বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য বিষয়ক আলোচনায় তামাকজাত সিগারেটের তুলনায় নিরাপদ বিকল্পের গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশ এই ধরনের বিকল্পের জন্য একটি নিয়ন্ত্রিত কাঠামো গ্রহণ করেছে, যা ধূমপানজনিত মৃত্যু হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে স্বীকৃত হয়েছে। বিপরীতে ২৫টিরও কম দেশ সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, যা অনেক ক্ষেত্রে কালো বাজারের প্রসার ও রাজস্ব ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ নিরাপদ বিকল্পের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে, যেখানে নীতিনির্ধারণে ভোক্তাদের কল্যাণ ও বৈজ্ঞানিক প্রমাণের চেয়ে অন্যান্য চাপের প্রভাব বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এটি আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ হিসেবে অনুধাবন করতে পেরেছি।
২০২২ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) এক প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, দেশে ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে ১৩.১% জনগোষ্ঠী প্রচলিত তামাকজাত সিগারেটে আসক্ত থাকার কারণে সম্প্রতি বাংলাদেশে এই নিষেধাজ্ঞা আরোপকে ভুল সিদ্ধান্ত হিসেবেই দেখা হচ্ছে। বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত ঝুঁকি-হ্রাসকারী নিরাপদ বিকল্পগুলোর বাজার সীমিত করার মাধ্যমে এই নীতি মূলত ধূমপায়ীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানোর নিরাপদ পথ রুদ্ধ করছে। অনেকেই যারা প্রচলিত তামাকজাত পণ্য থেকে সরে আসার প্রক্রিয়ায় ছিলেন, তাদের এখন নিরাপদ বিকল্পের বিপরীতে শেষ পর্যন্ত আবারও প্রচলিত সিগারেটের ওপর নির্ভরশীল করে তুলতে পারে। এই কঠোর নীতি একদিকে যেমন সিগারেট আসক্তি কমাতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তেমনি ভোক্তাদের অধিকারও খর্ব করছে। তামাকজাত সিগারেটের আসক্তি থেকে বের হয়ে সুস্থ জীবনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে, এই নিষেধাজ্ঞা তাদের সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করছে।
বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, প্রচলিত সিগারেটের তুলনায় নিরাপদ বিকল্পগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে কম ক্ষতিকর। যদিও কিছু মহল থেকে দাবি করা হয় যে এসব ডিভাইস তরুণদের আকৃষ্ট করছে এবং তাদের আসক্ত করে তুলছে, তবে পরিসংখ্যান ভিন্ন বাস্তবতা তুলে ধরছে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ৩.৬ কোটি তরুণ এসব ডিভাইস ব্যবহার করছে, যেখানে প্রচলিত তামাকজাত পণ্যের ব্যবহারকারীর সংখ্যা এক বিলিয়নেরও বেশি। এই বিশাল সংখ্যক ধূমপায়ী যদি নিরাপদ বিকল্পে স্থানান্তরিত হতে পারেন, তবে তারা এই আসক্তির চক্র থেকে বেরিয়ে এসে স্বাস্থ্যকর জীবনের দিকে এগিয়ে যেতে পারবেন। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, গত দুই দশকে বিশ্বব্যাপী নিরাপদ বিকল্প ব্যবহারের কারণে ১০০ জনেরও কম মৃত্যুর ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে, অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, ধূমপানজনিত রোগ প্রতি বছর ৮ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। এই পরিসংখ্যান স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয় যে, নিরাপদ বিকল্পের ওপর বিধিনিষেধ আরোপের পরিবর্তে এগুলোর গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করা আরও কার্যকরী হতে পারে।
বাস্তবভিত্তিক ও ঝুঁকি-হ্রাসমূলক নীতির পরিবর্তে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাহ্যিক শক্তির প্রভাবে এখনো সেকেলে নিষেধাজ্ঞামূলক ধারণাকে এগিয়ে নিচ্ছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়ার পর ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিজ ও গেটস ফাউন্ডেশন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অন্যতম প্রধান অর্থায়নকারী হিসেবে কাজ করছে।
বৈজ্ঞানিক গবেষণাগুলো এসব বিকল্পকে তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতিকর এবং ধূমপায়ীদের জন্য কার্যকরী সমাধান হিসেবে প্রমাণ করেছে। এই পরিস্থিতি স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে যে এসব উন্নয়নশীল দেশের নীতিনির্ধারণে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ও ভোক্তাদের স্বার্থের চেয়ে বাহ্যিক প্রভাবই বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখছে।
তবে, বিশ্বজুড়ে এই বাহ্যিক প্রভাব তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। ফিলিপাইনের আইনপ্রণেতারা বিদেশি অনুদানের মাধ্যমে জাতীয় নীতিনির্ধারণে হস্তক্ষেপের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। ভারত ব্লুমবার্গ-অর্থায়িত একটি তামাক নিয়ন্ত্রণ সংস্থাকে নিষিদ্ধ করেছে, কারণ তারা তাদের প্রকৃত অর্থায়নের উৎস প্রকাশে ব্যর্থ হয়েছিল। এ ধরনের হস্তক্ষেপ জাতীয় সার্বভৌমত্বকে দুর্বল করে, যেখানে জনস্বাস্থ্য নীতির নিয়ন্ত্রণ সরকারগুলোর হাত থেকে সরে গিয়ে এনজিওগুলোর হাতে চলে যাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে অস্ট্রেলিয়াকে দেখা যেতে পারে, যেখানে নিরাপদ বিকল্প নিষিদ্ধ করে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের ফলে বাজারের প্রায় ৬০% অবৈধ পথে পরিচালিত হচ্ছে। এর ফলে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে এবং অবৈধ বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নিরাপদ বিকল্পগুলোর প্রতি বাংলাদেশের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি আর্থিক সম্ভাবনা বাড়াতে পারে। বাংলাদেশে কৃষকরা নিরাপদ বিকল্প ব্যবহারের ফলে তামাকের অতিরিক্ত পরিমাণটি রপ্তানি করতে পারবে। ফলে নিষেধাজ্ঞার কারণে অনিশ্চয়তার পরিবর্তে নতুন রাজস্ব প্রবাহ তৈরি হবে। এ ছাড়াও খুচরা বিক্রেতাদের নিরাপদ বিকল্পগুলো বৈধভাবে বিক্রি করার অনুমতি দিলে এই খাতটি বিকশিত হবে এবং সরকারের কর রাজস্ব বাড়বে। ব্ল্যাক মার্কেটের দিকে গ্রাহকদের ঠেলে দেওয়ার পরিবর্তে, একটি গঠনমূলক নিয়ন্ত্রক কাঠামো গ্রাহক সুরক্ষা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং জনস্বাস্থ্য উন্নতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
লেখক : আইনজীবী, ঢাকা জজ কোর্ট
বিডি-প্রতিদিন/এডি