তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল প্রশ্নে একমত হলেও এ সরকারের কাঠামো কী হবে- সে প্রশ্নে একমত হতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। একই সঙ্গে মতবিরোধ রয়েছে জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা ও নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে। এ ছাড়া মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) এবং ন্যায়পাল নিয়োগে বাছাই কমিটি গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে আপত্তি বহাল রেখেছে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো। এ তিনটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবে ঐকমত্য কমিশন।
গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের ২১তম দিনের আলোচনা শেষে এসব তথ্য জানানো হয়। ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় সংলাপে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন ও ড. মো. আইয়ুব মিয়া। সংলাপে ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
সংলাপে সূচনা বক্তব্যে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয় ধাপের সংলাপ শেষ করতে চায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের সংলাপে ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলো আজকালের মধ্যে পাঠানো হবে। সেগুলো সংযুক্ত করে পরশু দিনের মধ্যে সনদের জায়গায় পৌঁছাব। ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে আমরা যেভাবে হোক সনদের চূড়ান্ত রূপ অন্তত পক্ষে, যে সব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো স্পষ্ট করতে হবে এবং সনদে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
কমিশন সূত্র জানায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান নিয়োগের জন্য প্রস্তাবিত কাঠামো অনুযায়ী পাঁচ সদস্যের একটি বাছাই কমিটি গঠিত হবে। এই কমিটিতে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, বিরোধী দলীয় ডেপুটি স্পিকার এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলের একজন প্রতিনিধি। তারা ১২ জন সম্ভাব্য প্রার্থীর মধ্য থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান নির্বাচন করবেন। তারা যদি একমত হতে না পারেন, তাহলে প্রথমে সর্বসম্মতভাবে, পরবর্তীকালে ওয়ান চয়েস ভোট এবং তার পর প্রয়োজনে র্যাংক চয়েস ভোটিং পদ্ধতির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হবে। এ পদ্ধতিতে ভোটার হবেন উল্লিখিত পাঁচ জনসহ কোঅপ্ট সদস্য সুপ্রিম কোর্ট ও হাই কোর্টের একজন করে বিচারপতি। অর্থাৎ মোট সাতজন। তাতেও সিদ্ধান্ত না হলে র্যাংকিং পদ্ধতি অনুসরণ করে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে বাছাই করা হবে। অনেকেই এতে একমত। তবে বিএনপি এ ক্ষেত্রে বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছে। এ ছাড়া ‘নারী আসন ১০০ করা’ নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, সংস্কার কমিশনের ৭ শতাধিক সুপারিশের মধ্যে আমরা প্রায় ৬৫০টির মতো প্রস্তাবে একমত হয়েছি। বাকিগুলোর বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছি বা সংশোধিত প্রস্তাব দিয়েছি। সব প্রস্তাব সনদে আসবে না। তবে যেগুলো মৌলিক, যেমন সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত, সেগুলো অবশ্যই গুরুত্ব পাবে। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান নিয়োগের জন্য প্রস্তাবিত কাঠামোর বিষয়ে নীতিগতভাবে আমরা সবাই একমত। তবে গঠন পদ্ধতি নিয়ে কিছুটা মতভেদ রয়েছে। কমিশনসহ বিভিন্ন দলের পক্ষে একটি বাছাই কমিটির কথা হয়েছে। এখানেও সমাধান না হলে র্যাংক পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে।
আমরা এ জায়গায় একমত হতে পারিনি। আমরা চাই, এটি সর্বশেষ অপশন হিসেবে সংসদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হোক। সংসদে আলোচনা হবে। এ নিয়ে নাগরিকরা মতামত দিতে পারবেন। সেখানেও সমাধান না হলে আমরা ত্রয়োদশ সংশোধনীর পক্ষে। তবে এ ক্ষেত্রে সর্বশেষ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের সুযোগ থাকবে না। তিনি আরও বলেন, আমরা সাংবিধানিক এবং সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগ আইনের মাধ্যমে করতে চাই। কার্যকর রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একটি সক্রিয় নির্বাহী বিভাগ প্রয়োজন। তবে সেই নির্বাহী বিভাগকে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের মধ্যে রাখতে হবে। যত বেশি কিছু সংবিধানে যুক্ত করা হবে, তত বেশি সংশোধন জটিল হয়ে পড়বে। তাই আমরা চাই আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করা হোক এবং সে আইনে প্রয়োজন অনুযায়ী সংশোধন আনা সহজ হোক। ন্যায়পাল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যেহেতু এখন পর্যন্ত ন্যায়পাল কোনোদিন ফাংশন করেনি, তাই আমরা প্রথমে চাই সেটি প্রতিষ্ঠিত হোক। আইন যুগোপযোগী করে, দায়িত্ব ও ক্ষমতা স্পষ্ট করে কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন হোক। ন্যায়পালকে শুধু তদন্তের ক্ষমতা না দিয়ে, তার প্রতিবেদনের বাস্তব প্রয়োগের জন্য আইন তৈরি করতে হবে। নারী প্রতিনিধিত্ব বিষয়ে সালাহউদ্দিন বলেন, আমরা প্রথম ধাপে প্রস্তাব করেছি, আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ৫ শতাংশ অর্থাৎ ১৫টি আসনে নারীদের মনোনয়ন দেওয়া হবে। পরবর্তী নির্বাচনে তা ১০ শতাংশ অর্থাৎ ৩০টি হবে। আমরা চাই নারীরা সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হোক। কিন্তু সমাজের বাস্তবতা বিবেচনায় আমরা ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে চাই।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, আমরা একমত হয়েছি যে, জাতীয় নির্বাচন অবশ্যই কেয়ারটেকার সরকারের অধীনেই হতে হবে। এখানে কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে প্রায় সবাই একমত, একমাত্র বিএনপি কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। কমিশনের প্রস্তাবে বিচারপতি দুজন যুক্ত করা হয়েছে, যেন এককভাবে তৃতীয় দল বা অন্য কেউ ডিসাইডিং ফ্যাক্টর না হয়ে যায়। আমরা আশা করি, বিচারপতিরা নিরপেক্ষ থাকবেন এবং হর্স ট্রেডিংয়ের আশঙ্কা কমবে। এ ক্ষেত্রে বিএনপির বক্তব্য, যদি ঐকমত্য না হয়, তাহলে বিষয়টি সংসদে পাঠানো হোক। তবে জামায়াতসহ অধিকাংশ দল মনে করে, সংসদে পাঠালে তা আর সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে না। সংসদে ৫-৬টি দল আছে, অথচ এখানে ৩০টির বেশি দলের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। এখানেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। নারী আসন বিষয়ে তিনি বলেন, পিআর হলে সরাসরি নারী ১০০ আসনের পক্ষে জামায়াত। আর আগের নিয়মে হলে সংরক্ষিত ৫০ আসন ঠিক আছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি নিয়ে অধিকাংশ দল একমত। আর বিএনপিসহ কয়েকটি দল দ্বিমত জানিয়েছে। বিএনপি চায়, সর্বশেষ অপশন হিসেবে সংসদে সমাধান করতে হবে। আমরা এ বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে বিএনপিকে আহ্বান জানাই। মৌলিক সংস্কারের ভিত্তিতে না হলে জুলাই সনদে আমরা স্বাক্ষর করব না। এর আইনি ভিত্তি দিতে হবে। যেন পরবর্তী সরকার এর মূল চেতনা থেকে বিচ্যুত না হতে পারে। ন্যায়পাল নিয়োগে কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে তিনি বলেন, নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন হতে হবে।
আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, বিতর্কমুক্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্র্যাকটিস করতে না পারলে গণতন্ত্র আবারও হুমকিতে পড়বে। নিরপেক্ষভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বাছাইয়ে ক্রমভিত্তিক ভোটিং পদ্ধতির প্রবর্তন হবে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তিনি আরও বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে একটি সুস্পষ্ট ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা জরুরি। তবে এটি পার্লামেন্টে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য পাঠালে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার যে ঐকান্তিক প্রয়াস চলছে, তা অর্থহীন হয়ে পড়বে, যা কাম্য নয়।
বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (বিএলডিপি) চেয়ারম্যান ও ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, তত্ত্বাবধায়কের প্রধান উপদেষ্টা বাছাইয়ে ৫ সদস্যের কমিটি হয়েছে, সেই কমিটি নিয়ে আমাদের ঐকমত্য আছে। কিন্তু বাছাই কমিটি যে নাম সংগ্রহ করবে বিভিন্ন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল থেকে, সেখানে আমাদের আপত্তি হচ্ছে অনেক নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম নেই, আন্দোলন-সংগ্রামে তাদের কোনো অবদান নেই। তাই এখানে শুধু সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দল থেকে নাম সংগ্রহ করা যেতে পারে।