজনের মধ্যে একটি চুক্তি হয়। সে অনুযায়ী, প্রায় ৫ কোটি ডলার বিনিয়োগ পাইয়ে দেয়ার বিনিময়ে ২৯ হাজার ডলার পরামর্শক ফি দাবি করেন আহসান।
অভিযোগ অনুযায়ী, বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে বৈঠকের কথা বলে আহসান আব্দুল্লাহ ব্যবসায়ী জুয়েলকে দুবাই নিয়ে যান। সেখানে তারকা মানের হোটেলে অবস্থানকালে ওই ব্যবসায়ীর কাছ থেকে পরামর্শক ফি বাবদ ২৯ হাজার ডলার নিয়েও নেন। শুধু একবারই নয়, একাধিকবার দুবাই সফর করিয়েও শেষ পর্যন্ত প্রতিশ্রুত বিনিয়োগ মেলেনি।
অভিযোগকারী ওহেদুর রহমান জুয়েল গাজীপুরের ইউনিক ওভেন ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের মালিক। তিনি দাবি করেন, এটি ছিল প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার কৌশল। এ ব্যবসায়ী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করেছিলাম সরকারি উচ্চ পদে থাকা একজন ব্যক্তিকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমার ক্ষতির দায় কেউ নিল না।’
আইআইএফসির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে অবশ্য বলেন, ‘অবসরে যাওয়া কোনো কর্মকর্তা ব্যক্তিগতভাবে যদি এ ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকেন, সেটি প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব নয়। তবে ঘটনাটি প্রমাণিত হলে এর দায় পুরো খাতের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।’
ব্যবসায়ী ওহেদুর রহমান জুয়েল অবশ্য গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আহসান আব্দুল্লাহ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ফ্যাসিলিটেশন কোম্পানির প্রজেক্ট কনসালট্যান্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। আলোচনার ধারাবাহিকতায় বিদেশী ফান্ড আনার বিষয়ে উভয়ের মধ্যে ২০২৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর একটি আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয়। এরপর তিনি আমাকে তার শ্যালক জুবায়ের বিন মুবারকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন এবং জানান যে ফান্ড আনার জন্য আপনাকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যেতে হবে। পর্যায়ক্রমে মোট ছয়বার আরব আমিরাতের আজমানে নেয়া হয়। সেখানে জুবায়ের বিন মুবারকের ব্যবস্থাপনায় তার বাসার কাছাকাছি আল রাইয়ান হোটেলে আমি সবসময় অবস্থান করি।’
তিনি আরো বলেন, ‘দুবাইয়ে প্রথমবার যাওয়ার পর একটি কোম্পানি খোলানো হয় আমাকে দিয়ে। কিন্তু পরবর্তী পাঁচবার (প্রতিবার ১০-১৫ দিন অবস্থানকালেও) কোনো ফান্ড ম্যানেজারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করানো হয়নি। এভাবে সময়ক্ষেপণ করে প্রতারণার ফাঁদে ফেলা হয়। সেখানে অবস্থানকালে আমার মতো অনেক প্রতারিত ব্যবসায়ীর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। আমার কাছ থেকে ছয়বার বিদেশযাত্রা, হোটেল ভাড়া, ভ্রমণ ও আনুষঙ্গিক ব্যয় মিলিয়ে ৬৬ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এর মধ্যে পরে ১৭ লাখ টাকা ফেরত দেয়া হয় এবং বাকি ৪৯ লাখ টাকার চেক দিলেও টাকা দেননি আহসান আব্দুল্লাহ।’
জুয়েলের মতোই বিদেশী বিনিয়োগ আনতে গিয়ে প্রাক্তন যুগ্ম সচিব আহসান আব্দুল্লাহর প্রতারণার শিকার হয়েছেন এসকেআরএমএস ফ্যাশনস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হোসেন মো. সোলাইমান, ব্যবসায়ী সুমন। তাদের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়ায় প্রতারণা করা হয়েছে। এর মধ্যে হোসেন মো. সোলাইমানকে কয়েক দফায় নিয়ে যাওয়া হয় দুবাইয়ে। বিদেশী বিনিয়োগ এনে দিতে চুক্তি হয় ২০২৩ সালের ১৯ জুন। বিনিয়োগের অর্থের ৩ শতাংশ কমিশন দেয়ার কথা ছিল। চুক্তিপত্রে আহসান আব্দুল্লাহসহ আরো সই করেন জুবায়ের বিন মোবারক ও শাহা এনাইম কবির নামে একজন।
পরে অবশ্য সাড়ে ৬ কোটি ডলার বিদেশী বিনিয়োগ পাইয়ে দেয়ার জন্য ব্যবসায়ী সোলাইমানের কাছ থেকে পরামর্শক ফি বাবদ ৩০ হাজার ডলার নেন আহসান আব্দুল্লাহ। এরপর তাকেও দুবাই নিয়ে কয়েক দফা রাখা হয়। কিন্তু শেষমেশ কোনো বিনিয়োগ পাননি।
জানতে চাইলে আইআইএফসির নির্বাহী পরিচালক (ফাইন্যান্স ও এইচআর) মো. জসিম উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘প্রাক্তন যুগ্ম সচিব আহসান আব্দুল্লাহ ২০২৩ সাল পর্যন্ত আইআইএফসিতে পরামর্শক হিসেবে যুক্ত ছিলেন।’ তবে বিদেশী বিনিয়োগ এনে দেয়ার কথা বলে প্রতারণার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি আইআইএফসির শীর্ষ পর্যায়ের এ কর্মকর্তা।
বিনিয়োগসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরেই আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দুর্নীতির কারণে ব্যাহত হচ্ছে। এমন প্রতারণার ঘটনা বিনিয়োগকারীদের আস্থাকে আরো কমিয়ে দিতে পারে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় প্রাক্তন সচিব আহসান আব্দুল্লাহর সঙ্গে। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘ওই সময় আমি আইআইএফসিতে প্রকল্পভিত্তিক কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করছিলাম। ব্যবসায়ী উদ্যেক্তা ওহেদুর জুয়েল বিদেশী উৎস থেকে সহজ শর্তে ঋণের জন্য আমার কাছে এসেছিলেন। তিনি স্থানীয় ঋণের জন্য যোগ্য ছিলেন না (দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিলেন)। তাই কেবল এফডিআই (বিদেশী বিনিয়োগ) তার জন্য একমাত্র সমাধান ছিল। আমি তাকে বিদেশী তহবিলের উৎসের সন্ধান দিয়ে সাহায্য করেছিলাম, যা আমার জানা ছিল। তাকে দুবাইভিত্তিক একটি তহবিল চ্যানেলের মাধ্যমে সহায়তা করেছিলাম এবং পদ্ধতি ও প্রক্রিয়াকরণ ফি ইত্যাদি বিষয়ে অবহিত করেছিলাম। স্বচ্ছতার জন্য আমি তার সঙ্গে একটি চুক্তিও পর্যন্ত করেছিলাম। এ উদ্দেশ্যে তাকে দুবাইয়ে একটি কোম্পানি গঠন করতে হয়েছিল এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়েছিল। তিনি দীর্ঘদিন সেখানে ছিলেন, কোম্পানি গঠন করেছিলেন, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রয়োজনীয় বিদেশী তহবিল পাননি।’
ব্যবসায়ী উদ্যেক্তা ওহেদুর জুয়েল দীর্ঘদিন দুবাইয়ে ছিলেন এবং দুবাইভিত্তিক ওই উৎসকে নিজেই অর্থ দিয়েছিলেন বলে দাবি করেন আহসান আব্দুল্লাহ। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার মাধ্যমে নয় বা আমার সঙ্গে পরামর্শ করেও নয়; নিজেই টাকা দিয়েছিলেন ওই উৎসকে। তিনি তহবিলের উৎসের নির্ভরযোগ্যতা মূল্যায়নের সব সুযোগ পেয়েছিলেন, বরং এ প্রক্রিয়া চলাকালীন আমার সঙ্গে তার যোগাযোগ সামান্যই ছিল।’
আরেক উদ্যেক্তা ব্যবসায়ী সোলাইমানের বিষয়ে আহসান আব্দুল্লাহ বলেন, ‘সোলাইমানের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু তিনি এখনো আমার ওপর আক্রমণ শুরু করেননি। এর জন্য অবশ্য আমি অপেক্ষা করছি।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ইআরডি সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকীর দপ্তরে যোগাযোগ করা হয়। পরে তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিএস) মো. সাইদুজ্জামান খান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘স্যার এখন ব্যস্ত, কোনোভাবেই দেখা করা যাবে না।’ —সৌজন্যে বণিক বার্তা