ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যকার সংঘাত বিশ্বের দীর্ঘতম এবং সবচেয়ে সহিংস বিরোধগুলোর অন্যতম। যার উৎস এক শতাব্দীরও বেশি পুরোনো। ভূমি, সীমান্ত ও অধিকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে ঐতিহাসিক বিরোধের পরিণতি এখনো ধ্বংসলীলা ডেকে আনছে। যার সর্বশেষ উদাহরণ গাজায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে সর্বশেষ যুদ্ধ। লিখেছেন- আবদুল কাদের
যেভাবে সংঘাতের সূচনা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের পরাজয়ের পর ব্রিটেন ফিলিস্তিন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেয়। সেখানে আরব সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং ইহুদি সংখ্যালঘু এবং অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা বসবাস করত। কিন্তু ইহুদি ও আরবদের মধ্যে উত্তেজনা আরও গভীর হয় যখন যুক্তরাজ্য ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য একটি ‘জাতীয় আবাসভূমি’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। যা ‘বেলফোর’ নামে পরিচিত। ইহুদিদের দাবি, এই ভূমির সঙ্গে তাদের ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে কিন্তু ফিলিস্তিনিরা শতাব্দীর পুরনো দাবি এবং ব্রিটিশদের পদক্ষেপের বিরোধিতা করে। যদিও ব্রিটিশরা সে সময় বলেছিল যে, সেখানে বসবাসরত ফিলিস্তিনি আরবদের অধিকার রক্ষা করতে হবে। ১৯২০ থেকে ১৯৪০ এর দশকে ‘হলোকাস্ট’-এর ফলে ফিলিস্তিনে আগত ইহুদির সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। যাদের অনেকে ইউরোপে নিপীড়নের শিকার হয়ে সেখান থেকে পালিয়ে এসেছিলেন। জার্মানির স্বৈরশাসক হিটলারের ‘হলোকাস্ট’-এ ষাট লাখ ইহুদির হত্যাকাণ্ড একটি নিরাপদ আশ্রয়ের প্রয়োজনীয়তা আরও বাড়িয়ে তোলে। ১৯৪৭ সাল নাগাদ ইহুদি জনসংখ্যা ৬ লাখ ৩০ হাজারে পৌঁছেছিল, যা মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশের সামান্য বেশি ছিল। ১৯৪৭ সালে ইহুদি ও আরবদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের (ইউএন) ভোটে ফিলিস্তিনকে পৃথক ইহুদি ও আরব রাষ্ট্রে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আর জেরুজালেম হবে আন্তর্জাতিক শহর। কোনো আরব রাষ্ট্রই এর সমর্থন করেনি। তাদের যুক্তি, এই পরিকল্পনা ইহুদিদের বেশি জমি দিয়েছে, যদিও তারা জনসংখ্যায় ছিল কম। ব্রিটেন ভোটদানে বিরত থাকে এবং ১৯৪৮ সালের শেষে নিজেদের প্রত্যাহার করে সমস্যাটি জাতিসংঘের হাতে তুলে দেয়। ব্রিটিশ শাসনের অবসানের কয়েক ঘণ্টা আগে ইহুদি নেতারা ইসরায়েলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে। পরের বছর জাতিসংঘ ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়।
১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ কী?
ইসরায়েল স্বাধীনতা ঘোষণার পরের দিন পাঁচটি আরব রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী ইসরায়েলকে আক্রমণ করে এবং ঘিরে ফেলে। যা ইসরায়েলিদের মাঝে তাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৪৯ সালে যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে যখন লড়াই শেষ হয়, তত দিনে ইসরায়েল বেশির ভাগ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। আর চুক্তির ফলে মিসর গাজা উপত্যকা, জর্ডান পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম এবং ইসরায়েল পশ্চিম জেরুজালেম দখল করে রাখে। প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার ফিলিস্তিনি নিজ বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত হয় এবং সে ভূমি ইসরায়েলের অন্তর্ভুক্ত হয়। এটি আরবিতে নাকবা (মহাবিপর্যয়) নামে পরিচিত। পরের বছরগুলোতে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো থেকে শত শত হাজার ইহুদি ইসরায়েলে চলে আসে।
১৯৬৭ সালের সেই ‘মধ্যপ্রাচ্য’ যুদ্ধ
‘ছয় দিনের যুদ্ধ’ মধ্যপ্রাচ্যের সীমানা বদলে দেয়। ফিলিস্তিনিদের করুণ পরিণতি ডেকে আনে। এই যুদ্ধে ইসরায়েল মিসর, সিরিয়া ও জর্ডানের বিরুদ্ধে লড়াই করে। মিসর ও সিরিয়ার সম্ভাব্য হামলার আশঙ্কায় ইসরায়েল মিসরের বিমান বাহিনীর ওপর হামলা চালায়, যুদ্ধ শুরু হয়। যা শেষ হওয়ার আগেই ইসরায়েল মিসরের সিনাই উপদ্বীপ ও গাজা, সিরিয়ার বেশির ভাগ গোলান মালভূমি এবং জর্ডানের পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীর দখল করে নেয়। পশ্চিম তীর, গাজা ও পূর্ব জেরুজালেম ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। যা আজও অব্যাহত। ১৯৭৯ সালে ইসরায়েল মিসরের সঙ্গে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং সিনাই উপদ্বীপ ফিরিয়ে দেয়।
পশ্চিম তীরের অবস্থা
পশ্চিম তীর- ইসরায়েল ও জর্ডান নদীর মধ্যবর্তী ভূমি; যা ৩০ লাখ ফিলিস্তিনির আবাসস্থল। ফিলিস্তিনিরা সর্বদা এ অঞ্চলে ইসরায়েলের উপস্থিতির বিরোধিতা করেছে এবং তারা চায় এই এলাকাগুলো ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন স্বাধীন রাষ্ট্রের অংশ হোক, যাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন রয়েছে। তবে ইসরায়েল এখনো পশ্চিম তীরের নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে। ১৯৯০-এর দশক থেকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (ফিলিস্তিনি সরকার) এর বেশির ভাগ শহর ও নগর পরিচালনা করে আসছে। পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে প্রায় ৭ লাখ ইহুদিকে ধারণকারী ১৫০টি ইসরায়েলি বসতি রয়েছে। ফিলিস্তিনিরা চায় তাদের বসতি সরিয়ে ফেলা হোক এবং যা আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ। তবে ইসরায়েলের সরকার এর বিরোধিতা করে। তারা জানায়, অন্ততপক্ষে বৃহত্তম বসতিগুলো স্থায়ী এবং সমস্ত বসতিতে তাদের ঐতিহাসিক অধিকার রয়েছে। তারা ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব রাষ্ট্র গঠনের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয় না এবং যুক্তি দেয় যে, পশ্চিম তীর ইসরায়েলি মাতৃভূমির অংশ। ইসরায়েলি সরকার ২০২২ সালে ক্ষমতায় আসার পর বসতি সম্প্রসারণ বৃদ্ধি করে। তারা জানায়, ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হবে। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) বলেছে, অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলের অব্যাহত উপস্থিতি অবৈধ এবং ইসরায়েলের উচিত সব বসতি স্থাপনকারীকে প্রত্যাহার করা।
জেরুজালেম নিয়ে বিরোধ
ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন উভয়ই জেরুজালেমকে নিজেদের রাজধানী হিসেবে দাবি করে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে পূর্ব জেরুজালেম দখল করে এবং পরে পুরো শহরটিকে তার স্থায়ী রাজধানী ঘোষণা করে। তারা জানায়, জেরুজালেমকে বিভক্ত করা যাবে না। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিরা পূর্ব জেরুজালেমকে ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে দাবি করে। জেরুজালেমের পবিত্র স্থান ফিলিস্তিন-ইসরায়েলি সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু। সবচেয়ে পবিত্র স্থান- যা মুসলমানদের কাছে আল আকসা মসজিদ বা হারাম আল-শরিফ এবং ইহুদিদের কাছে টেম্পল মাউন্ট নামে পরিচিত সেটি এই পূর্ব জেরুজালেমেই অবস্থিত। জাতিসংঘ ও বেশির ভাগ আন্তর্জাতিক মতামত পূর্ব জেরুজালেমকে ইসরায়েল কর্তৃক অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূমি হিসেবে বিবেচনা করে।
গাজা উপত্যকার পরিণতি
গাজা উপত্যকা ইসরায়েল, মিসর ও ভূমধ্যসাগর দ্বারা বেষ্টিত একটি ভূখণ্ড। এটি ৪১ কিলোমিটার (২৫ মাইল) দীর্ঘ এবং ১০ কিলোমিটার প্রশস্ত। প্রায় ২৩ লাখ মানুষের আবাসস্থল, যা পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ স্থানগুলোর একটি। ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে সর্বশেষ যুদ্ধের আগেও গাজার বেকারত্বের হার ছিল বিশ্বের সর্বোচ্চ। অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে এবং বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যসহায়তার ওপর নির্ভরশীল। ১৯৪৮ সালের মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের ফলে গাজার সীমানা নির্ধারিত হয়। তখন এটি মিসরের অধীনে ছিল। মিসর ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের শেষে গাজা থেকে বিতাড়িত হয় এবং এর নিয়ন্ত্রণ নেয় ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ, যারা সেখানে বসতি স্থাপন করে এবং ফিলিস্তিনি জনগণকে সামরিক শাসনের অধীনে রাখে। ২০০৫ সালে ইসরায়েল গাজা থেকে তাদের সৈন্য ও বসতি প্রত্যাহার করে নেয় যদিও তারা এর সীমান্ত, আকাশসীমা ও উপকূলরেখার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখে। জাতিসংঘ এখনো গাজাকে ইসরায়েল-অধিকৃত ভূখণ্ড হিসেবে গণ্য করে। হামাস ২০০৬ সালে ফিলিস্তিনি নির্বাচনে জয়লাভ করে এবং পরের বছর তীব্র লড়াইয়ের পর প্রতিদ্বন্দ্বীদের ভূখণ্ড থেকে তাড়িয়ে দেয়। এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল ও মিসর অবরোধ আরোপ করে। পরের বছরগুলোতে হামাস ও ইসরায়েল বেশ কয়েকটি বড় সংঘাতে লিপ্ত হয়- যার মধ্যে ২০০৮-০৯, ২০১২ ও ২০১৪ সালের সংঘাত উল্লেখযোগ্য। মে ২০২১ সালে দুইপক্ষের মধ্যে একটি বড় সংঘাত ১১ দিন পর যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে শেষ হয়। প্রতিটি দফায় উভয় পক্ষের মানুষ নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে গাজার ফিলিস্তিনিদের সংখ্যাই বেশি। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস যোদ্ধারা গাজা থেকে একটি আক্রমণ শুরু করে। তারা ইসরায়েলে প্রায় ১২০০ জনকে হত্যা করে এবং ২৫০ জনের বেশি জিম্মি করে। ফলে গাজায় একটি বিশাল ইসরায়েলি সামরিক অভিযান শুরু হয়। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, ৫০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, যাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’-এর তথ্য অনুসারে, গাজায় ইসরায়েলের অবরোধ, হামলা ও জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির মতো ঘটনা যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের শামিল। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী তাদের অস্ত্র ব্যবহার করে নৃশংসতা চালিয়েছে তার সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি এবং অন্যান্য পশ্চিমা সরকার তাদেরকে অস্ত্র ও সামরিক সহায়তা প্রদান অব্যাহত রেখেছে; যা আন্তর্জাতিক আইনি বাধ্যবাধকতা এবং দেশীয় আইনের লঙ্ঘন। যুদ্ধক্ষেত্রে নজরদারি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও অন্যান্য প্রযুক্তির ব্যবহার বেসামরিক ক্ষতি আরও বাড়িয়ে তোলে।
মানবিক সংকট
গাজাবাসীর মানবেতর জীবন
গাজার ‘জনগণ’ আজ চরম মানবিক সংকটের মুখোমুখি। ইসরায়েলি বাহিনীর নৃশংসতায় প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ আজ বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং ১০ লাখেরও বেশি মানুষ হয়েছে গৃহহীন। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে; পুরো জনসংখ্যা তীব্র খাদ্যসংকট ও অপুষ্টির শিকার। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি জানিয়েছে, গাজার খাদ্য ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে এবং দুর্ভিক্ষের উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে), ইসরায়েল গণহত্যার অভিযোগের বিরুদ্ধে নিজেদের রক্ষার জন্য তাদের ‘মানবিক পদক্ষেপ’-এর কথা উল্লেখ করেছে। যা সম্পূর্ণ ‘মিথ্যা’ বলে আখ্যায়িত করেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। তবে বাস্তবচিত্র সম্পর্কে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের ওয়েবসাইটে জানিয়েছে, ইসরায়েলি সৈন্যরা ইচ্ছাকৃতভাবে ফিলিস্তিনিদের প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ থেকে বঞ্চিত করেছে, যা গুরুতর- মানবতাবিরোধী অপরাধ।
অবকাঠামোগত ধ্বংস
‘গাজা’ যেন ধ্বংসস্তূপের নগরী
গাজা উপত্যকার অবকাঠামো প্রায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসপ্রাপ্ত। বিশ্বব্যাংক এবং জাতিসংঘের একটি যৌথ প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, অক্টোবর ২০২৩ থেকে জানুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত গাজার অবকাঠামোর ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৮.৫ বিলিয়ন ডলার; যা পশ্চিম তীর ও গাজার সম্মিলিত জিডিপির ৯৭ শতাংশের সমান। এই ক্ষতির মধ্যে ৭২ শতাংশই আবাসিক ভবনের ধ্বংস এবং ১৯ শতাংশ জনসেবা অবকাঠামো যেমন পানি, স্বাস্থ্য, ও শিক্ষা খাতের ক্ষতি। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই ধ্বংসের ফলে প্রায় ২৬ মিলিয়ন টন ধ্বংসাবশেষ সৃষ্টি হয়েছে; যা অপসারণে কয়েক বছর সময় লাগতে পারে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর তথ্যমতে, ইসরায়েলি সৈন্যরা হাসপাতাল, আবাসিক ভবন এমনকি ত্রাণকর্মীদেরও লক্ষ্যবস্তু করেছে। বাস্তুচ্যুতদের আশ্রয় দেওয়া স্কুল ও শিবিরগুলোকেও ধ্বংস করেছে। ফলে কোনো নিরাপদ আশ্রয় নেই।
স্কুল-হাসপাতালে হামলা
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা খাতে পতন
গাজায় হাসপাতালগুলো কেবল গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা অবকাঠামো হিসেবে নয়; বরং বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের আশ্রয়স্থল হিসেবেও ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্তু ইসরায়েলি বাহিনীর ভারী অস্ত্র ব্যবহারের ফলে হাসপাতালের অবকাঠামোগুলো আজ শুধুই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এমনকি অগ্রসরমান স্থল অভিযানের আওতায় আসা এলাকার সব হাসপাতাল তাদের পরিষেবা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। যার মধ্যে আল-মাওয়াসির আল-খায়ের হাসপাতালও রয়েছে; যা কোনো ‘সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশের’ আওতায় ছিল না। যার কারণে গাজার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসপ্রাপ্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ৬৫৪টি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে হামলা হয়েছে এবং ১ হাজার ৫০ জনেরও বেশি স্বাস্থ্যকর্মী নিহত হয়েছেন। ৩৬টি হাসপাতালের মধ্যে মাত্র ১৭টি আংশিকভাবে কার্যকর রয়েছে এবং সেগুলোও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও ওষুধের অভাবে সেবা দিতে অক্ষম। এ ছাড়া জাতিসংঘ কর্তৃক গত বছরের ২ মার্চ ২০২৪ তারিখে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, অক্টোবর মাস থেকে ৩১৮টি বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছে। সম্প্রতি ধারণকৃত স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ এবং মাঠপর্যায়ের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এই বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অন্তত ২৮৭টি ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে এবং তন্মধ্যে ৩৯টি রাফাহ পৌরসভার তথাকথিত ‘নিরাপদ অঞ্চলে’ অবস্থিত ছিল। স্কুলগুলোর ওপর হামলা ও ধ্বংসের ফলে আশ্রয় নেওয়া বেসামরিক ব্যক্তিরা আরও বেশি বাস্তচ্যুত হয়েছে।
ইয়াসির আরাফাত
ফিলিস্তিনের অবিসংবাদিত নেতা
ইয়াসির আরাফাত, মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম এক আইকনিক ব্যক্তিত্ব। যিনি ফিলিস্তিনি জনসাধারণের অবিসংবাদিত নেতা এবং ফিলিস্তিন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূল নায়ক। যার নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই ভেসে ওঠে ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘ সংগ্রাম, যুদ্ধ, আশা ও বিতর্কের এক জটিল ইতিহাস। প্রবীণ এই নেতা ছিলেন প্রতিরোধের প্রতীক, ফিলিস্তিনি সংগ্রামে তার ভূমিকা অনেক বেশি।
মহান এই নেতা ১৯২৯ সালে অপেক্ষাকৃত সচ্ছল ব্যবসায়ী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং তাঁকে মুহাম্মদ নাম দেওয়া হয়, যা পরবর্তীতে তাঁর ডাকনাম ইয়াসিরের কাছে ম্লান হয়ে যায়। তিনি সর্বদা দাবি করতেন, তিনি জেরুজালেমে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু বেশ কয়েকজন তদন্তকারী এই দাবির সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। তাদের ভাষ্য, তিনি কায়রো বা গাজা উপত্যকায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কিশোর বয়সে আরাফাত ফিলিস্তিনের ইসরায়েলি দখলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধকারী ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের সাহায্যে কাজ করেন এবং তথ্যপ্রমাণ রয়েছে যে, ১৯৪৮ সালের যুদ্ধে যোদ্ধাদের কাছে অস্ত্র চোরাচালানে সাহায্য করেছিলেন। অনেক উচ্চাকাক্সক্ষী ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীর মতো তিনিও অবশেষে পড়াশোনা শেষ করার জন্য মিসরে যান। কায়রোর কিং ফুয়াদ প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তরুণ আরাফাত ফিলিস্তিনি গ্র্যাজুয়েট অ্যাসোসিয়েশন গঠন করেন; যা ছিল সুয়েজ সংকটে ব্রিটিশ, ফরাসি এবং ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মিসরীয় ফ্রন্টে স্বেচ্ছাসেবক সরবরাহকারী একটি দল। ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রির পর তিনি কুয়েতে চাকরি খোঁজেন। কিন্তু তরুণ এই বিপ্লবী চাকরির চেয়ে অনেক বেশি কিছুতে আগ্রহী ছিলেন। কুয়েতে তিনি ফাতাহ আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করেন; যা পরে ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার বৃহত্তম এবং জনপ্রিয় দল হিসেবে কাজ করে। তিনি ১৯৬৯ সালে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (PLO) চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এই পদে বসেই তিনি বিশ্ববাসীর সামনে ফিলিস্তিনকে তুলে ধরেন। ১৯৭৪ সালে তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেন। তবে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় মাইলফলক আসে ১৯৯৩ সালে; যখন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিনের সঙ্গে অসলো চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। যা ইসরায়েল এবং PLO পরস্পরকে স্বীকৃতি দেয়। ২০০০ সালে দ্বিতীয় ইনতিফাদা (গণবিদ্রোহ) শুরু হলে আবার পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ইসরায়েল তাঁর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ এনে রামাল্লায় বন্দি করে রাখে। ২০০৪ সালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং চিকিৎসার জন্য ফ্রান্সে যান। সেখানেই ১১ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে বিক্ষোভ
গাজার ভয়াবহ পরিস্থিতি এবং গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। গেল ৭ এপ্রিল থেকে বিভিন্ন দেশে ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে ‘গ্লোবাল স্ট্রাইক ফর গাজা’ শিরোনামে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে; যেখানে মানুষ গাজার জনগণের প্রতি সংহতি প্রকাশ করছেন এবং ইসরায়েলি অভিযানের নিন্দা জানাচ্ছেন
যুক্তরাষ্ট্র : ‘গ্লোবাল স্ট্রাইক ফর গাজা’- এই স্লোগানকে সামনে রেখে সম্প্রতি ওয়াশিংটন ডিসিতে হাজার হাজার মানুষ হোয়াইট হাউসের সামনে সমবেত হয়ে গাজার জনগণের প্রতি সমর্থন জানায় এবং মার্কিন সরকারের ইসরায়েল নীতির প্রতিবাদ করে। বিক্ষোভকারীরা যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানায় এবং গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবাহ নিশ্চিত করার দাবি করে।
যুক্তরাজ্য : গাজার গণহত্যার বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যের লন্ডনেও হাজার হাজার মানুষ পার্লামেন্ট স্কয়ারে সমবেত হয় এবং ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের নিন্দা জানায় এবং ব্রিটিশ সরকারের কাছে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহারের আহ্বান জানায়। পাশাপাশি আগত বিক্ষোভকারীরা গাজার জনগণের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে এবং যুদ্ধবিরতির দাবি করে।
ফ্রান্স : প্যারিসে রিপাবলিক স্কয়ারে হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়ে গাজার পরিস্থিতির প্রতিবাদ করে এবং ফরাসি সরকারের কাছে ইসরায়েলের প্রতি অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করার আহ্বান জানায়। বিক্ষোভকারীরা গাজার জনগণের প্রতি সমর্থন জানায় এবং মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করার দাবি করে।
জার্মানি : বার্লিনে ব্রান্ডেনবার্গ গেটের সামনে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ করে; যেখানে তারা গাজার জনগণের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে এবং জার্মান সরকারের কাছে ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের নিন্দা জানাতে আহ্বান জানায়। বিক্ষোভকারীরা যুদ্ধবিরতির দাবি করে এবং গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবাহ নিশ্চিত করার আহ্বান জানায়।
বাংলাদেশ : ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। বক্তারা গাজার জনগণের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন।