মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক ও বিদ্রোহী কবি। তাঁর লেখা মেঘনাদবধ কাব্য আমাদের সাহিত্যে শুধু এক ব্যতিক্রমী কাব্য নয়, বরং এক গভীর মননচর্চার দৃষ্টান্ত। এই কাব্যে তিনি যে সাহসিকতার সঙ্গে সনাতন ধর্মের প্রচলিত পৌরাণিক বিশ্বাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, তা অভূতপূর্ব ঘটনা। এ প্রশ্ন তোলার মাধ্যমেই তিনি দাঁড়িয়েছেন প্রচলিত ধর্মবোধের বাইরে এক নতুন চিন্তার ভিত্তিতে।
রামায়ণ-ভিত্তিক কাব্য হলেও মধুসূদন এ কাব্যে রামচন্দ্রকে দেবতা বা নৈতিকতার প্রতীক হিসেবে মেনে নেননি। বরং তিনি মেঘনাদ, যিনি রাবণের পুত্র এবং রামের দৃষ্টিতে ‘অসুর’, তাকেই তুলে ধরেছেন মহৎ, বলিষ্ঠ, আত্মোৎসর্গকারী বীর হিসেবে। মেঘনাদ যেন তাঁর কাব্যের প্রতীক চরিত্র, যিনি প্রতিষ্ঠিত ধর্ম ও নৈতিকতার নামে পরিচালিত রাজনৈতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছেন। কবি যেন প্রশ্ন করেন, সত্যিই কি রাম ধর্মের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন? নাকি রাজ্যলোভই ছিল তাঁর মূল চালিকাশক্তি?
তিনি বলেন, “কে বলে রাম ধর্মরত? রাম কি দেবতা? রাজ্যলোভে বিজয়ী, তবু সে অপ্রিয় বতা।”
এ লাইনটি তৎকালীন সমাজে তীব্র ঝাঁকুনি দিয়ে বেজে উঠেছিল। কারণ হিন্দু ধর্মে রাম একজন পূজিত অবতার, তাঁকে প্রশ্ন করা মানেই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মূল কাঠামোতে আঘাত হানা। কিন্তু মধুসূদনের দৃষ্টি ছিল মানবিকতা আর ন্যায়বোধে। ধর্মীয় চরিত্র নয়, বরং মানুষকে সামনে নিয়ে আসাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। এ কারণে মেঘনাদ, যিনি ধর্মের ভাষায় অসুর, তাঁর কাব্যে হয়ে উঠেছেন ন্যায়পক্ষের প্রতিনিধি।
মধুসূদনের এই বিদ্রোহ শুধু ধর্মবোধের বিরুদ্ধেই নয়, কাব্যিক রীতিরও বিরুদ্ধে। তিনি সংস্কৃত প্রভাবিত রোমান্টিক কবিতা ছেড়ে পাশ্চাত্য ধাঁচের অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেন। এতে কাব্য হয়ে ওঠে অধিকতর নাটকীয়, গম্ভীর ও গভীর। তিনি বাংলা ভাষায় প্রথম ইউরোপীয় মহাকাব্যের রীতি অনুসরণ করে কাব্যকে দার্শনিক এবং রাজনৈতিক বিতর্কের স্তরে নিয়ে গেছেন। তাঁর কাছে কাব্য শুধু অলংকার নয়, ছিল প্রশ্ন তোলার মাধ্যম।
মেঘনাদবধ কাব্যের প্রতিটি স্তবকে দেখা যায় এই প্রশ্ন। রাবণকে তিনি এক পিতা, একজন রাজা এবং এক বুদ্ধিমান শাসক হিসেবে উপস্থাপন করেন, যিনি নিজের ধর্ম, সংস্কৃতি এবং স্বরাজ রক্ষার জন্য লড়াই করছেন। আর মেঘনাদ তাঁর সন্তান, যিনি সেই সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করেন। এ অবস্থানে এসে কাব্য কেবল পৌরাণিক গাথা নয়, হয়ে ওঠে উপনিবেশিক বাস্তবতার প্রতীক। যেমন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে পরাধীন ভারতের স্বপ্ন বুনেছিলেন বিপ্লবীরা, তেমনই রাবণ পরিবার যেন হয়ে ওঠে এক শোষিত রাষ্ট্রের আত্মসম্মান।
এখানে মধুসূদনের আত্মজৈবনিক অভিজ্ঞতাও প্রাসঙ্গিক। তিনি নিজে হিন্দু সমাজের গোঁড়ামির কারণে বিদ্রোহী হয়েছিলেন। তাঁর খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ, ইউরোপীয় শিক্ষায় দীক্ষিত হওয়া, ধর্মীয় রীতিনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া, সবই এক ধরনের সমাজ-বিদ্রোহ। এই জীবনের প্রতিবিম্বই যেন মেঘনাদবধ কাব্যর মূল সুরে বাজে।
তাই বলা যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্তের এই কাব্য বাংলা সাহিত্যে কেবল একটি রূপান্তর নয়, বরং এক মানসিক মুক্তিযুদ্ধ। তিনি দেখিয়েছেন, সাহিত্য কেবল পুরাণের পুনরাবৃত্তি নয়; সাহিত্যের কাজ হচ্ছে সেই পুরাণকে প্রশ্ন করা, তার নিচে চাপা পড়ে থাকা নিস্তব্ধ কণ্ঠস্বরগুলোকে তুলে আনা। মেঘনাদের মৃত্যু ঘটে শরীরে, কিন্তু তাঁর আত্মসম্মান ও সংগ্রামের চেতনা হয়ে ওঠে অমর।
উত্তর ঔপনিবেশিক বিশ্লেষণ : মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্য উত্তর ঔপনিবেশিক পাঠের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পাঠ্য। এই কাব্যে পুরাণের প্রচলিত বয়ানকে উপেক্ষা করে কবি যেভাবে ‘অসুর’ মেঘনাদকে নায়কের মর্যাদা দিয়েছেন এবং ‘অবতার’ রামচন্দ্রকে আক্রমণকারী শক্তি হিসেবে তুলে ধরেছেন, তা এক ধরনের সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের ইঙ্গিত দেয়। ঔপনিবেশিক আধিপত্য যেভাবে উপনিবেশিত সমাজে ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গি আরোপ করে, তেমনিভাবে রামায়ণের আর্যকেন্দ্রিক বয়ান দক্ষিণের সংস্কৃতিকে অবদমিত করে। মধুসূদনের কাব্যে রাবণ এবং তাঁর পুত্র মেঘনাদ যেন সেই অবদমিত স্বরকে পুনরুদ্ধার করেন। রাম এখানে ঔপনিবেশিক শক্তির প্রতীক, যিনি ‘ধর্ম’ বা ‘নীতির’ নামে ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ওপর আক্রমণ করেন। অন্যদিকে রাবণ ও মেঘনাদ হয়ে ওঠেন উপনিবেশিত জাতিসত্তার প্রতিনিধি, যাঁরা আত্মমর্যাদা রক্ষার জন্য আত্মোৎসর্গ করেন। এভাবে কাব্যটি ভারতীয় জাতিসত্তার গভীরে লুকিয়ে থাকা প্রাচীন বিরোধ এবং ঔপনিবেশিক বাস্তবতার সমান্তরাল চিত্র নির্মাণ করে।
উপনিবেশিত মানুষের কণ্ঠস্বর প্রায়শই মূল পাঠ্যে অনুপস্থিত থাকে। মধুসূদন এই অনুপস্থিত কণ্ঠকেই পুরাণের প্রেক্ষাপটে তুলে ধরেছেন। তিনি সেই কণ্ঠকে মহাকাব্যের স্তরে স্থাপন করে সাহিত্যে নতুন প্রতিরোধী বয়ান নির্মাণ করেন।
তাঁর নিজের জীবনও ছিল এই উত্তর-ঔপনিবেশিক দ্বন্দ্বে ভরা- ইংরেজি শিক্ষায় দীক্ষিত হয়েও তিনি বাংলা ভাষার মধ্য দিয়েই নিজের অবস্থান নির্মাণ করতে চেয়েছেন। তাই তাঁর কাব্য শুধু পুরাণভিত্তিক বিদ্রোহ নয়, বরং তা এক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনচেতা চেতনার বহিঃপ্রকাশ।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে মেঘনাদবধ কাব্য শুধু একটি সাহিত্যিক রূপান্তর নয়; এটি ভারতীয় উপনিবেশিত পাঠকের আত্মপ্রতিষ্ঠার এক সাহসী ঘোষণা।