মৌলিকভাবে হজের বিধানাবলিতে পুরুষ-মহিলার বিধান অভিন্ন। হজের তিনটি ফরজ বিধানে অর্থাৎ ইহরাম, আরাফায় অবস্থান ও তাওয়াফে জিয়ারত আবশ্যক হওয়ায় পুরুষ-মহিলার বিধান সমান, তবে কিছু বিধানে ভিন্নতা রয়েছে।
মহিলাদের ওপর হজ ফরজ হওয়ার জন্য অন্যান্য শর্তের সঙ্গে তার স্বামী বা মাহরাম থাকাও আবশ্যকীয়। স্বামী বা মাহরাম থাকার সঙ্গে সঙ্গে তাদের প্রয়োজন ও দাবির নিমিত্তে তাদের হজের খরচও ওই মহিলার নিকট থাকা আবশ্যকীয়, নতুবা কেবল নিজের হজ করার খরচ থাকলেও হজ ফরজ হবে না। (আলবাহরুর রায়েক : ২/৩৩৯)
স্বামী বা মাহরাম ছাড়া মহিলাদের হজে গমন জায়েজ নয়, এতে হজ মাকরূহের সঙ্গে আদায় হয়ে গেলেও মহিলা গুনাহগার হবে। (আলজাওহারা : ১/১৫০)
ইবনে আব্বাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, কোনো মহিলা যেন মাহরাম ব্যতীত সফর না করে, জনৈক সাহাবি আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি অমুক জিহাদে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিয়েছি, কিন্তু আমার স্ত্রী হজে গমনে ইচ্ছুক? রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তুমি তাকে নিয়ে হজে যাও।
(বুখারি, হাদিস : ১৮৬২)
একনজরে হজের বিধানাবলিতে নারীদের বিশেষ বিধান
আবুল হাসান সুগদি (রহ.)-এর বর্ণনামতে একনজরে হজের বিধানাবলিতে পুরুষ থেকে ভিন্ন মহিলাদের বিশেষ ১১টি বিধান রয়েছে, নিম্নে সংক্ষেপে তা তুলে ধরা হলো—
এক. মহিলাদের ওপর হজ ফরজ হওয়ার জন্য তার স্বামী বা মাহরাম থাকা আবশ্যকীয়।
দুই. স্বামী বা মাহরাম থাকার সঙ্গে সঙ্গে তাদের প্রয়োজন ও দাবির নিমিত্তে তাদের হজের খরচও ওই মহিলার নিকট থাকা আবশ্যকীয়।
তিন. মহিলারা সেলাইকৃত কাপড় পরিধান করতে পারবে।
চার. মহিলারা স্বীয় চেহারা আবৃত না করতে পারলেও মাথা ঢাকতে পারবে।
পাঁচ. পুরুষদের তালবিয়া জোরে পড়া সুন্নত হলেও মহিলাদের নিঃশব্দে পড়া সুন্নত।
ছয়. পুরুষদের তাওয়াফের তিন চক্করে ‘রমল’ বুক উঁচিয়ে হাত নেড়ে বাহাদুরের ন্যায় হাঁটা সুন্নত, মহিলাদের জন্য তা সুন্নত নয়।
সাত. খালি না পেলে মহিলাদের হাজরে আসওয়াদে চুমু দেওয়া সুন্নত নয়, হ্যাঁ, পুরুষশূন্য হলে দেবে।
আট. খালি না পেলে মহিলাদের সাফা-মারওয়া পাহাড়ে ওঠা সুন্নত নয়, হ্যাঁ, পুরুষশূন্য হলে উঠবে।
নয়. সাফা-মারওয়ায় সাঈ করার সময় সবুজ চিহ্নের স্থানে মহিলারা সাধারণ গতিতে হাঁটবে, দ্রুতগতিতে হাঁটবে না।
দশ. আরাফায় অবস্থান ও তাওয়াফে জিয়ারতের পর ঋতুস্রাব আরম্ভ হলে মহিলাদের তাওয়াফে বিদা করা জরুরি নয়।
এগারো. এহরাম খুলতে পুরুষের ন্যায় মহিলাদের মাথা মুণ্ডনের বিধান নেই, বরং মহিলারা চুল কাটবে।
(আন নুতাফ ফিল ফাতাওয়া পৃষ্ঠা-২০৪)
ভিড়ের দরুন নারীদের বিধানে শীথিলতা
মহিলারা ভিড়ের কারণে মুজদালিফায় অবস্থান করার সুযোগ না পাওয়ায় মুজদালিফায় অবস্থান না করে মিনায় চলে গেলে তাদের ওপর দম (পশু জবাই) ওয়াজিব হবে না।
(মুআল্লিমুল হুজ্জাজ পৃষ্ঠা-১৮৩)
মহিলারা দিনের বেলা ভিড়ের কারণে কঙ্কর মারার সুযোগ না পেলে তাদের জন্য রাতে কঙ্কর মারা জায়েজ হবে, মাকরূহ হবে না।
(রদ্দুল মুহতার : ২/২৪৮)
নারীদের নেকাববিষয়ক ভুল ধারণার নিরসন
এহরাম অবস্থায় মহিলাদের চেহারা না ঢাকার বিধানকে কেন্দ্র করে একটি ভুল-বোঝাবুঝি রয়েছে। স্বাভাবিক অবস্থায় নেকাব ব্যবহারকারী অনেক দ্বিনদার মহিলাও এহরাম অবস্থায় পরপুরুষের সামনে নেকাববিহীন চলাফেরা করে। অথচ এই পর্দাহীনতা একটি ভুল কাজ। কেননা এহরাম অবস্থায় চেহারায় কাপড় দেওয়া নিষিদ্ধ থাকলেও পরপুরুষের সামনে বেপর্দায় যাওয়া নিষিদ্ধ। তাই পরপুরুষের নজরের আওতায় থাকলে এমনভাবে চেহারা ঢাকতে হবে, যেন চেহারার সঙ্গে নেকাবের কাপড়টি না লাগে। (রদ্দুল মুহতার : ২/৪৮৮, রফিকে হজ পৃষ্ঠা-৭৩)
বর্তমানে ক্যাপবিশিষ্ট কিছু নেকাব পাওয়া যায়, তা ব্যবহারের মাধ্যমে এহরাম ও পর্দা উভয় বিধান পালনে সমন্বয় সাধন সম্ভব। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, আমরা এহরাম অবস্থায় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে চলছিলাম। যখন পুরুষদের কাফেলা আমাদের পাশ দিয়ে যেত, আমরা চেহারার নেকাব ঝুলিয়ে দিতাম। যখন তারা আমাদের অতিক্রম করে চলে যেত, তখন নেকাব সরিয়ে নিতাম। (আবু দাউদ : হাদিস ১৮৩৩, মুসনাদে আহমাদ : হাদিস ২৪০২১)
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর স্ত্রী উম্মে সালামা (রা.) বলেন : আমি অসুস্থতার কারণে হেঁটে তাওয়াফ করতে অক্ষম হয়ে পড়লে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জানালাম। তিনি বললেন, তুমি আরোহণ অবস্থায়ই মানুষদের সর্বপেছন দিয়ে তাওয়াফ করো। তাই রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন বাইতুল্লাহর পাশ ঘেঁষে নামাজ পড়াচ্ছিলেন, আমি তখন তাওয়াফ করি।...(বুখারি, হাদিস : ১৬১৯)
হাদিসটির ব্যাখ্যায় আল্লামা আইনি (রহ.) লিখেন, মানুষদের পেছনে তাওয়াফের নির্দেশ দেওয়ার কারণ হলো—মহিলারা পুরুষদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে তাওয়াফ করবে। তাই তিনি পর্দার সুবিধার্থে সবার নামাজ অবস্থায় তাওয়াফ করেছিলেন। (উমদাতুল কারি : ৯/২৬২)
কিছু বিশেষ মাসআলা
হজ শুরু করার পর কোনো মহিলার ঋতুস্রাব আরম্ভ হলে শুধু তাওয়াফ ও সাঈ ব্যতীত অন্য সব আমল সম্পাদন করতে পারবে, হজ শেষ করে স্রাব বন্ধ হওয়ার অপেক্ষা করবে, অতঃপর বন্ধ হলে তাওয়াফ ও সাঈ করে হজ শেষ করবে। (আলমাবসূত : ৪/১৭৯)
আরাফায় অবস্থান ও তাওয়াফে জিয়ারতের পর ঋতুস্রাব আরম্ভ হলে মহিলাদের তাওয়াফে বিদা করা জরুরি নয়, তবে স্রাব বন্ধ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে তাওয়াফে বিদা আদায় করে আসা উত্তম। (আলমাবসূত : ৪/১৭৯, মুআল্লিমুল হুজ্জাজ পৃ: ২০৭)
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন