মঞ্চ বাধা শেষ, বিয়ের প্রস্তুতি সম্পন্ন, চারহাত এক করতে পুরোহিতও প্রস্তুত। চারিদিকে তখন অতিথিদের আনাগোনা। সকলেই অপেক্ষা করছেন কখন বিয়ে শুরু হবে। কিন্তু বাধ সাধলো প্রাকৃতিক বিপর্যয়! একটানা বৃষ্টিতে পন্ড হয়ে যেতে বসেছিল হিন্দু যুগলের বিয়ের অনুষ্ঠান। এসময় পাশে এসে দাঁড়ায় এক মুসলিম পরিবার। মুসলিম পরিবারের উদারতা এবং ঐক্যের বিরল প্রচেষ্টার ফলে একই মঞ্চে ওই মুসলিম যুগলের পাশাপাশি হিন্দু যুগলের বিয়েও সম্পন্ন হয়।
এই ঘটনা কোনও বলিউড সিনেমার গল্পের মত শোনালেও বাস্তবেই এটা দুইটি ভিন্ন ধর্মাবলম্বী দুই পরিবারের সম্প্রীতির গল্প!
ঘটনাটি ঘটেছে ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের পুণে শহরে। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পুণের ওয়ানাওয়াড়ির স্টেট রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (এসআরপিএফ) মাঠের কাছে অলংকরণ লনে ধর্মীয় সম্প্রীতির এই হৃদয়স্পর্শী ঘটনাটি ঘটে।
ওইদিন সন্ধ্যা ৬.৫৬ মিনিটে অলংকরণ লনে হিন্দু রীতিনীতি মেনে বিবাহের অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল সংস্ক্রুতি কাওয়াড়ে এবং নরেন্দ্র গালান্ডের। বিয়ে শুরুর শেষ পর্যায়ের প্রস্তুতি যখন চলছিল, তখন হঠাৎ করেই প্রবল বৃষ্টিপাতের ঘটনা ঘটে। অতিথিরা তখন আশ্রয়ের জন্য এদিক ওদিক ছুটে যান। একসময় চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়। একটানা বৃষ্টির কারণে খোলা লন তখন পুকুরের চেহারা নেয়। ফলে লনে ওই বিবাহের গোটা অনুষ্ঠান করা কার্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এদিকে সময় পেরিয়ে যাওয়ায় পাত্রীর লগ্নভ্রষ্ঠা হওয়ারও সম্ভাবনা ছিল, স্বাভাবিকভাবে উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছিল পাত্রীর পরিবারে।
অন্যদিকে খোলা লনের পাশেই ব্যাংকোয়েট হলের ভিতরে এক মুসলিম নব দম্পতির রিসেপশনের অনুষ্ঠান চলছিল। সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা ফারুক কাজীর ছেলে মহসিন এবং পাত্রী মাহিনের 'ওয়ালিমা' অনুষ্ঠানে তখন অতিথিদের ভিড়।
এমতাবস্থায় হিন্দু পাত্রী সংস্ক্রুতি কাওয়াড়ের পরিবারের সিনিয়র সদস্যরা ছুটে যান ফারুক কাজীর কাছে। তাদের অনুরোধ ওই ব্যাংকোয়েট হলে কাজী পরিবারের বিয়ের অনুষ্ঠানের পাশেই যদি একটু জায়গা করে দিয়ে তাদের মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানটি যাতে সম্পন্ন করা যায়! সমস্ত কিছু শোনার পরে এক মুহূর্ত দেরি করেননি ফারুক কাজী। হিন্দু পরিবারের অনুরোধ মেনে নিয়ে তিনি তাতে সম্মতি দেন।
এরপরই একই মঞ্চে মুসলিম যুগলের রিসেপশনের পাশাপাশি হিন্দু যুগলের বিয়ের অনুষ্ঠান চলে।
কাওয়াড়ে পরিবারের পারিবারিক বন্ধু পেশায় অ্যাডভোকেট নীলেশ শিন্ডে বলেন, প্রাথমিকভাবে, আমরা ভেবেছিলাম ১৫ মিনিটের মধ্যে বৃষ্টি থামবে, কিন্তু বৃষ্টিপাত চলতেই থাকে। অতিথিরা আশ্রয়ের জন্য চারদিকে দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে। এরই মধ্যে আমরা পাশের হলঘরটি লক্ষ্য করি এবং মুসলিম পরিবারের কাছে গিয়ে ঘরের ভেতরে' সপ্তপদী' (হিন্দু বিবাহ অনুষ্ঠান) করার অনুমতি চাই। তারা তৎক্ষণাৎ তাদের পরিবারের সাথে কথা বলে আমাদের জন্য মঞ্চ খালি করে দেয়। প্রথমে হিন্দু বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়, এর পরে মুসলিম বিবাহের অনুষ্ঠান শুরু হয়। শুধু তাই নয়, কাজী পরিবারের সদস্যরা এবং অতিথিরাও আমাদের অনুষ্ঠানের আয়োজনে সহায়তা করেছিলেন। দুইটি ধর্মের মধ্যে ঐতিহ্যগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও সামগ্রিক পরিবেশ উষ্ণ, শ্রদ্ধাশীল এবং আনন্দময় ছিল।
সংস্ক্রুতির ঠাকুরদাদা সান্তারাম কাওয়াড়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, আমরা দুই মাস ধরে এই বিয়ের পরিকল্পনা করছিলাম। সংস্ক্রুতি আমাদের খুবই আদরের এবং আমরা চেয়েছিলাম যে, অনুষ্ঠানটি জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে উদযাপন করা হোক। কিন্তু বৃষ্টির কারণে সেটা যখন বিঘ্ন হতে বসেছিল, তখন খুব ভেঙে পড়েছিলাম। যাইহোক আমরা কাজী পরিবারের কাছে কৃতজ্ঞ যে তারা আমাদের জন্য তাদের হৃদয়ের দরজা খুলে দিয়েছে।
সংস্ক্রুতির বাবা চেতন কাওয়াড়ে জানান, অসময়ে কাজী পরিবার এক মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছে। কাজী পরিবার আমাদের মেয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তটির জন্য জায়গা করে নিতে একটুও দ্বিধা করেনি। দুইটি ভিন্ন বর্ণ এবং ধর্মের দুই দম্পতি একই মঞ্চে বিয়ে করেছে। সম্প্রীতির এই সুন্দর মুহূর্ত কেবল ভারতেই ঘটতে পারে।
ফারুক কাজী বলেন, যখন আমি তাদের অনুষ্ঠান বিঘ্ন হতে দেখলাম, তখন আমি তাদের কষ্টটা অনুভব করি। তাছাড়া ও আমার মেয়ের মতো এবং আমি জানি কষ্টটা কোথায়! সর্বোপরি আমরা ভাগ্যবান যে এমন একটি অর্থপূর্ণ মুহূর্তের অংশ হতে পেরেছি।
দুই দম্পতির সম্মিলিত উদযাপন গভীর রাত পর্যন্ত চলেছিল। পারস্পরিক সৌহার্দের নজির হিসেবে বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে দুই পরিবারের সদস্য ও অতিথিরা একই সঙ্গে রাতের খাবারও খেতে বসেন।
অনুষ্ঠানের ফাঁকেই দুই পরিবারের নব দম্পতি একই সাথে গ্রুপ ফটো তোলেন যা ইতোমধ্যেই ভাইরাল হয়েছে। বিষয়টি সামনে আসার পরেই যেমন গোটা ভারতেই এটা নিয়ে আলোচিত হচ্ছে, তেমনি নেটিজেনদের প্রশংসা কুড়িয়েছে এই হৃদয়স্পর্শী ঘটনা।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল