বাংলাদেশের রাষ্ট্রগঠনের ইতিহাসে সশস্ত্র বাহিনী কেবল একটি প্রতিরক্ষা সংগঠন হিসেবে সীমাবদ্ধ ছিল না—বরং এটি হয়েছে জনগণের চেতনার ধারক, সংকটে বিবেকের সেতু এবং রূপান্তরের চালক।
আমাদের এই জাতীয় অভিযাত্রায় নানা সময়ে সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা যেমন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, তেমনি বারবার তারা জাতীয় ঐক্য, স্থিতিশীলতা ও ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের পথে এক অপরিহার্য সহচর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম—বাংলাদেশের এক বিশেষ সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক পরিসর—রাষ্ট্রগঠনের সূচনালগ্ন থেকেই একাধিক নিরাপত্তা, পরিচয় এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। ১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে যখন এই অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদ ও সশস্ত্র চ্যালেঞ্জ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তখন রাষ্ট্র তার অস্তিত্ব রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনীকে আহ্বান জানায়। এই ভূমিকায় সশস্ত্র বাহিনীর অংশগ্রহণ কেবল শক্তি প্রয়োগে সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং মানবিক সহায়তা, অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষা-স্বাস্থ্য সেবা এবং স্থানীয় জনজীবনের সঙ্গে মেলবন্ধনে পরিণত হয়।
এ অঞ্চলে সশস্ত্র বাহিনী শুধু অপারেশন চালায়নি, তারা রাস্তা নির্মাণ করেছে, স্কুল গড়ে তুলেছে, দুর্গম পাহাড়ে রাষ্ট্রের সংযোগ তৈরি করেছে। একজন সৈনিক সেখানে কেবল অস্ত্রধারী নয়, একজন পরামর্শদাতা, চিকিৎসক, শিক্ষক এবং প্রয়োজনে স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিনিধিও হয়ে উঠেছে। এটি ছিল এক ধরনের ‘মানবিক প্রতিরক্ষা কৌশল’, যা আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় এক অগ্রসর দৃষ্টান্ত।
তবে, পার্বত্য চট্টগ্রামের মত বহুবিচিত্র সংকট যখন দেশজুড়ে রাজনীতিক অস্থিরতায় মিলিত হয়, তখন সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা হয়ে ওঠে আরও গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু একই সঙ্গে আরও সংবেদনশীল।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর জাতীয় নেতৃত্বে এক শূন্যতা সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো তখন দুর্বল, প্রশাসন ও জনগণ বিভ্রান্ত। ঠিক এই শূন্যতার মাঝেই একের পর এক পালাবদলের মধ্য দিয়ে জাতি হারাতে থাকে তার গন্তব্যচিহ্ন।
এই প্রেক্ষাপটে, ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর এক ঐতিহাসিক অধ্যায়ের সূচনা করে—যা আজ ‘সিপাহী-জনতার বিপ্লব’ হিসেবে পরিচিত। এ বিপ্লব ছিল মূলত এক আত্মপ্রতিরক্ষামূলক অভ্যুত্থান, যেখানে সশস্ত্র বাহিনীর নিম্নপদস্থ সিপাহীরা এবং সাধারণ জনতা একত্রিত হয়ে একটি লক্ষ্যবিহীন, নেতৃত্বশূন্য রাষ্ট্রব্যবস্থাকে রূপান্তরের পথে এগিয়ে দেয়।
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এই বিপ্লবের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসেন—একজন প্রাজ্ঞ, পেশাদার সশস্ত্র বাহিনীর সেনানায়ক হিসেবে নয় শুধু, বরং একজন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে। তার নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনী একটি নিরপেক্ষ অথচ দায়িত্বশীল কাঠামোয় নিজেদের পুনর্গঠিত করে। সেদিনের সেই বিপ্লব ছিল না কোনো কুচক্রী মহলের চক্রান্ত, বরং ছিল বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পথচলার ভিত্তি নির্মাণের এক সাহসী চেষ্টা।
৭ই নভেম্বর-এর ঘটনার মাধ্যমে বাংলাদেশে যে ‘সশস্ত্র বাহিনীর নেতৃত্বের পুনঃসংজ্ঞায়ন’ ঘটে, তা বাহিনীর অভ্যন্তরেও একটি আদর্শিক রূপান্তর নিয়ে আসে। পেশাদারিত্ব, শৃঙ্খলা এবং জাতীয় কর্তব্যবোধ এই রূপান্তরের মূল ভিত্তি হয়ে ওঠে। জিয়াউর রহমানের অধীনে সশস্ত্র বাহিনী আত্মপ্রত্যয়ী ও দায়িত্বশীল হয়ে ওঠে, যারা একনায়কতন্ত্র নয়, গণতন্ত্রের ভিত মজবুত করতে চেয়েছিল।
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদতের বরণের কিছুদিন পর দেশ আবার আরেক স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দিকে ধাবিত হয়। আর তখনই পুনরায় একটি স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন মাথাচাড়া দেয়, তখনও সশস্ত্র বাহিনীর অবস্থান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তখনকার সশস্ত্র বাহিনীর নেতৃত্ব রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা ও গণদাবির প্রতি শ্রদ্ধার অনন্য নজির স্থাপন করে।
তারা শাসকের পক্ষে দাঁড়ায়নি, আবার জনতার রাস্তাও অবরুদ্ধ করেনি। বরং তারা এমন এক নীতিনির্ভর অবস্থানে থেকেছে, যা দেশকে রক্তক্ষয়ী সংঘাত থেকে বাঁচিয়ে দেয়। সেই সময়কার সশস্ত্র বাহিনী কৌশলী, পরিপক্ব এবং গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন বলে ইতিহাসে চিহ্নিত হয়েছে।
এটি ছিল সেই ৭ই নভেম্বরের রূপান্তরের একটি স্বাভাবিক ধারাবাহিকতা—যেখানে সশস্ত্র বাহিনী কেবল রাজনৈতিক সংকট সমাধানে নয়, বরং একটি নৈতিক ভারসাম্যের প্রতীক হিসেবে কাজ করে।
নিকট অতীতে, ২০২৪ সালে, যখন দেশে নতুন ধারার গণআন্দোলন শুরু হয়—বিশেষ করে দুঃশাসন, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং রাষ্ট্রের অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে—তখনো সশস্ত্র বাহিনীর অবস্থান ছিল যথাযথভাবে সংযত, গণমুখী এবং রাষ্ট্রীয় ভারসাম্য রক্ষায় নিয়োজিত।
তারা কোনো দমন-পীড়নের অংশ হয়নি, বরং সরকারের রাজনৈতিক অংশীদার না হয়ে জনগণের অনুভূতির প্রতি সম্মান দেখিয়েছে। তারা ছিল এক শান্তিপূর্ণ মধ্যস্থতা—যেখানে সংলাপ, স্থিতিশীলতা এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের বার্তা কেন্দ্রীভূত ছিল। এ সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সশস্ত্র বাহিনীর সরব উপস্থিতি না থাকলেও, তাদের নীতিগত অবস্থান রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে এনেছে।
স্বীকার করতে হবে, সশস্ত্র বাহিনীর অভ্যন্তরে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু সদস্য একনায়কতন্ত্র, বিদেশি প্রভাব কিংবা রাজনীতিক উচ্চাভিলাষ ধারণ করে থাকেন। তবে বাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক নেতৃত্ব ও আদর্শ বারবার এমন অপচেষ্টাকে প্রতিহত করেছে। এই আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং নৈতিকতা একটি পরিপক্ব বাহিনীর পরিচয় বহন করে।
বর্তমান সশস্ত্র বাহিনী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, মানবিক সহায়তা, শিক্ষা, অবকাঠামো নির্মাণ, জাতীয় দিবস উদযাপন এবং এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি রক্ষার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তারা আজ এক ‘সামাজিক প্রতিরক্ষা কাঠামো’—যার মধ্যে রয়েছে পেশাদার দক্ষতা, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা, এবং সর্বোপরি এক মানবিক চেতনা।
আধুনিক বিশ্বে সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। কূটনীতি, প্রযুক্তি, অর্থনীতি এবং জনসম্পৃক্ততা—সব মিলিয়ে সশস্ত্র বাহিনী এখন একটি বহুমাত্রিক প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীও এই অভিযাত্রায় অংশগ্রহণ করছে—জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে তাদের সফলতা, দারিদ্র্য-পীড়িত অঞ্চলে ত্রাণ কার্যক্রম, সাইবার নিরাপত্তায় নতুন পদক্ষেপ—সবই এই পরিবর্তনের নির্দেশক।
জনগণ চায় একটি নিরপেক্ষ, পেশাদার, সংবেদনশীল এবং গণমুখী সশস্ত্র বাহিনী—যারা অস্ত্রের চেয়ে বিবেককে প্রাধান্য দেয়। যারা জাতীয় সংকটে সাড়া দেয়, কিন্তু ক্ষমতার খেলায় ব্যবহৃত হয় না।
এখানেই নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম এবং রাজনীতিকদেরও একটি দায়িত্ব আছে—সশস্ত্র বাহিনীর পেশাদারিত্ব এবং অরাজনৈতিক অবস্থানকে সম্মান করা, তাদের অনুপ্রেরণা জোগানো এবং কোনো পক্ষের হাতিয়ার বানানোর অপচেষ্টা থেকে বিরত থাকা।
সুতরাং, ৭ই নভেম্বরের বিপ্লব, পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবিক প্রতিরক্ষা, ১৯৯০-এর গণআন্দোলনের সময়কার সংযত দৃষ্টিভঙ্গি এবং ২০২৪-এর সমসাময়িক গণজাগরণে মধ্যস্থ ভূমিকা—সবমিলিয়ে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী আজ জাতির এক নির্ভরতার প্রতীক। তারা কেবল অস্ত্রধারী নয়, তারা হল বিবেকধারী—জাতীয় সংকটে এক প্রাজ্ঞ সহচর।
এই যুগে এসে আমাদের উচ্চারণ হওয়া উচিত—“সশস্ত্র বাহিনী কেবল অস্ত্রধারী নয়, তারা হল জনগণের নির্ভরতা, রাষ্ট্রের বিবেক এবং গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার এক গুরুত্বপূর্ণ সহচর।”
লেখক: সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
বিডি প্রতিদিন/নাজিম