নড়াইল সদর উপজেলার চণ্ডীবরপুর ইউনিয়নের গোয়ালবাথান গ্রামের বাসিন্দা অটোরিকশাচালক টিপু মুন্সী (৫০)। রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়েছিলেন। রাত আনুমানিক ২টার দিকে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে তিনি ঘরের বাইরে যান। এ সময় একটি বিষধর সাপ তাকে কামড় দেয়। বিষয়টি পরিবারের লোকজনকে জানালে তারা প্রথমে তাকে স্থানীয় এক ওঝার বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে তার অবস্থার অবনতি হয়। পরে তাকে নড়াইল জেলা হাসপাতালে নেওয়া হয়। নড়াইল জেলা হাসপাতালের জরুরি বিভাগের দায়িত্বরত চিকিৎসক আসিফ আকবর বলেন, ‘হাসপাতালে আনার আগের ওই রোগীর মৃত্যু হয়েছিল।’
সাপ কামড়ালে দ্রুত হাসপাতালে না নিয়ে ওঝা কিংবা কবিরাজের কাছে ঝাড়ফুঁক করতে গিয়ে ঝরে যাচ্ছে প্রাণ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সরকারি হিসাবে সাপের কামড়ে প্রতিদিন কমপক্ষে ২০ জনের মৃত্যু হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাপের কামড়ে ২০ থেকে ২২ শতাংশ রোগীর মৃত্যু হয় সমন্বিত চিকিৎসার অভাব ও সময়ক্ষেপণে। দ্রুত চিকিৎসা নিলে ৯০ শতাংশ রোগীকে বাঁচানো সম্ভব। ২০২৪ সালে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ২৪ হাজার ৪৩২ জন রোগীর তথ্য রয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে। এর মধ্যে মারা যায় ১১৮ জন। এসব রোগীর বেশির ভাগই প্রথমে ওঝা বা বৈদ্যর কাছে গেছে। সাপে কাটা রোগীকে অ্যান্টিভেনম দিলে জীবন বাঁচানো সম্ভব। কিন্তু দেরি করায় বাড়ছে বিপদ।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপজেলা হেলথ কেয়ারের লাইন ডাইরেক্টর ডা. মোহাম্মদ একরাম উল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অপারেশন প্ল্যান (ওপি) বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে অ্যান্টিভেনমের কিছুটা সংকট হয়েছিল। এখন উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে আর তেমন কোনো সংকট নেই। হাসপাতালগুলো স্থানীয় পর্যায়ে মেডিকেল অ্যান্ড সার্জিক্যাল রিক্রুটমেন্ট বাজেট থেকে অ্যান্টিভেনম কিনেছে, এনসিডি কিছু বরাদ্দ দিয়েছিল এবং কোথাও কোথাও উপজেলা পরিষদ থেকেও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যান্টিভেনম কেনার কিছু সহায়তা পাওয়া গিয়েছে।
দেশে সাধারণত গোখরা, কেউটে, রাসেল ভাইপার (চন্দ্রবোড়া) ও সবুজবোড়া এই চার ধরনের বিষধর সাপের কামড়ে মানুষ বেশি মারা যায়।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়টাতেই সাপে কাটা রোগীর সংখ্যা বেশি থাকে। চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১ হাজার ১৬৭ জন সাপে কাটা রোগী। এর মধ্যে ২৪৭ জন বিষধর সাপের কামড়ে আক্রান্ত। মৃত্যুর বেশির ভাগ ঘটনাই ঘটেছে রাসেলস ভাইপার, কেউটে ও গোখরার কামড়ে। শুধু রাসেলস ভাইপারের কামড়ে প্রাণ হারিয়েছে ১০ জন।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মুখপাত্র শংকর কে বিশ্বাস বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশে সাপে কাটা মোট রোগীর প্রায় ৫০ শতাংশ এই হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়। সাপে কাটা রোগীদের ৭০-৮০ শতাংশের অ্যান্টিভেনম দেওয়ার পরে আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন। কিন্তু উপজেলা হাসপাতালে আইসিইউ নেই। এমনকি অনেক জেলা সদর হাসপাতালেও পূর্ণাঙ্গ আইসিইউ না থাকায় রোগীদের এই হাসপাতালে নিয়ে আসেন স্বজনরা। তবে অনেক রোগী ওঝার কাছে গিয়ে দেরিতে আসে, ফলেই মৃত্যু বাড়ছে।
জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জের জোড়খালী ইউনিয়নের চরগোলাবাড়ীতে গত ৪ জুলাই রাবেয়া বেগমকে সাপ কামড় দিলে তার আত্মীয়রা তাকে কবিরাজের কাছে নিয়ে যান। কবিরাজ ঝাড়ফুঁক দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলে ওই রাতেই রাবেয়ার অবস্থার অবনতি ঘটে। পরে মাদারগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে তার মৃত্যু হয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আবদুল হামিদ বলেন, উপজেলা হাসপাতালে পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনম আছে।
গত এক মাসে ভোলাহাট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মোট ছয়জন সাপে কাটা রোগী এসেছিল। তার মধ্যে চারজনকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হয় এবং দুজনকে রাজশাহীতে রেফার্ড করা হয়। ওই দুই রোগীকে কয়েক দিন আগে সাপে কেটেছিল। কিন্তু তারা স্থানীয় ওঝা, কবিরাজের কাছে চিকিৎসা করাতে যাওয়ায় শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে হাসপাতালে আসে। তখন তাদের রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়।