কোনোভাবেই কাটছে না প্রশাসনে অস্থিরতা। কার্যত স্থবির জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এ কারণে জনপ্রশাসনে বিভিন্ন কাজে রয়েছে নানা ‘ভুল’। অভিযোগ উঠেছে, অনেক রদবদলের আদেশ গোপনে করে ওয়েবসাইটে দেওয়া হচ্ছে না। অনেক সময় আদেশ পাল্টাতেও হচ্ছে। প্রশাসনের সব স্তরের কর্মকর্তার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, পদোন্নতি, ক্যাডারবৈষম্য, মহার্ঘ্য ভাতার দাবিসহ সচিবালয়ের কর্মচারীরা সোচ্চার নিজেদের দাবি-দাওয়া নিয়ে। এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকায় সরকারি কাজে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া সাবেক কর্মকর্তাদের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি আপিল বিভাগের চলমান মামলার নানা দিকনির্দেশনা বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে যাচ্ছে মন্ত্রণালয়। সব মিলিয়ে জনপ্রশাসনে হযবরল অবস্থা বিরাজ করছে। এ থেকে উত্তরণে সঠিক ব্যক্তি বা নির্দেশনা প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সচিবালয়ে কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা নিজ নিজ দাবি আদায়ে সরগরম। এসব দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় আলোচনাও করছে না। ফলে সংকট বাড়ছে।
সম্প্রতি মন্ত্রণালয় এবং মাঠ প্রশাসনের নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভিন্ন ‘নিয়োগ বিধিমালা’ নিয়ে ফুঁসে ওঠেন সচিবালয়ের কর্মচারীরা। তারা নানা কর্মসূচি পালন করছেন। এসবের মধ্যে গত সপ্তাহে পাঁচজন সচিবের অবসান চেয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে অবস্থান নেন বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরাম। ওই দিন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোখলেস উর রহমান সাবেক কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করা দূরে থাক, অফিসেই আসেননি। পরে সাবেকরা ক্ষুব্ধ হয়ে মন্ত্রণালয়ের এপিডি অনুবিভাগে গিয়ে সচিবের ডানহাত বলে খ্যাত উপসচিব জামিলা শবনমকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন বলে জানা গেছে। একাধিক সাবেক কর্মকর্তা বলেন, সমস্যা থাকলে আলোচনা হবে। সচিব অফিস করেন না বা কথা শুনবেন না। অথচ মন্ত্রণালয়ের অনেক সিনিয়রের কথা না শুনে একজন ডিএস বা একজন চিহ্নিত যুগ্ম সচিবের কথায় পুরো মন্ত্রণালয় অচল করে রেখেছেন। সাবেকরা বলেন, ‘আওয়ামী লীগের দোসর ঢাকার কমিশনার হেলালুদ্দীন আহমদের ক্যাশিয়ার জামিলাকে জনপ্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এই নারী কর্মকর্তা একসময় ছিলেন আওয়ামী লীগ, পরে নিজেকে বঞ্চিত দাবি করে পদোন্নতি হাতিয়ে এখন দাবি করেন জামায়াতের নেত্রী। অথচ তার কথা ছাড়া সচিব যেন কিছু বোঝেন না, রূঢ় আচরণ করেছেন আমাদের সিনিয়রদের সঙ্গে।’
বঞ্চিত হয়ে অবসরে যাওয়া সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের আহ্বায়ক ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব ড. মো. নাসির উদ্দিন বলেন, ‘ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলের সুবিধাবাদীরা বর্তমান সময়েও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন। এটা দুঃখজনক এবং তাদের চুক্তি বাতিল করতে হবে। বর্তমান জনপ্রশাসন সচিব ড. মোখলেস উর রহমান আমাদের হেয় করেছেন। তার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে থাকাটা সমীচীন নয়।’ জানা গেছে, সাবেকদের নানামুখী যৌক্তিক চাপে সচিবের কাছের ওই উপসচিবকে গোপনে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) বদলি করা হলেও ওয়েবসাইটে তা প্রকাশ করা হয়নি। জানতে চাইলে উপসচিব জামিলা বলেন, ‘সিনিয়র সচিবকে না পেয়ে আমাকে অ্যাসল্ট করা হয়েছে। তবে আরও যাতে ক্ষতি না হয় সেজন্য দুদকে যোগ দিচ্ছি।’
সূত্র জানায়, সম্প্রতি অনেক ভুল আদেশ করে পরবর্তীতে পাল্টাতে হয়েছে জনপ্রশাসনের। খোঁজ না নিয়ে এসব কাজ করাতে বারবার আদেশ পাল্টাতে হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। পক্ষান্তরে, অনেক বঞ্চিত কর্মকর্তার আবেদন পড়ে আছে দিনের পর দিন। অথচ এসবের কোনো অগ্রগতিও জানতে পারছেন না আবেদনকারীরা। এসব নিয়ে অনেকের মধ্যে রয়েছে হতাশা।
আদালত অবমাননা করে আদেশ জনপ্রশাসনের : সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের কাজেও ‘বাঁহাত’ দিয়ে আদালত অবমাননা করছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব উজ্জল হোসেন আদালতের নির্দেশনা গোপন করে একটি চিঠি ইস্যু করেন। শুধু তাই নয়, সেটি আদালতের বিষয় নয় বলে দম্ভ করেন। জানা গেছে, ২৯ বিসিএসের প্রার্থী মুহম্মদ ফেরদৌস হাসানের একটি রিটে গত বছর হাই কোর্ট অন্য কোনো অযোগ্যতা না থাকলে তাকে ২৯তম ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি দেওয়ার জন্য সরকারকে নির্দেশ দেন। হাই কোর্টের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় আপিল ডিভিশনে লিভ টু আপিল দায়ের করে। আপিলে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত হাই কোর্টের রায় স্থগিত করা হয়। আপিল বিভাগে মামলাটি বর্তমানে শুনানির পর্যায়ে রয়েছে।
পিএসসি জানায়, ওই প্রার্থীর খাতা পুনর্মূল্যায়নে ২ নম্বর বাড়ে এবং মেধাক্রম ৩৭৬ থেকে ৩৫৪ হয়। এর পরও সব ক্যাডারে মেধাক্রম ২৭৮-এর মধ্যে শেষ হওয়ায় তাকে কোনো ক্যাডারে নিয়োগ দেওয়া যায়নি। যা জানানো হয়েছে। এর পরও বিষয়টি আপিলে আছে।
এর মধ্যে বাদী ফেরদৌস হাসান এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব উজ্জল হোসেনের যোগসাজশে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ এবং আপিল চলমান থাকার বিষয়টি গোপন করে আইনবহির্ভূতভাবে নিম্ন আদালতের রায় বাস্তবায়নের জন্য চিঠি দেন। এমন তথ্য পেয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক অতিরিক্ত সচিব উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, ‘আল্লাহ চালাচ্ছে জনপ্রশাসন। যে কোনো সময় আদালত ডেকে বসতে পারেন। এ ছাড়া বাদী মুহম্মদ ফেরদৌস হাসান একই বিসিএসে নন ক্যাডারে কর্মরত হয়ে কীভাবে এটি করেন। এখানে তার অধিকার ক্ষুণ্ন হয়নি বলেন একাধিক কর্মকর্তা। তিনি সরকারি কর্মচারী হয়ে সরকার এবং আদালতকে ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করার বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করেননি ফেরদৌস হাসান। মামলা করতে সরকারের অনুমতি নিয়েছেন কি না জানতে চাইলে বলেন, ‘এটা রিট, অনুমতির দরকার নেই।’ আপিলে থাকা মামলায় নির্দেশ দেওয়া যায় কি না জানতে চাইলে জনপ্রশাসনের কর্মকর্তা উজ্জল হোসেন বলেন, এটা প্রশাসনিক বিষয়। ফাইল দেখে বলতে হবে। হয়তো মামলা আছে, জানা ছিল না। সিনিয়রদের তদবির ছিল।
এদিকে, হাই কোর্টের আদেশে স্থগিতাদেশ থাকার পরও একজন ব্যক্তির জন্য কেন দৌড়ঝাঁপ করছেন জানতে চাইলে জনপ্রশাসনের আইন শাখার অতিরিক্ত সচিব মোজাফফর আহমেদ বলেন, ‘এটা আমাদের সিনিয়র স্যাররা বলতে পারবেন। তবে ওই ফেরদৌস ব্যক্তিটি সরকারি পদে থেকে আইন পরিপন্থি কাজ করেছেন। পাশাপাশি তথ্য গোপন করে অন্যায় করেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকারপক্ষের দায়ের করা আপিল ও স্থগিতাদেশকে বৃদ্ধাঙুলি দেখানোর সাহস হয় কীভাবে একটি মন্ত্রণালয়ের। উচ্চ আদালত কোনো মামলার আদেশ স্থগিত করলে সেটি যে আর কার্যকর থাকে না এটা কি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় জানে না, নাকি ইচ্ছে করেই আদালতের সঙ্গে একটা সাংঘর্ষিক বিষয় দাঁড় করাচ্ছে।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বর্তমান সচিব বেশি কথা বলতে গিয়ে লেজেগোবরে অবস্থা করে ফেলেছেন। তবে সচিবালয়ে যে আন্দোলন বা ঘেরাও অসন্তোষ হচ্ছে এসবের জন্য সমাধানের পথ জরুরি। বৈঠক, আলোচনা যাই বলি সেটার পথ খোলা রাখা দরকার। নিশ্চয়ই সরকার তা বুঝবে।