লিভিংরুমে পড়ে আছে মাথায় গুলিবিদ্ধ মানুষ। আরেকজন পড়ে আছে বেডরুমে। এক নারীর দেহ পড়ে আছে রাস্তায়। সিরিয়ার সুইদা শহরে কয়েক দিনের রক্তক্ষয়ের পর বাড়িঘরে লুটপাটের দৃশ্য আর প্রিয়জনদের সন্ধান করতে গিয়ে এভাবে থরে থরে মৃতদেহ খুঁজে পেয়ে দিশাহারা দ্রুজরা। শহরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা মৃতদেহগুলো সংগ্রহ করে দাফন শুরু করেছেন স্থানীয়রা। শহরের বাসিন্দারা বলছেন, বাড়ির ভিতরে এবং রাস্তায় কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে বহু মানুষকে। সরকারি বাহিনী ও দ্রুজ মিলিশিয়াদের মধ্যে সংঘর্ষে শহরে নেমে আসে মৃত্যুর মিছিল। যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে এ সংঘর্ষ শেষ হয়। সম্প্রতি দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় অন্তত ৫৯৪ জন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটিতে সংঘাত-সংঘর্ষ পর্যবেক্ষণ করা একটি সংস্থা।
দ্রুজ ও বেদুইন উপজাতিদের মধ্যে সহিংসতা বন্ধ করতে সুইদায় সেনা পাঠিয়েছিল সিরিয়া সরকার। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, সরকারি বাহিনী আসার পর পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। সুইদার বাসিন্দারা রয়টার্সকে বলেছেন, সরকার বাহিনীর পোশাক ও ব্যাজ দেখে হামলাকারীদের শনাক্ত করা যায়। অনেকের দাবি, তাদের বন্ধু ও আত্মীয়রা নিজ বাড়িতে বা রাস্তায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। রয়টার্স কিছু ভিডিওর সময় ও অবস্থান যাচাই করতে পারলেও কে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে তা স্বাধীনভাবে নিশ্চিত করতে পারেনি। সুইদায় অবস্থান করা একজন প্রতিবেদক বলেন, তিনি নিজ চোখে এক নারী ও দুই কিশোরসহ চারজনকে কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করতে দেখেছেন। অন্য এক স্থানীয় বাসিন্দা জানান, তার ভাইকে বাড়ির শোবার ঘরে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
সরকার বলছে, ‘নিষিদ্ধ গোষ্ঠীর উসকানি’ : সিরিয়ার নেতা আহমেদ আল-শারা এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, দ্রুজ সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষা তার অন্যতম অগ্রাধিকার। তিনি অভিযোগ করেছেন, কিছু ‘নিষিদ্ধ গোষ্ঠী’ ইচ্ছাকৃতভাবে উত্তেজনা বাড়ানোর চেষ্টা করছে। সরকারি বাহিনী এ সহিংসতার জন্য দায়ী কি না তা তিনি বলেননি। দ্রুজদের বিরুদ্ধে সহিংসতার জন্য দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। এর আগে অঞ্চলটিতে সরকারের যুদ্ধবিরতি ঘোষণার বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, ‘একটি সত্য-অনুসন্ধানী দল যত দ্রুত সম্ভব অপরাধ এবং আইন লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্ত করবে এর জন্য কারা দায়ী তা খুঁজে বের করবে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেবে।’
লুটপাট, গালাগাল : স্থানীয় সংবাদমাধ্যম সুইদা২৪-এর সাংবাদিক রায়ান মারুফ জানিয়েছেন, সরকারি বাহিনীর সেনা সদস্যরা বাড়িঘরে ঢুকে ফ্রিজ, সৌর প্যানেল লুট করেছে এবং দোকান ও বাসায় আগুন দিয়েছে- এমনকি বুধবার যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরও। তিনি জানান, সরকারি বাহিনীর সদস্যরা দ্রুজ বাসিন্দাদের ‘কাফের’, ‘শুয়োরের বাচ্চা’ বলে গালি দিয়েছে।
রয়টার্সকে সাক্ষাৎকার দেওয়া কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেছেন, সরকারি বাহিনী জোরপূর্বক দ্রুজ পুরুষদের গোঁফ কামিয়ে দিয়েছে। এটি খুব অপমানজনক কাজ।
লাশের স্তূপ : সাংবাদিক রায়ান মারুফ রয়টার্সকে বলেন, একটি বাড়িতে তিনি ১২ সদস্যের লাশ পেয়েছেন, যাদের মধ্যে ছিলেন নগ্ন নারী, বয়স্ক এক পুরুষ এবং দুটি শিশু। সিরিয়ান নেটওয়ার্ক ফর হিউম্যান রাইটস জানিয়েছে, তারা এখন পর্যন্ত ২৫৪ জন নিহতের তথ্য যাচাই করেছে, যাদের মধ্যে রয়েছেন নারী, শিশু ও চিকিৎসাকর্মী। এদের কেউ কেউ মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির প্রধান ফাদেল আবদুলঘানি। তবে সরকার এখনো নিহত সেনা বা বেসামরিক নাগরিকদের সংখ্যা জানায়নি।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও হামলা : সংঘর্ষ চলার মধ্যেই ইসরায়েল সিরিয়ার সুইদা, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রেসিডেন্সিয়াল প্রাসাদের আশপাশে বিমান হামলা চালিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় সংঘর্ষ বন্ধ হয়। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেন, ‘দ্রুজ ও বেদুইনদের দীর্ঘদিনের শত্রুতা এবং কিছু ভুল বোঝাবুঝি এ দুঃখজনক পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। ইসরায়েল পক্ষ এবং সিরিয়া পক্ষের মধ্যেও এমন কিছু হয়েছে।’ সুইদা শহরে সহিংসতা সিরিয়ার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য ভয় ও অনিশ্চয়তার বার্তা হয়ে উঠেছে। বিশেষত শারার শাসনামলে তাদের নিরাপত্তা কতটা নিশ্চিত হবে, সে প্রশ্ন আরও জোরালোভাবে সামনে এসেছে। -রয়টার্স