হিমেল মামাকে আড়ালে আমরা পাগলা মামা বলেই ডাকি। এর পেছনে কারণও আছে ঢের। সবচেয়ে বড় কারণটা হচ্ছে- একজন বড় বৈজ্ঞানিক হয়েও তিনি এমন সব কাজকম্মে মেতে থাকেন, যা পাগলামির পর্যায়েই পড়ে। তুখোড় মেধাবী ছাত্র ছিলেন। পড়তে গিয়েছিলেন মার্কিন মুলুকের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঝানু ঝানু অধ্যাপককে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন মেধায়। বিদেশে পড়তে গেলেও তার মাথায় কিলবিল করতে থাকত দেশ আর দেশের মানুষের চিন্তা। বায়ো-কেমিস্ট্রির ছাত্র ছিলেন। পড়াশোনার ফুরসতে তার মগজটা আঁতিপাঁতি করে খুঁজতে থাকত কী করে পাটের হারানো গৌরব ফিরিয়ে এনে একে আরও আকর্ষণীয় লাগসই কাজে লাগানো যায়!
ডক্টরেট করার সময় বেছে নিয়েছিলেন এই পাটকেই। নির্দিষ্ট যে বিষয় নিয়ে ডক্টরেট করছিলেন, একদিন তার বাইরে এক অদ্ভুত ধারণা খুলে গেল তার মাথায়। ল্যাবে কাজ করার ফাঁকে যে অধ্যাপকের অধীনে কাজ করছিলেন তাকে খুলে বললেন ব্যাপারটা। শুনে সেই অধ্যাপকের মুখ হাঁ হয়ে গেল। তুমুল উৎসাহ দিয়ে জানালেন- ‘কাজে লেগে পড়ো। আমি কথা দিচ্ছি, এ গবেষণায় সফল হলে তোমার আবিষ্কার নাসার মহাশূন্যযানে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করে দেব। কারণ শুনে আমার মনে হচ্ছে, সেখানে প্রচলিত ধাতুর চেয়ে তোমার প্রোডাক্ট অনেক বেশি কার্যকর হবে।’ রুমে ফিরে এ নিয়ে একটু ভাবতেই চোয়াল শক্ত হয়ে গেল হিমেল মামার। মনে মনে বললেন, ‘হুহ! আমার বয়েই গেছে স্যারের কথার টোপ গিলতে! আমি আবিষ্কার করব আর উনি দিব্যি নিজের নামে তার প্যাটেন্ট করিয়ে নেবেন! সেটি হচ্ছে না।’ তবে মনের সে কথা মনেই পাথরচাপা দিয়ে রাখলেন। ডক্টরেট করে মাস ছয়েক অধ্যাপনা করলেন স্যাম চাচাদের দেশেই। সেই অধ্যাপক তার পিছু লেগেই ছিলেন। প্রলোভনের পর প্রলোভনের মুলো ঝুলিয়ে যাচ্ছিলেন হিমেল মামার নাকের ডগায়। এরপর একদিন হুট করে তিনি চলে এলেন দেশে। কিছুকাল অধ্যাপনা করে যোগ দিলেন এক সরকারি গবেষণাগারে।
তখন থেকেই শুরু হয়ে গেল তার আসল পাগলামি। দেশীয় অপ্রচলিত পণ্য থেকে একের পর এক এমন সব জিনিস আবিষ্কার করতে থাকলেন যে তাক লেগে গেল দেশের শিল্পোদ্যোক্তা মহলে। তারা সেসব জিনিসের কারখানা খুলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানিরও উদ্যোগ নিলেন।
এত বড় বৈজ্ঞানিক হলেও মামি তাকে সব সময় রামছাগল ডাকেন। কারণটা সেই একই- আমরা যে কারণে তাকে পাগলা মামা বলে ডাকি। মার্কিন দেশে অমন রাজকীয় ভবিষ্যৎ ছেড়ে কেউ দারিদ্র্য-দুর্নীতিপীড়িত দেশে এসে পচে মরে!
তো সেই পাগলা মামার পাগলামি দেখতেই তার ল্যাবে গিয়েছিলাম আজ। মাস্টার্স শেষ করে অস্ট্রেলিয়ার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার স্কলারশিপের অপেক্ষা করছি। সাবজেক্টটাও মামার প্রায় কাছাকাছি। ফেরার পথে বাসে আমার সামনের সিটে ষণ্ডামার্কা দুই যুবক বসে এমনভাবে কথাবার্তা বলছিল যে মেজাজটা কেবলই চড়ে যাচ্ছিল আমার। কিন্তু করার কিছু ছিল না, এমনকি বলারও কিছু ছিল না। ভয় হচ্ছিল- মুখ খুললে আমাকে বাস থেকেই নামিয়ে দিতে পারে! যা ওদের দাপট শুনছি কথাবার্তায়! চলেছি ঢাকার এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে। দীর্ঘ যানজটে আটকে ছিল আমাদের বাসটা। গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল সামনের জানালার পাশে বসা যুবকের মোবাইল ফোনে ধমকা-ধমকিতে। কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছিল সে সরকারি কোনো ব্যাংকের কর্মচারীদের নেতা গোছের কেউ। কোনো এক বড় ব্যাংক অফিসারকে শাসিয়ে যুবকটি বলছিল, ‘চাকরি করণের ইচ্ছা আছে, না নাই! যুদি ইচ্ছা থাইক্যা থাকে তাইলে লোনডা ঝটপট পাস কইরা দেন।’ এরপর সে কিছুটা মোলায়েম কণ্ঠে তার এক কলিগকে ফোনে বলতে থাকল, ‘ভাইজান, আমার দুইখান বিল আছিল। একখান বিশ লাখ ট্যাকার, অন্যখান বারো লাখের। আইজই ছাইড়া দিয়েন। অফিসে ফিরা আপনারে খুশি কইরা দিমুনে।’ অবাক না হলেও ভুরু কুঁচকে ভাবলাম- চমৎকার! বাসে বসেই অফিস করা যাচ্ছে- ডিজিটাল ফায়দা!
ঘরে ফিরে আজকের অভিজ্ঞতা নিয়ে ভাবতে ভাবতে খেই হারিয়ে ফেললাম। পাগলা মামা- কেতু। ষণ্ডা যুবক- রাহু। মেলাতে পারছিলাম না ভবিষ্যতে কে কার গ্রাস!