এশিয়া কাপ ২০২৫-এ পাকিস্তানকে খুব সহজেই হারিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে খেলা নিশ্চিত করলো ভারত।
ভারতের ৭ উইকেটের এই জয় ছাপিয়ে এখন আলোচনায়, ভারতের অধিনায়ক সুরিয়া কুমার ইয়াদাভের পাকিস্তানের ক্রিকেটারদের সাথে ম্যাচ শুরুর আগে ও শেষে সৌহার্দ্যমূলক হাত মেলানোর সৌজন্যতা না দেখানো নিয়ে।
আর এই হাত না মেলানোর ঘটনাকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে মনে করছে পাকিস্তান ক্রিকেট দল, যে কারণে ম্যাচ শেষে আনুষ্ঠানিকতায় পাকিস্তান ক্রিকেট দলের অধিনায়ক সালমান আলি আঘা অংশ নেননি।
সব মিলিয়েই মাঠের খেলার চেয়েও চলতি বছরের এপ্রিলে ভারত শাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসী হামলার রেশ ছিল এই ম্যাচে।
ম্যাচ শেষে ভারতের অধিনায়ক সুরিয়া কুমার ইয়াদাভ বলেন, এই বিশেষ মুহূর্তে আমি কিছু সময় নিতে চাই পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলার শিকারদের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে। আমরা তাদের প্রতি গভীর সংহতি প্রকাশ করছি।
সুরিয়া আরও বলেন, তিনি এই জয় ভারতের সশস্ত্র বাহিনীকে উৎসর্গ করতে চান। আমাদের যারা সবসময় অসীম সাহসের পরিচয় দেন, তাদের বীরত্ব আমাদের অনুপ্রাণিত করে, আর আমরা আশাবাদী, প্রতিবার মাঠে নামলে তাদের মুখে হাসি ফোটানোর মতো আরও অনেক কারণ আমরা উপহার দিতে পারব।
পাকিস্তানের ব্যাটিং কেমন ছিল
অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট লেখক জ্যারড কিম্বারের মতে পাকিস্তানের ব্যাটিং ছিল এই ম্যাচে খুবই করুণ, ইংরেজিতে 'প্যাথেটিক' শব্দটি ব্যবহার করেন পাকিস্তানের ব্যাটিং প্রদর্শনীর ব্যাখ্যা করতে।
ম্যাচের শুরুতেই সাইম আইয়ুবের উইকেট হারায় পাকিস্তান, হার্দিক পান্ডিয়ার আপাত দৃষ্টিতে সহজ একটা বলে তিনি পয়েন্টে ক্যাচ তুলে আউট হয়ে যান, যার গতি ছিল ১৩০ এরও কম।
সাইম আইয়ুব এই গোল্ডেন ডাকের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের ব্যাটারদের মধ্যে টি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি গোল্ডেন ডাক অর্থাৎ প্রথম বলেই আউট হওয়ার অনাকাঙ্ক্ষিত রেকর্ড গড়েছেন। সাইম এ নিয়ে চারবার গোল্ডেন ডাকের শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে এই এশিয়া কাপেই টানা দুইবার, প্রথম ম্যাচে ওমানের বিপক্ষে, দ্বিতীয় ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে।
পাকিস্তানের বাকি ব্যাটারদের আউট দেখলেও মনে হবে ভারতের বোলারদের কারিশমার চেয়ে পাকিস্তানের ব্যাটারদের শট সিলেকশন ও দক্ষতার ঘাটতি ছিল, বলছেন জ্যারড কিম্বার।
পাকিস্তানের ব্যাটিং লাইন আপের শুরুর ছয়জন ব্যাটারই ক্যাচ তুলে আউট হয়েছেন।
পাকিস্তানের সাবেক তারকা ফাস্ট বোলার শোয়েব আখতার পাকিস্তানের ক্রিকেট দলটিকে সহযোগী দেশগুলোর চেয়ে সামান্য ভালো দল হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
ম্যাচ শেষে পাকিস্তানের এক টেলিভিশন চ্যানেলে আলোচনায় শোয়েব আখতার পাকিস্তান ক্রিকেট দলের ব্যাটারদের নিয়ে নিজের হতাশা প্রকাশ করেন, দেখেন অনেকে অনেক কথা বলবে, উইকেট পরিস্থিতি এসব নিয়ে। কিন্তু আপনি ভারতের ব্যাটারদের শট সিলেকশন দেখেন। শুধু চার ছক্কা নির্ভর নয়, এই কাট করছেন, এই কিছুটা ধীরে বল ঠেলে দিয়ে এক নিচ্ছেন দুই নিচ্ছেন, সুইপ করছেন।
বিশেষত সুরিয়াকুমার ইয়াদাভ ও তিলক ভার্মার ব্যাটিং-এর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন পাকিস্তানের এই সাবেক ফাস্ট বোলার।
‘পাকিস্তান ক্রিকেট দল এখন ক্লাব লেভেলের ক্রিকেট খেলছে আর ভারত খেলছে বিশ্বমানের- পার্থক্যটা অনেক বড়’, এভাবেই নিজের ক্ষোভ ঝাড়ছিলেন শোয়েব।
ভারত কোথায় ম্যাচটা জিতে নিলো?
কুলদীপ যাদবের নেতৃত্বে স্পিনাররা দারুণ বোলিং করে পাকিস্তানকে ১২৭ রানে আটকে রাখে। জবাবে ব্যাট হাতে সহজেই লক্ষ্য ছুঁয়ে ফেলে ভারত, হাতে থাকে আরও ২৫ বল।
যদিও পাকিস্তান ছয় রানের মধ্যেই ২ উইকেট হারিয়েছিল তবে ম্যাচের মোড় ঘুরেছে মধ্য ওভারের খেলায়। এই সময়ে ভারতের স্পিন আক্রমণের সামনে পাকিস্তান ব্যাটাররা রানের গতি ধরে রাখতে পারেনি, প্রতি ওভারে গড়ে চার রানের বেশি তুলতে পারেনি।
অন্যদিকে ভারত মধ্য ওভারে নিয়মিত রান সংগ্রহ করেও মাত্র একটি উইকেট হারায়। পাকিস্তান এই পর্যায়ে চারটি উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে যায়, যেখান থেকে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি পাকিস্তান।
পাকিস্তানের শাহীন শাহ আফ্রিদি যিনি মূলত একজন ফাস্ট বোলার তিনি ব্যাট হাতে ১৬ বলে ৩৩ রানের একটি ইনিংস খেলেন, যেখানে তিনি চারটি ছক্কা হাঁকান।
আফ্রিদি এমন ইনিংস না খেললে পাকিস্তানের পরাজয় হতো আরও শোচনীয়।
ভারতের হয়ে এই ম্যাচে সেরা বোলার ছিলেন বাঁহাতি স্পিনার কুলদীপ ইয়াদাভ, ১৮ রান দিয়ে ৩টি উইকেট নিয়েছেন তিনি।
চলমান এশিয়া কাপে ইতোমধ্যে কুলদীপ ৭ উইকেট নিয়েছেন।
পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার ওয়াহাব রিয়াজ ইএসপিএন ক্রিকইনফোর বিশ্লেষণে বলেন, "কুলদীপ ব্যাটারদের মন পড়তে পারেন, এটা তাকে সবসময় এক ধাপ এগিয়ে রাখে। তার অনেক বৈচিত্র্য আছে। এটাই বড় শক্তি।"
ভারুণ, কুলদীপ আর আকসারের স্পিন আক্রমণে আঁটসাঁট ক্রিকেট খেলতে বাধ্য হয় পাকিস্তান। পাওয়ারপ্লের পর প্রথম বাউন্ডারি পেতে পাকিস্তানের লেগে যায় ৩১ বল।
এর মধ্যে দল তুলতে পারে মাত্র ১২ রান আর হারায় দুই উইকেট। ফখর জামান ও সালমান আগা দু'জনই চাপ সামলাতে গিয়ে অযথা শট খেলতে গিয়ে আউট হন।
পাকিস্তানের বোলিং-এর সামনে ভারতের সাহসী ব্যাটিং
জনপ্রিয় ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার হারশা ভোগলে অভিষেক শর্মার ব্যাটিং দেখে বলেন, ‘তার মধ্যে কোনও সম্মান দেখানোর ব্যাপার ছিল না, হয় সোজা ছক্কা নতুবা বল তুলে দিয়ে ছক্কা মেরেছেন অভিষেক। মনেই হয়নি তিনি শাহিনকে খুব একটা পাত্তা দিয়েছেন।’
অভিষেক মূলত ভারতকে একটা উড়ন্ত সূচনা এনে দিয়েছেন, যা এই ১২৮ রানের লক্ষ্যকে আরও ছোট করে নিয়ে আসে। পাওয়ারপ্লেতে ভারত ৬১ রান তুলে নিয়েছে, যা মোট লক্ষ্যের প্রায় অর্ধেক। যার মধ্যে অভিষেক শর্মা ১৩ বলে নিয়েছেন ৩১ রান।
ক্রিকেট পোর্টাল ক্রিকবাজের ম্যাচ পরবর্তী আলোচনায় ভারতের সাবেক উইকেট কিপার দিনেশ কার্তিক ও হারশা ভোগলে বলেন, যদি টার্গেট ১৬০ রানও হতো ভারত অনায়াসে ৮-১০ বল হাতে রেখেই জিতে যেত।
কারণ হিসেবে তারা বলেন পাকিস্তানের বোলারদের কখনওই এই ম্যাচে ভীতিকর মনে হয়নি। বরং পাকিস্তান ক্রিকেট দলের মূল শক্তি ফাস্ট বোলিং, সেই ফাস্ট বোলারদের মাত্র ২ ওভার বল করিয়েছেন অধিনায়ক।
শাহীন শাহ আফ্রিদির সেই ২ ওভারে রান এসেছে ২৩, আফ্রিদি সুইং পাচ্ছিলেন না। হারশা ভোগলে মনে করেন, পাকিস্তানের সব অধিনায়কই শাহিনের মতো একজন বোলারের দিকেই ভরসা করে, আর সেই শাহীন সুইং না পাওয়া মানে পাকিস্তানের জন্য হতাশাজনক।
ভারতের অধিনায়ক সুরিয়া ৩৭ বলে ৪৭ রান তুলেছেন, আর তিলক ভার্মা ৩১ বলে ৩১ রান করেছেন। ভারতের আরেক ক্রিকেটার রাভিচান্দ্রান আশ্বিন নিজের ইউটিউব চ্যানেলে বলেছেন, ‘পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে ক্রিকেটের মান দেখিয়েছে ভারত। এবারের এশিয়া কাপ থেকে আয়োজকদের শিক্ষা নিতে হবে, পাকিস্তান ভারত ম্যাচ বেশি বেশি দেয়ার কোনও মানে হয় না।’
ভারতের এই টি-টোয়েন্টি দলটিকে ইতিহাসের সেরা টি-টোয়েন্টি দলগুলোর একটি বলছেন আশ্বিন।
বিডি প্রতিদিন/জুনাইদ