উত্তরের রংপুর, মধ্যভাগের গাজীপুর বা রাজধানী ঢাকা সাবজেক্ট নয়। এনসিপি বা সারজিসও সাবজেক্ট নয়। সাবজেক্ট মবের লাগামে টান দেওয়ার ম্যাসেজ। তা জনদাবিও।
সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের অফিসার্স অ্যাড্রেসে দেশের বিভিন্ন জায়গায় মব পাণ্ডমির বিরুদ্ধে কড়া হুঁশিয়ারি এবং সেনা সদর থেকে কঠিন বার্তা দেওয়ার পরও হুঁশ ফিরছিল না ‘আপনি মোড়ল’ মববাজদের। গায়ে না মাখার একটি প্রবণতা দেখা যেতে থাকে তাদের মধ্যে। এ রকম সময়েই বার্তা মিলল উত্তরের জেলা রংপুরে। সেখানে সেনা কর্মকর্তার স্পষ্ট হুঁশিয়ারি, মবের নামে নাশকতার কোনো সুযোগ নেই।
বায়বীয় বা অচেনা কাউকে নয়, সেই বার্তাটি দেওয়া হলো একদম জায়গাদৃষ্টে আগস্ট বিপ্লবের আলোচিত ফ্রন্টলাইনার এনসিপি নেতা সারজিস আলমকে।
সূচনা জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের রংপুরের বাসভবনে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা নিয়ে। এ জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং বিএনপির স্থানীয় নেতাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সেনাবাহিনী। জিজ্ঞাসাবাদের নেতৃত্ব দেন সেনাবাহিনীর ৭২ পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হুমায়ুন কাইয়ুম।
এ খবর পেয়ে রাতেই তেড়ে যাওয়ার মতো ঘটনাস্থলে পৌঁছান তখন উত্তরে অবস্থানকারী জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম। তিনি সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে নমুনা বুঝে ফেলেন। নমনীয় হয়ে পরে সাংবাদিকদের জানান, ‘তদন্তের জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন হোক, বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি হোক, যে কাউকেই জিজ্ঞাসাবাদ করা যেতে পারে।’ তবে আব্দার রাখেন রাতে না করে দিনে ডেকে নেওয়ার। মূলধারার গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভেসে বেড়ানো খবর হচ্ছে, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হুমায়ুন কাইয়ুম কথোপকথনের সময় সারজিসকে সোজাসাপ্টা জানিয়ে দেন, ‘শরীরে যতক্ষণ রক্ত আছে, উই আর নট গোয়িং টু প্রমোট এনিওয়ান। ভ্যান্ডালিজম, মবের নামে আগুন লাগানো, ঘরদোর ভাঙচুরের আর সুযোগ নেই।’
বলার বা লুকানোর কোনো সুযোগ নেই। জাতীয় পার্টি ছিল পতিত-বিতাড়িত সরকারটির বোঝাপড়ার অবিরাম পার্টনার। আওয়ামী লীগকে টিকিয়ে রাখার সব চেষ্টা-তদ্বিরই তারা করেছে। তাদের রাজনৈতিক পরিণতিও বরণ করতে হচ্ছে। জাপাকেও নিষিদ্ধের দাবি রয়েছে এনসিপিসহ কিছু রাজনৈতিক দলের। তাই বলে দলটির চেয়ারম্যান বা কোনো নেতার বাড়িতে আগুন বা ভাঙচুর কি সভ্যতার প্রশ্নে অনুমোদন দেয়? সেনাবাহিনী কেন, আনসার বা গ্রামপুলিশও তা সইবে? বা সওয়া উচিত?
দেশের চলমান পরিস্থিতিতে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখতে ম্যাজিস্ট্রেসি নিয়ে মাঠে আছে সেনাবাহিনী। এর পরও তারা অতিরিক্ত বলপ্রয়োগে যাচ্ছে না। পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে যৌথবাহিনী হয়ে কাজ করছে। সেনাবাহিনী নিয়ে মাঠে-ঘাটে দুটি ন্যারেটিভ রয়েছে। একটি মহল চায়, সেনাবাহিনী ফ্রন্টে গিয়ে মবসহ যাবতীয় দুষ্টকর্ম সমানে দমাক। পিটিয়ে রক্তলাল করে দিক। আরেকটি মহল উতলা হয়ে আছে সেনাবাহিনীর ব্যারাকে ফিরে যাওয়া নিয়ে। মাঠ থেকে সেনা সদস্যদের তুলে নেওয়ার অধীর প্রতীক্ষা সুচতুর এ কমিউনিটির। তারা ভেতরের অনেক তথ্য রাখে। ভালো করেই জানে, প্রকাশ্যে হাবভাব বা শো-ডাউন না করলেও সেনাবাহিনী যতক্ষণ মাঠে আছে, ততক্ষণ তাদের মাঠে নামার পরিণতি খারাপ হবে।
দায়িত্বের অংশ হিসেবে অংশীজন হিসেবে হত্যা মামলার আসামি, অবৈধ অস্ত্রধারী, তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী, চোরাকারবারি, কিশোর গ্যাং সদস্য, অপহরণকারী, ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ, মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত যৌথ অভিযানে কাজ করছে সেনা সদস্যরা। আটককৃতদের যথারীতি হস্তান্তর করছে পুলিশের কাছে। জননিরাপত্তা নিশ্চিতে বিভিন্ন এলাকায় নিয়মিত টহল দিচ্ছে। শিল্পাঞ্চলগুলোতে সম্ভাব্য অস্থিরতা রোধে মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে মতবিনিময় ও সমঝোতার মাধ্যমে বেতন-বোনাস পরিশোধে সেনাবাহিনী কী ভূমিকা রাখছে, তা মালুম করা যাবে সেনা প্রত্যাহার করলে। ঈদুল আজহা উপলক্ষে বিভিন্ন জায়গায় বসা অস্থায়ী পশুর হাটে সার্বক্ষণিক নজরদারি, নিরাপত্তা ও পর্যবেক্ষণেও এমন উপলব্ধি আসবে। পাশাপাশি, ঈদ যাত্রাকে সহজ করতে নির্বিঘ্নে সড়কে যান চলাচল নিশ্চিতকরণ ও টিকিট কালোবাজারি রোধে সেনাবাহিনী বিশেষ টহলের উপকার কেউ কেউ আঁচ করতে না পারলেও এ সেক্টরের দুষ্টচক্র দাঁত কামড়ে মরছে। সম্প্রতি সেনা সদস্যরা গা ঝাড়া দিয়েছে মব দমনে। এর একটা সিকোয়েন্সই সামনে আসে রংপুরের ঘটনায়। অনেকটা টোকেন অ্যাকশনের মতো। এর মধ্য দিয়ে একটা ম্যাসেজ উপলব্ধি করা যায়। মব তৈরি করে ভাঙচুরের ঘটনায় এ পদক্ষেপটি জরুরি ছিল। সারজিস আলম জড়িয়ে পড়ায় এর সিগনিফিকেন্স আরো বেড়েছে।
সেনাবাহিনীর খানিকটা ভিন্নসত্তা এখানে প্রাসঙ্গিক। সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধানের সেই সত্তার ফলোআপ ৫ আগস্টের আগে থেকেই পরিষ্কার হয়ে গেছে। নিজ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গান পয়েন্টে দাঁড়িয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার সেই সন্ধিক্ষণে ‘নো ফায়ার’ ঘোষণা না দিলে পরবর্তী পদক্ষেপ ভিন্ন হতো। সেনাবাহিনী ফ্যাসিস্টের হুকুম তামিল করলে সারজিস-হাসনাত বা ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান এ পরিণতি পেত কি না, তা এরই মধ্যে নতুন করে বিশ্লেষণের কিছু নেই। আছে উপলব্ধি ও সন্তুষ্টির বিষয়। কিন্তু তা না করে বিচারের আগে বিচার তথা মব এক ধরনের পাণ্ডামি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে বিবেকবান যে কারো কাছেই। ওই উপলব্ধির শরিক হিসেবেই মবের বিরুদ্ধে সেনাপ্রধানের কড়া ওয়ার্নিং এবং রংপুরে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হুমায়ুন কাইয়ুমের ‘শরীরে যতক্ষণ রক্ত আছে, উই আর নট গোয়িং টু প্রমোট এনিওয়ান’ উচ্চারণ। জেনারেল মবের বিরুদ্ধে বেশ কঠোর বার্তা দিয়ে বলেছিলেন, ‘এটা বরদাস্ত করা হবে না, আর হতে দেওয়া হবে না।’ সেখানে এখন একটা ল্যান্ডমার্ক যোগ করলেন ব্রিগেডিয়ার।
দেশটা মগের মুলুক বা মবের মুলুক হবে—তা কারো কাম্য নয়। মবে কারো উত্থান কাঙ্ক্ষিত নয়। তা শুধু নিন্দনীয় নয়, উদ্বেগজনকও। ‘যেই দরে কেনা, সেই দরে বেচা’ বলে বাংলায় একটা মেঠো কথা আছে। অর্থাৎ মবে উত্থান ঘটলে পতনটাও কেমন হবে, তা বুঝতে মস্ত জ্ঞানী হওয়া দরকার হয় না। বিতাড়িত সরকারটির পতনের অন্যতম কারণ ছিল বেপরোয়াপনা-গোঁয়ারগোবিন্দপনা। পছন্দ না হলেই কাউকে শত্রু বানিয়ে বিনাশ করা। জোরজবরদস্তিতে কাছে টানা। দুর্বৃত্তায়নের পক্ষে বন্দনা গাইতে বাধ্য করা। সেটিও ছিল এক ধরনের মব। পরাক্রমশালী ওই সরকারটির পরিণতি তো দগদগে তাজা ঘটনা। এখন যারা ফ্যাসিস্টের সমালোচনা বা প্রতিবাদ করতে গিয়ে চেতনে-অবচেতনে নিজেরাও ফ্যাসিস্ট-দুর্বৃত্তের চাদরে মুড়ে যাচ্ছে, তাদেরও বাজে পরিণতি হতে বাধ্য। নতুন করে আবার ‘যেই দরে কেনা সেই দরে বেচা’য় ফিরে আসা হবে গোটা জাতির জন্য কষ্ট-বেদনার। মগের মুলুক থেকে নিষ্কৃতির পর দেশকে মবের মুলুক থেকে রক্ষায় সেনাবাহিনীর নড়েচড়ে ওঠার সুফল দেখার অপেক্ষায় জাতি।
বিপ্লব-অতিবিপ্লবের নামে দেশে-বিদেশে বসে কারো কারো উসকানি থাকা অস্বাভাবিক নয়। সেই পক্ষের সবাই হারিয়ে যায়নি। তাদের কোনো না কোনোভাবে অ্যাকটিভ থাকাই স্বাভাবিক। তাই এ ব্যাপারে আরো আগে থেকেই কঠোর হওয়া দরকার ছিল। সরকার এ কাজে হাত দিলেও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়নি, যা দেখে মববাজদের ভয় জাগবে। সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক পদক্ষেপের ফলাফলের বিষয়ে তাই উচ্চাশা সচেতনদের। নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। সময় এভাবে চলতে পারে না। একটা-দুটা এক্সাম্পল ঘটালে মবের লাগামে টান পড়তে বাধ্য। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় পল্টন-পুরানা পল্টন এলাকায় গজানো পাতি মাস্তান লিটনকে পাকড়াওয়ের ঘটনা। বিএনপির নাম ভাঙিয়ে কিছুদিন ধরে ওই এলাকায় যুবলীগের এক সময়ের ত্রাস সম্রাট-নিখিল-খালেদ হয়ে উঠছিল এই লিটন। ৫ আগস্টের পর থেকে মতিঝিল, পল্টন, পুরানা পল্টন, বিজয়নগরসহ আশপাশের এলাকায় ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে চাঁদা আদায়, অপহরণ এবং মিথ্যা মামলার ভয় দেখিয়ে হয়রানির গতি বাড়তেই থাকে। কিছু পুলিশ সদস্যও তাকে জমা-খরচ দিয়ে চলতে থাকেন। তার হুমকি-ধমকিসহ উৎপাতের শিকাররা পুলিশের শরণাপন্ন হয়ে উল্টো ধমক খেয়েছেন। সেনা সদস্যরা ২৮ মে রাতে তাকে হাতেনাতে ধরে ফেলেন। তার ব্যবহৃত অফিস ও বাসায় তল্লাশি চালিয়ে পাঁচটি মোবাইল ফোন, নগদ দুই লাখ টাকা ও এক হাজার ১০০ মার্কিন ডলার উদ্ধার ও জব্দ করে। ম্যাজিকের মতো পুরো এলাকায় এখন স্বস্তি। তার পক্ষ নিয়ে কোনো দল বা কেউ এখন পর্যন্ত আগোয়ান হয়নি। হনুমানের লেজে আগুন বা মুগুরের বাড়ি পড়ার এটাই বাস্তবতা।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন