বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, রাষ্ট্র ও রাজনীতির গুণগত সংস্কার এবং নাগরিকের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি সব সময় জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, নির্বাচিত জাতীয় সংসদ ও নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে আসছে। রাজনৈতিক দল নির্বাচনের দাবি জানাবে, এটি স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক নীতি। আমরা খেয়াল করছি, কিছুদিন ধরে অত্যন্ত সুকৌশলে এমন একটি আবহাওয়া তৈরি করছে, যেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি করাটাই যেন একটা অপরাধ। জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে অবজ্ঞাসূচক বক্তব্য-মন্তব্য কিন্তু পলাতক স্বৈরাচারকেই আনন্দ দেয়। অপরপক্ষে এটি গণতন্ত্রকামী জনগণের জন্য কিন্তু অপমানজনক।
গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় ভার্চুয়ালি অংশ নিয়ে তিনি এ কথা বলেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু। ২০২০ সালের ২ মে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার’- এই তিন মূলনীতির ভিত্তিতে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করে এবি পার্টি। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, জাতীয় পার্টির (জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী, এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান ফুয়াদ প্রমুখ।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘পলাতক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না দিয়ে যারা জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কথা বলেছেন, তাদের আমি বলতে চাই- লুটপাট আর দুর্নীতির শত শত কোটি টাকা হাতে নিয়ে সারা দেশে পলাতক স্বৈরাচারের দোসররা পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগের অপেক্ষায়। স্থানীয় নির্বাচন পলাতক স্বৈরাচারের জন্য পুনর্বাসিত হওয়ার একটা সূবর্ণ সুযোগ। যারা স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কথা বলেছেন, হয়তোবা তারা এ বিষয়টি এভাবে বিবেচনা করেননি। আমি অনুরোধ করব, বিষয়টাকে এভাবে বিবেচনা করার জন্য।’
সংবিধান লঙ্ঘনকারী বিতাড়িত পতিত পলাতক স্বৈরাচার পুনরায় মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, ‘আমাদের সংবিধানের ৬৫/২ অনুচ্ছেদের নির্দেশনা হচ্ছে, জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন কিন্তু সংবিধান লঙ্ঘন করে এই পলাতক স্বৈরাচার জনগণের ভোট ছাড়াই তিনবার অবৈধ সংসদ ও সরকার গঠন করে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ আজ জানতে চায়, সংবিধান লঙ্ঘনের দায় অভিযুক্তদের আগামী দিনে রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক করে দিতে অন্তর্বর্তী সরকার কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বা নিয়েছে? ব্লেইম গেইম দিয়ে দায়িত্ব এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। অন্তর্বর্তী সরকার পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার অবশ্যই আগামী দিনে সংবিধান লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবে।’
তারেক রহমান বলেন, রাষ্ট্র, রাজনীতি মেরামতের জন্য সংস্কারের কর্মযজ্ঞ চলছে। তবে চলমান সংস্কার যদি রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিকে অবজ্ঞা করে, তাহলে সংস্কারের তাৎপর্যটা কী, তা নিয়ে বহু মানুষের প্রশ্ন আছে।
তিনি বলেন, ‘দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দল সংস্কারের পক্ষে। তারপরও সংস্কার নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার কেন এত সময়ক্ষেপণ করছে, তা নিয়েও জনগণের মনে ধীরে ধীরে প্রশ্ন বেড়েই চলেছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে অবজ্ঞা এবং জনগণের রায়কে অবহেলা করে বিরাজনীতিকরণকে উৎসাহিত করা হলে সেটি শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রকেই ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেবে। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আবারও আজ এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আহ্বান জানিয়ে বলতে চাই, সুনির্দিষ্টভাবে জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করুন।’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের আদালতের মুখোমুখি করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হব এবং এই উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে। জনগণের ভোটের মাধ্যমে জবাবদিহিমূলক সংসদ ও সরকার গঠিত হলে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সুসংহত থাকবে।
তারেক রহমান বলেন, ‘গণতন্ত্রকামী জনগণের স্বাধীনতার বার্তা উপেক্ষা করে পতিত পলাতক স্বৈরাচার দীর্ঘ দেড় দশক স্বাধীন বাংলাদেশকে তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। ভবিষ্যতে যেন আর কেউ কখনো বাংলাদেশকে তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করার দুঃসাহস না দেখায়, পরাজিত তাঁবেদার অপশক্তি আর তাদের দোসররা যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে না পারে, সেটি হোক বাংলাদেশের আজ এবং আগামী দিনের বন্দোবস্ত। রাজনৈতিক চর্চার মাধ্যমে সরকার গঠন এবং পরিবর্তনে জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলো অভ্যস্ত হয়ে উঠলে আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বাংলাদেশকে আর কেউ তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করে রাখতে সক্ষম হবে না ইনশাল্লাহ।’
তিনি বলেন, যে রাজনৈতিক দলটি গণতান্ত্রিক চরিত্র হারিয়ে দেশে ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম এবং বাংলাদেশকে একটি তাঁবেদারি রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল তাদের দেশের জনগণ কখনো মেনে নেবে না।
তারেক রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের ৫৪ বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন যদি আমরা এভাবে দেখি- ১৯৭১ সাল ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের আর ২০২৪ সাল ছিল দেশ এবং জনগণের স্বাধীনতা রক্ষার। বাংলাদেশ নামক এই রাষ্ট্রের স্বাধীনতাপ্রিয় লাখো শহীদের রক্তে লেখা স্মারকে ’৭১ আর ’২৪-এর রাজনৈতিক বার্তাটি হলো দিল্লির তাঁবেদার হওয়ার জন্য বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে পিন্ডি ত্যাগ করে নাই। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের সিপাহি জনতাও এ বার্তা দিয়েছিল।’
বিএনপির এই শীর্ষ নেতা বলেন, ‘ফ্যাসিবাদী শাসনের পতনের পর নতুন করে আরও কমপক্ষে ২৫টি নতুন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করেছে। রাজনৈতিক ময়দানে আমরা তাদের স্বাগত জানাই। গণতন্ত্রের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক আদর্শের ভিন্নতা থাকতে পারে। তবে আমি বিশ্বাস করি, দেশের স্বার্থের প্রশ্নে বাংলাদেশের পক্ষের প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের অবস্থান এক ও অভিন্ন।’
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ন্যাশনাল পিপলস পার্টির ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, জেএসডির শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, বিএলডিপির শাহাদাত হোসেন সেলিম, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নাহিদ ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মাওলানা মামুনুল হক, খেলাফত মজলিশের আহমেদ আবদুল কাদের, গণঅধিকার পরিষদের নুরুল হক নুর, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের হাসনাত কাইয়ুম, এনডিএমের ববি হাজ্জাজ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিলারা চৌধুরীও। সকালে অনুষ্ঠান শুরুর আগে অতিথি ও দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কেক কাটেন মজিবুর রহমান মঞ্জু।