ইরানি বিপ্লবের আগে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল। তবে সে সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে দেশ দুটি। ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের চলমান হামলা ও ইরান সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে ইসরায়েলের হামলা-পাল্টা হামলায় পুরো চিত্র বদলে গেছে। ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি করার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, এ অভিযোগে ইসরায়েল হামলা করে ইরানে। দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর হামলার কঠিন জবাব দিতে শুরু করে ইরান। পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ছে দেশ দুটি। হচ্ছে প্রাণহানি ও অবকাঠামো ধ্বংস। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের হুমকিতে গোটা বিশ্ব-
যেভাবে সম্পর্কের অবনতি
১৯৪৮ সালে যখন ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয় তখন তুরস্কের পর ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া দ্বিতীয় মুসলিম দেশ ছিল ইরান। ক্রমে দুই দেশের মধ্যে গড়ে ওঠে অর্থনৈতিক, এমনকি সামরিক সম্পর্কও। ১৯৫৭ সালে যখন ইরানের গোয়েন্দা সংস্থা ‘সাভাক’ প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন এতে সহায়তা করেছিল ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। ইরান সরকার ইসরায়েলের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখলেও ইরানের ভিতরে আগে থেকেই ইসরায়েল বিরোধিতা ছিল। ইরানের শাহ শাসনবিরোধী বামপন্থিদের সঙ্গে ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলন ফাতাহ এবং এর নেতা ইয়াসির আরাফাতের যোগাযোগ ছিল। অন্যদিকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি এবং তার অনুসারীরাও ছিলেন ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে। ইরান-ইসরায়েল সম্পর্ক ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর ভেঙে পড়ে। তখন ক্ষমতায় আসা ইরানের বিপ্লবী সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে ফিলিস্তিনিদের পক্ষ নেওয়ার ঘোষণা দেয়। তেহরানে ইসরায়েলের দূতাবাসকে ফিলিস্তিনি দূতাবাসে পরিণত করে। তারা ইসরায়েলের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। মূলত ইরানের বিপ্লবী সরকার ফিলিস্তিনে ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে। যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব এসেক্সের শিক্ষক এবং মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আব্বাস ফয়েজ বলেন, ‘ইরানি সরকারের ইসরায়েল নীতি পরিবর্তন হওয়ার কারণেই দুই দেশের সম্পর্ক বৈরী হতে শুরু করে। ইসলামি বিপ্লবের পর ইরান সরকার আমেরিকা এবং ইসরায়েলকে তার জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। একই সঙ্গে ফিলিস্তিনকে সমর্থন দেওয়ার নীতিও নিয়েছিল। অন্য আরব দেশগুলো ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দুই রাষ্ট্র সমাধানে একমত হলেও ইসলামি বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি সেটা গ্রহণযোগ্য মনে করেননি। তারা ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে অস্বীকারের নীতি নেয়। অন্যদিকে ইরানের এমন উত্থানকে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করে ইসরায়েল।’ ইরানি নেতৃত্ব ইহুদিবিরোধী বক্তব্য দিতে থাকেন। প্রকাশ্যে মানচিত্র থেকে ইসরায়েলকে মুছে ফেলার হুমকিও দেয়। ইরান ২০০৬ সালের লেবানন যুদ্ধের সময় হিজবুল্লাহকে সমর্থন করে। এতে ইসরায়েল ক্ষিপ্ত হয়। পাশাপাশি ইরান হামাস ও ফিলিস্তিনি ইসলামি জিহাদকেও সমর্থন দিতে শুরু করে। ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের হামলার ভয়াবহতা দেশে ইরানের জনগণও ইসরায়েলবিরোধী স্লোগানে সোচ্চার হয়ে ওঠে। ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে বরাবরই উদ্বেগ জানিয়ে আসছিল। যদিও ইরান দাবি করেছে, তাদের পরমাণু গবেষণা শান্তিপূর্ণ। কিন্তু ইসরায়েল থামেনি। ইরানের অভ্যন্তরে বেশ কয়েকটি শাসকবিরোধী মিলিশিয়াকে ব্যবহার করে নানা সময় হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ইরানের অভ্যন্তরে বারবার হামলা চালিয়েছে। এসব হামলায় প্রাণ গেছে ইরানের রাজনৈতিক ও সামরিক বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও নেতৃত্বের। সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে ২০২৪ সালের ১ এপ্রিল ইসরায়েল বিমান হামলা করে। এ হামলায় ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের দুই শীর্ষ জেনারেলসহ অন্তত সাতজন নিহত হন। এর প্রতিশোধ নেওয়ার ঘোষণা দেয় ইরান। ১৩ এপ্রিল রাতে ইরান সরাসরি ইসরায়েলের মূল ভূখণ্ডে ভয়াবহ হামলা চালায়। ইরান ৩০০টিরও বেশি ড্রোন, ক্রুজ মিসাইল ও ব্যালিস্টিক মিসাইল নিক্ষেপ করে ইসরায়েলের দিকে। এর পাল্টা জবাব দিলে আরও হামলার হুমকি দেয় ইরান। নজিরবিহীন এ পাল্টা হামলায় গোটা বিশ্ব আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দুই দেশকেই সংযম দেখানোর জন্য চাপ দিতে শুরু করে। সরাসরি সামরিক হামলা থেমে গেলেও দুই দেশের মধ্যকার উত্তেজনা কমেনি। ইরান ইসরায়েলের অস্তিত্বেব জন্য হুমকি ও দেশটি পরমাণু অস্ত্র তৈরি দ্বারপ্রান্তে এ অভিযোগে গত ১৩ জুন ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করার লক্ষ্যে ইরানজুড়ে হামলা করে ইসরায়েল। ইরানও পাল্টা হামলা করে ইসরায়েলে। শুরু করে যুদ্ধ।
কেন এই সংঘাত
ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের নেপথ্যে একে অন্যের ওপর কয়েকটি শক্ত অভিযোগ এনেছে। ইসরায়েল দাবি করে, ইরান ও ইরান সমর্থিত কয়েকটি সশস্ত্র গোষ্ঠী দেশটিকে ভেঙে দিতে চায়। ইহুদি রাষ্ট্রটিকে ইরান নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়। তাই ইরান যেন সামরিক শক্তিমত্তায় আধুনিকায়ন বিশেষ করে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে না পারে সেজন্য কয়েক দশক ধরেই সোচ্চার রয়েছে। এ নিয়ে ইসরায়েল সামরিক হামলার হুমকিও দিয়ে এসেছে। ইসরায়েল চায় ইরান সরকারের নেতৃত্বে পরিবর্তন আসুক, ইরান সমর্থিত লেবাননের হিজবুল্লাহ, ফিলিস্তিনের হামাসের মতো রাজনৈতিক-যোদ্ধা সংগঠনগুলো ধ্বংস হোক। ১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লবের পর ইসরায়েলের প্রতি ইরানের শত্রুতামূলক অবস্থান থেকে ধীরে ধীরে এ দ্বন্দ্বের শুরু। এ সংঘর্ষের মূল বিষয়গুলোর মধ্যে আরও রয়েছে- ইসরায়েলের বিরোধী দলগুলোর প্রতি ইরানের সমর্থন, ইরানবিরোধী বিদ্রোহী দলগুলোর প্রতি ইসরায়েলের সমর্থন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এবং ইরানের অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী যেমন- সৌদি আরব এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক। ইরান হিজবুল্লাহ, হামাস ও পিআইজেকে উল্লেখযোগ্য সহায়তা দিয়েছে। অন্যদিকে ইসরায়েল ইরানের পিপলস মুজাহিদিন অব ইরানকে সমর্থন জুগিয়েছে এবং সরাসরি ইরানীয় লক্ষ্যবস্তুতে গুপ্তহত্যা ও হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েল ইরানের বিরুদ্ধে সাইবার যুদ্ধ পরিচালনা করেছে। প্রকাশ্যে ইরানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সামরিক অভিযানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ইরানও ইসরায়েলের নির্বিচার হামলা ও সামরিক আগ্রাসনের জবাবে বলে এসেছে, তাদের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ইসরায়েলের দিকেই তাক করা।
আধিপত্যের দ্বন্দ্ব!
ইসরায়েল দাবি করে, ইরান তার অস্তিত্বের জন্য হুমকি। অন্যদিকে ইরানে ইসরায়েলবিরোধী মনোভাব পুরো চিত্র বদলে দিয়েছে। ইরানের দূরপাল্লার মিসাইল তৈরির চেষ্টা ও পরমাণু প্রকল্প গ্রহণকে ইসরায়েল সরাসরি হুমকি হিসেবে মনে করে। তারা ইরানের সামরিক উচ্চাকাক্সক্ষা বিশেষত পরমাণু প্রকল্প ভেস্তে দিতে মরিয়া। ইরানের ভিতরে একের পর এক বিজ্ঞানীকে ইসরায়েল হত্যা করেছে বলে অভিযোগ ইরানের। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে ইরান তার প্রভাব-বলয় বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেয়। লেবাননে ইরানের প্রত্যক্ষ সহায়তায় গড়ে ওঠে হিজবুল্লাহ। নব্বই দশকে হামাস এবং ইসলামি জিহাদকেও সহায়তা করতে শুরু করে ইসরায়েল। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও ইসরায়েল এক ধরনের আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। যেটা দুই দেশের সম্পর্ককে খারাপের দিকেই নিয়ে যায় বলে মনে করেন ইসরায়েলের তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডল ইস্টার্ন স্টাডিজের অধ্যাপক মেইর লিটভ্যাক। তিনি বলেন, ‘ইসরায়েল ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করতে আগ্রহী ছিল না। তারা শেষ পর্যন্ত সম্পর্ক ধরে রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ইরান সরকারের নীতির কারণে সেটা আর সম্ভব হয়নি। পরে ইসরায়েল অন্তর্ঘাতমূলক কার্যক্রম চালিয়ে ইরানের পরমাণু প্রকল্পকে ব্যাহত করতে চেষ্টা করে। কিন্তু সে চেষ্টা কাজে আসেনি। এতে দুই দেশের সম্পর্ক আরও তলানিতে গিয়ে ঠেকে।’
সংঘাতের ইতিহাস
২০১৯ সালে মিত্রদের ওপর হামলা : ইসরায়েল সিরিয়া, লেবানন ও ইরাকে ইরানের মিত্রদের ওপর একাধিক হামলা চালায়। ইসরায়েলের দাবি, ইরান যেন মিত্রদের অত্যাধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করতে না পারে, সে জন্যই এ ধারাবাহিক হামলা। ইসরায়েলের অভিযোগ- ইরাক ও সিরিয়ার ভিতর দিয়ে লেবাননে অস্ত্র সরবরাহের পথ তৈরির চেষ্টা করছিল ইরান। লেবাননে হিজবুল্লাহকে দীর্ঘদিন ধরেই ইরান সমর্থন দিয়ে আসছে। এ ছাড়া পূর্ব ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগরের মধ্য দিয়ে ইরানের তেল ও অস্ত্রবাহী জাহাজেও হামলা চালায় ইসরায়েল।
২০২০ সালে দূর-নিয়ন্ত্রিত হত্যাকাণ্ড : ২০২০ সালের নভেম্বরে দূর-নিয়ন্ত্রিত মেশিনগানের মাধ্যমে ইরানের শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদেহকে হত্যা করে ইসরায়েল।
২০২১ সালে সমুদ্রে সংঘাত : সাগরে একে অপরের ওপর হামলা বাড়িয়ে দেয় ইরান ও ইসরায়েল। সে বছর ফেব্রুয়ারিতে ওমান উপকূলে যানবাহন বহনকারী ইসরায়েলি মালিকানাধীন জাহাজে বিস্ফোরণের পেছনে ইরানকে দায়ী করেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। অন্যদিকে মার্চে ইরান অভিযোগ করে, ইসরায়েল তাদের কার্গো জাহাজে হামলা চালিয়েছে। এটি ইসরায়েলের উপকূল থেকে প্রায় ৫০ মাইল দূরে ছিল। এরপর এপ্রিলে লোহিত সাগরে থাকা ইরানি সামরিক জাহাজ ইসরায়েলি হামলায় বিধ্বস্ত হয়। পাল্টাপাল্টি এমন ঘটনা বছরজুড়েই চলতে থাকে।
২০২২ সালে ইরানি কর্মকর্তাকে হত্যা : মে মাসে মোটরসাইকেলে আসা দুই আততায়ী ইরানের বিপ্লবী গার্ড (আইআরজিসি) কর্মকর্তা কর্নেল সায়্যিদ খোদাইকে গুলি করে হত্যা করে। ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের দাবি, সায়্যিদ খোদাই গোপন অভিযান দলের নেতৃত্ব দিতেন। এ দলটি হত্যাকাণ্ড ও অপহরণ পরিচালনা করত। ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এ হত্যাকাণ্ডে নিজেদের ভূমিকার কথা নিশ্চিত করে। এ ছাড়া মে মাসে মারা যান দুই বিজ্ঞানী। তাদের মধ্যে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার আইয়ুব এনতেজারি কাজ করতেন সামরিক গবেষণা কেন্দ্রে এবং কামরান আগামোলাই ছিলেন ভূতত্ত্ববিদ। তারা খাবারে বিষক্রিয়ার লক্ষণ নিয়ে মারা যান। ইরান অভিযোগ করে, ইসরায়েল তাদের বিষ প্রয়োগে হত্যা করেছে। দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েল কোনো মন্তব্য করেনি।
২০২৩ সালের সংঘাতে উত্তপ্ত মধ্যপ্রাচ্য : ৭ অক্টোবর হামাসের নেতৃত্বে ইসরায়েলে হামলার পর গাজায় ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হয়। হামাসের প্রতি সংহতি জানিয়ে লেবাননের হিজবুল্লাহ ও ইয়েমেনের হুতিসহ এ অঞ্চলের ইরান-সমর্থিত অন্য গোষ্ঠীগুলোও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেয়। যদিও ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি ৭ অক্টোবরের হামলায় ইরানের ভূমিকা থাকার কথা নাকচ করেন। তবে হামাস নেতারা আঞ্চলিক মিত্রদের কাছ থেকে সমর্থন পাওয়ার কথা জানান। এ ছাড়া ডিসেম্বরে সিরিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইরানের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা নিহতের ঘটনায় ইসরায়েলকে দায়ী করে তেহরান।
২০২৪ সালে দামেস্কে হামলা-পাল্টা হামলা : এপ্রিলে সিরিয়ার দামেস্কে ইরানি দূতাবাসে ইসরায়েলি বিমান হামলায় ইরানের তিন শীর্ষ কমান্ডার ও চারজন কর্মকর্তা নিহত হন। এর কয়েক সপ্তাহ পর তেহরান ইসরায়েলের দিকে ৩০০টিরও বেশি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে। এগুলোর প্রায় সবই ভূপাতিত করা হয়। এর পরপরই ইসরায়েল ইরানের বিমানবিধ্বংসী ব্যবস্থায় হামলা চালায়। এটি একটি পারমাণবিক স্থাপনাকে সুরক্ষা দিচ্ছিল। তাছাড়া জুলাইয়ে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া তেহরানের বিপ্লবী গার্ডের এক গেস্টহাউসে বিস্ফোরণে নিহত হন। পরে ইসরায়েল নিশ্চিত করে, এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে তাদের হাত ছিল। সেপ্টেম্বরে লেবাননে চালানো পেজার হামলায় ইরানের রাষ্ট্রদূত মোজতবা আমিনি এক চোখ হারান। হিজবুল্লাহ সদস্যদের লক্ষ্য করে হামলাটি চালানো হয়েছিল। একই হামলায় অনেকে নিহত ও হাজারও মানুষ আহত হন। ইসরায়েল পরে নিশ্চিত করে, তারা এসে হামলা চালিয়েছিল। একই মাসে লেবাননের রাজধানী বৈরুতের কাছে বিমান হামলায় হিজবুল্লাহপ্রধান হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যা করে ইসরায়েল। অক্টোবরে ইসরায়েলে প্রায় ১৮০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ইরান। হাসান নাসরুল্লাহ, হানিয়া ও এক ইরানি কমান্ডারের হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ হিসেবে সেই হামলা চালানো হয়। অধিকাংশ ক্ষেপণাস্ত্রই ইসরায়েল প্রতিহত করে। অক্টোবরের শেষ দিকে ইসরায়েল ইরানে বিমান হামলা চালায়। এর ফলে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো রক্ষায় ব্যবহৃত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়। ইরান ও ইসরায়েলি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এপ্রিল ও অক্টোবরের হামলাগুলোয় রাশিয়া থেকে কেনা ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে। এর মধ্যে ইরানের মধ্যাঞ্চলের এক খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও ছিল। ইরানের পরমাণু কর্মসূচি সুরক্ষায় এটি ব্যবহার করা হতো।
২০২৫ সালে দীর্ঘ হামলার শুরু : ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে ইরানের পরমাণু স্থাপনায় হামলার পরিকল্পনা দেন। এ নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা কয়েক মাস আলোচনা করেন। পরে এপ্রিলে ট্রাম্প কূটনৈতিক পথ বেছে নেন। তিনি যুদ্ধ নয়, আলোচনার সিদ্ধান্ত নেন। সম্প্রতি ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ করবে না বলে জানায়। তবে পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা চলতে পারে বলে মত দেয়। এ পরিস্থিতিতে হঠাৎ ১৩ জুন ২০২৫ ইরানজুড়ে কয়েক ডজন স্থানে হামলা করে ইসরায়েল।
রাইজিং লায়ন বনাম ট্রুু প্রমিজ থ্রি
ইসরায়েল ১৩ জুন ২০২৫ থেকে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করার লক্ষ্যে ইরানজুড়ে কয়েক ডজন স্থানে আকস্মিক আক্রমণ শুরু করে। এ অভিযানের কোড নাম অপারেশন রাইজিং লায়ন। এর লক্ষ্য ছিল তেহরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির হৃদয়ে আঘাত হানা। হামলার আগে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) তেহরানের ১৮ নম্বর জেলার বাসিন্দাদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। অঞ্চলটিতে সামরিক ভবন ও আবাসিক এলাকা রয়েছে। এর কয়েক ঘণ্টা পর স্থানীয় সময় ভোর সাড়ে ৩টার দিকে তেহরানে প্রথম দফায় হামলার খবর পাওয়া যায়। ইরানের রাষ্ট্রীয় সম্প্র্রচারমাধ্যম জানায়, রাজধানীর আবাসিক এলাকাগুলো হামলার শিকার হয়েছে।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) দাবি, তারা তেহরান থেকে প্রায় ২২৫ কিলোমিটার (১৪০ মাইল) দক্ষিণে অবস্থিত নাতাঞ্জের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে বড় ধরনের ক্ষতি করেছে।
হামলা চালানোর পর ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এক ভাষণে বলেন, ‘ইরানের পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী হওয়ার হুমকি দূর করার জন্য অপারেশন রাইজিং লায়ন যতদিন প্রয়োজন অব্যাহত থাকবে।’ এ বিমান হামলায় নাতাঞ্জ পারমাণবিক স্থাপনা এবং ইসফাহান ইউরেনিয়াম রূপান্তর স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া তাবরিজের কাছে একটি ক্ষেপণাস্ত্র কমপ্লেক্স, কেরমানশাহ ভূগর্ভস্থ ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনা এবং তেহরানের স্থাপনাগুলোতেও আঘাত হানতে শুরু করে ইসরায়েল। অপারেশন রাইজিং লায়নের শক্ত জবাবে প্রতিশোধমূলক হামলার হুমকি দেয় ইরান। অপারেশন ‘ট্রু প্রমিজ থ্রি’ শুরু করে ইসরায়েলে বড় ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। তাদের চালানো শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে তেল আবিবসহ আশপাশের গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি ও স্থাপনায়। গত এক সপ্তাহ ধরে পাল্টাপাল্টি হামলা চালাচ্ছে দেশ দুটি। দুটি দেশই একে অন্যের আকাশ পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার দাবি করে। এ কারণে ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সরাসরি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে বিস্ফোরিত হতে শুরু করে। বাড়ছে প্রাণহানি ও ধংসযজ্ঞ।
কার কত শক্তি
সামরিক বাজেট : প্রতিরক্ষা খাতে ইরান ও ইসরায়েল দুই দেশই প্রচুর অর্থ ব্যয় করে। তবে বার্ষিক সামরিক বাজেটে ইরানের তুলনায় ইসরায়েলের ব্যয় দ্বিগুণের বেশি। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাজেট হলো ২ হাজার ৪৪০ কোটি ডলার; অন্যদিকে ইরানের বাজেট ৯৯৫ কোটি ডলার। এ র্যাংকিংয়ে ১৪৫ দেশের মধ্যে ইরান ৩৩তম অবস্থানে আর ইসরায়েল ১৯তম অবস্থানে রয়েছে।
নিয়মিত সৈন্য : সৈন্যসংখ্যার হিসাবে ইসরায়েলের চেয়ে এগিয়ে আছে ইরান। ইরানের নিয়মিত সেনা আছে ১১ লাখ ৮০ হাজার; যেখানে ইসরায়েলের সৈন্য ৬ লাখ ৭০ হাজার। এর মধ্যে ইরানের রিজার্ভ সৈন্যসংখ্যা সাড়ে তিন লাখ আর ইসরায়েলের রিজার্ভ সৈন্য আছে ৪ লাখ ৬৫ হাজার।
যুদ্ধবিমান : ইরানের মোট সামরিক বিমানের সংখ্যা ৫৫১টি আর ইসরায়েলের আছে ৬১২টি। এর মধ্যে ইরানের যুদ্ধ বিমান আছে ১৮৬টি আর ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান আছে ২৪১টি। ইরানের অ্যাটাকিং বিমান সংখ্যা ২৩টি; যেখানে ইসরায়েলের আছে ৩৯টি। ইরানের পরিবহন বিমান আছে ৮৬টি; ইসরায়েলের আছে ১২টি। ইরানের প্রশিক্ষণ বিমান ১০২টি আর ইসরায়েলের আছে ১৫৫টি।
হেলিকপ্টার : ইরানের হেলিকপ্টার আছে ১২৯টি আর ইসরায়েলের ১৪৬টি। ৪৮টি অ্যাটাক হেলিকপ্টার নিয়ে ইরানের চেয়ে শক্তিশালী ইসরায়েল। ইরানের অ্যাটাক হেলিকপ্টারের সংখ্যা ১৩টি।
ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান : ট্যাংক ও সাঁজোয়া যানের দিক থেকে ইসরায়েলের চেয়ে এগিয়ে আছে ইরান। ইসরায়েলের ট্যাংক আছে ১ হাজার ৩৭০টি আর ইরানের ১ হাজার ৯৯৬টি। সাঁজোয়া যান আছে ইরানের ৬৫ হাজার ৭৬৫টি আর ইসরায়েলের আছে ৪৩ হাজার ৪০৩টি।
আর্টিলারি সক্ষমতা : আর্টিলারি সক্ষমতায় এগিয়ে ইরান; যেখানে তাদের রকেট আর্টিলারি এমএলআরএস-এর সংখ্যা ৭৭৫টি এবং সেল্ফ প্রপেলড আর্টিলারির সংখ্যা ৫৮০টি। অন্যদিকে ইসরায়েলের এদিক থেকে সেল্ফ প্রপেলড আর্টিলারির সংখ্যা ৬৫০টি এবং এমএলআরএস বা রকেট আর্টিলারির সংখ্যা ১৫০টি।
নৌশক্তি : নৌবাহিনীর শক্তির দিক থেকে এগিয়ে আছে ইরান। দেশটির ১০১টি যুদ্ধজাহাজ রয়েছে; যেখানে ৭টি ফ্রিগেট এবং ২১টি টহল জাহাজ। আর ইসরায়েলের যুদ্ধজাহাজ সংখ্যা ৬৭টি। এর মধ্যে টহল জাহাজ আছে ৪৫টি। তবে ইসরায়েলের কোনো ফ্রিগেট নেই।
সাবমেরিন : সাবমেরিনের দিক থেকেও ইরান শক্তিশালী। দেশটির সাবমেরিন আছে ১৯টি; যেখানে ইসরায়েলের সাবমেরিন আছে ৫টি।
পারমাণবিক শক্তি : সুইডেনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই)-এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী- বিশ্বের ৯টি দেশের কাছে প্রায় ১২ হাজার ৫১২টি পারমাণবিক অস্ত্র আছে। দেশগুলো হলো- যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন, ভারত, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া ও ইসরায়েল। এ তালিকায় ইরানের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে পারমাণবিক অস্ত্র কখনোই ছিল না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকবার দাবি করেছে, ইরান তাদের ইউরেনিয়ামের মজুত দিয়ে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চায়। ইরান দাবি করে, তাদের পরমাণু কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ। এদিকে গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেনি কোন দেশের হাতে কতটি এ ধরনের অস্ত্র রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, পারমাণবিক অস্ত্র ক্ষমতার বিষয়টি তারা তাদের প্রতিবেদনে বিবেচনায় নেয়নি।