ভারতের রাজধানী দিল্লির গাজিপুর, ভলসওয়া ও ওখলা—এই তিনটি ল্যান্ডফিল সাইট এখন পরিণত হয়েছে ‘মরণফাঁদে’। গ্রীষ্মে এখানে তাপমাত্রা ওঠে ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, বাতাসে মিশে থাকে মিথেনসহ নানা বিষাক্ত গ্যাস। বছরের পর বছর এসব স্থানে কাজ করে যাচ্ছেন হাজারো অনানুষ্ঠানিক ময়লা শ্রমিক, বর্জ্য সংগ্রাহক। নিয়মিয়তই ঝুঁকিতে যাদের জীবন ।
নয়াদিল্লির গাজিপুর ল্যান্ডফিল, যা বর্তমানে প্রায় ৬৫ মিটার (২০ তলা সমান) উঁচু, দিল্লির বর্জ্য সংকট ও জলবায়ু বিপর্যয়ের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছেন ৩৮ বছর বয়সী সোফিয়া বেগম। ২০২২ সালে চিকিৎসা বর্জ্যের সংস্পর্শে এসে তার ডান চোখে সংক্রমণ হয়, গরমে তা ফুলে ওঠে। সার্জারির জন্য প্রয়োজন প্রায় ৩০ হাজার রুপি, যা জোগাড় করা তার পক্ষে অসম্ভব।
৩২ বছরের তানজিলা গত বছর প্রচণ্ড রোদে অজ্ঞান হয়ে পড়ার পর এখন মূলত রাতে কাজ করেন। তিনি জানান, দিনের বেলায় মনে হয় যেন "চুল্লির ভেতর" আছি। কিন্তু রাতেও বিপদ কম নয়—কারণ তখন ভারী যান ও মেশিন চলাচল করে, আগুন বা গ্যাস লিক স্পষ্টভাবে দেখা যায় না।
শেখ আকবর আলী, ‘বাস্তি সুরক্ষা মঞ্চ’-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা, জানান—এখানে গ্রীষ্মে মিথেন গ্যাস ও ধোঁয়ার প্রভাবে শ্বাসকষ্ট, ত্বকের রোগ এবং দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে। ২০২০ সাল থেকে দিল্লিতে ১২৪টি বড় মিথেন লিক সনাক্ত হয়েছে, এর মধ্যে ২০২১ সালে গাজিপুরে ঘণ্টায় ১৫৬ টন মিথেন নির্গমনের ঘটনা সবচেয়ে বড়।
সরকার একাধিকবার ‘আবর্জনার পাহাড়’ সরানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে খুব অগ্রগতি নেই। মে ২০২৫-এ দিল্লির পরিবেশমন্ত্রী মানজিন্দর সিং সিরসা ঘোষণা দেন—২০২৮ সালের মধ্যে ল্যান্ডফিল সরানো হবে। অথচ তার আগের মাসেই তিনি দাবি করেছিলেন, এগুলো পাঁচ বছরের মধ্যে ‘ডাইনোসরের মতো’ হারিয়ে যাবে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন—ল্যান্ডফিলের বিকল্প হিসেবে প্রস্তাবিত ইনসিনারেটরগুলোও পরিবেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ এগুলো থেকে ডাইঅক্সিন, পারদ ও ক্ষতিকর কণা নির্গত হয়। ভারতী চতুর্বেদী, ‘চিন্তন এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ অ্যান্ড অ্যাকশন গ্রুপ’-এর প্রতিষ্ঠাতা, বলেন—“এটি শুধু আবর্জনা সরানোর বিষয় নয়, বরং বর্জ্য সংগ্রাহকদের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ও জীবিকা নিশ্চিত করার বিষয়।”
পরিবেশবিদরা সমাধান হিসেবে স্থানীয় পর্যায়ে বর্জ্য আলাদা করা, ওয়ার্ডভিত্তিক কম্পোস্টিং, কার্যকর পুনর্ব্যবহার এবং বর্জ্য সংগ্রাহকদের জন্য আইনি স্বীকৃতি, সুরক্ষা সরঞ্জাম ও ন্যায্য মজুরির দাবি জানিয়েছেন।
তবে গাজিপুরের বাস্তবতা এখনও বদলায়নি। প্রতিদিনের তীব্র গরম, দুর্গন্ধ ও অসুস্থতার মাঝেও শ্রমিকরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন—কারণ, তাদের ভাষায়, “আবর্জনাই আমাদের সোনা—এটাই পরিবারকে খাওয়ায়।”
মূল লেখক: মুবারশির নায়েক, পূরভি গুপ্তা
সোর্স: আল জাজিরা
বিডি প্রতিদিন/আশিক