প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে আমরা জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছি। পাশাপাশি স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও আইনের শাসন নিশ্চিত করতে নিরবচ্ছিন্নভাবে নাগরিকবান্ধব সংস্কার চালিয়ে যাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘জবাবদিহি ছাড়া যে কোনো উন্নয়ন ক্ষণস্থায়ী ও ভঙ্গুর।’ সম্পদ পাচার রোধে কঠোর আন্তর্জাতিক বিধিবিধান প্রণয়নের প্রস্তাব দেন ড. ইউনূস। শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) ৮০তম অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে এ কথা বলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় সকাল ৯টায় অধিবেশন শুরু হয়। ড. ইউনূস দিনের দশম বক্তা হিসেবে ভাষণ দেন।
প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া সংস্কার কার্যক্রম, ২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণ অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের অঙ্গীকার, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং রোহিঙ্গাসংকটের বিষয় তুলে ধরেন। পাশাপাশি ১৪ মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রম এবং দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের অগ্রগতি সম্পর্কে বিশ্ব সম্প্রদায়কে জানান। গণতান্ত্রিক উত্তরণ নিশ্চিত করতে সরকারের নেওয়া উদ্যোগও ভাষণে গুরুত্ব পায়। এ ছাড়া উন্নয়নশীল দেশ হতে সম্পদ পাচার রোধে কঠোর আন্তর্জাতিক বিধিবিধান প্রণয়ন এবং এর প্রয়োগ নিশ্চিতের প্রস্তাব করেন। প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের সময় উপস্থিত ছিলেন তাঁর সফরসঙ্গী হিসেবে যাওয়া সরকারের উপদেষ্টা ও ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তারা।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের উন্নয়ন কৌশলের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সুশাসন, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি ও টেকসই উন্নয়ন। বিগত দেড় দশকের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি যে জবাবদিহি ছাড়া যে কোনো উন্নয়ন ক্ষণস্থায়ী ও ভঙ্গুর। দায়িত্ব গ্রহণের পর আমরা একে একে আবিষ্কার করি দুর্নীতি ও জনগণের সম্পদ চুরি কী ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করেছিল এবং তার ফলে দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থা কী ভয়ানক নাজুক ও ভঙ্গুর হয়ে পড়েছিল। আমরা এর অবসান ঘটাচ্ছি যেন আর কখনোই উন্নয়ন জনগণের সম্পদ আত্মসাতের অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা না যায়।’
সংস্কার প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে বলেন, ‘শাসনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম, নারী অধিকারসহ সব জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার করার জন্য ১১টি স্বাধীন সংস্কার কমিশন প্রতিষ্ঠা করি। কমিশনগুলো জনমত যাচাই ও গভীর পর্যালোচনা করে বিস্তারিত সংস্কার কার্যক্রম সুপারিশ করে। এ সুপারিশগুলো টেকসইভাবে বাস্তবায়নের জন্য একটি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করি, যারা ৩০টির বেশি রাজনৈতিক দল ও জোটকে নিয়ে আলোচনায় বসে। এ কমিশনের লক্ষ্য ছিল সংস্কার প্রস্তাবগুলোর প্রতি দলমতনির্বিশেষে একটি টেকসই সামাজিক অঙ্গীকার তৈরি করা। আমাদের এ অন্তর্ভুক্তিমূলক পদক্ষেপ সফল হয়। আমরা জুলাই গণ অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে ‘জুলাই ঘোষণা’র মাধ্যমে এ সংস্কার কার্যক্রমের প্রতি সময়াবদ্ধ অঙ্গীকার ব্যক্ত করি। আগামী নির্বাচনে যে দলই জনগণের সমর্থন পাক না কেন, সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে আর কোনো অনিশ্চয়তার অবকাশ থাকবে না।’
তিনি বলেন, ‘গত বছর দায়িত্ব গ্রহণের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারকে আমন্ত্রণ জানাই পতিত স্বৈরশাসক কর্তৃক সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নৃশংসতার চিত্র উদ্ঘাটন করার জন্য। মাঠপর্যায়ে তদন্ত করে বিস্তারিত প্রতিবেদনের পাশাপাশি ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেজন্য তারা যে সুপারিশমালা দিয়েছে, তা আমাদের জাতীয় সংস্কার কার্যক্রমে যুক্ত করেছি। নিবর্তনমূলক স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে মানবাধিকার সুরক্ষাকারী একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় কারিগরি সহায়তা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমাদের দেশে তিন বছর মেয়াদে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের একটি মিশন পরিচালনার অনুমোদন দিয়েছি, যা ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে। আমাদের এসব পদক্ষেপ ও অঙ্গীকার জনগণের প্রত্যাশারই প্রতিফলন। আর এ প্রত্যাশা মূলত একটি গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বহুত্ববাদী সমাজ গড়ে তোলারই প্রত্যাশা।’
‘দেশের পাচার হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধার করা বর্তমানে আমাদের অন্যতম শীর্ষ অগ্রাধিকার’ বলে ভাষণে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘গত ১৫ বছরে দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি ডলার অবৈধভাবে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। আমরা নিরলসভাবে এ সম্পদ ফেরত আনার চেষ্টা করছি। কিন্তু সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর আইনি প্রক্রিয়া এবং অন্য নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার কারণে আমাদের এ প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর দৃঢ় সদিচ্ছা ছাড়া আমরা পাচার হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধারে সফল হব না। বিশ্বের বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা উন্নয়নশীল দেশ থেকে সম্পদের এ অবৈধ পাচার কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিধিবিধান বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ট্যাক্স হেভেনে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থ স্থানান্তরে উৎসাহিত করছে। তাই যেসব দেশ ও প্রতিষ্ঠান এ পাচারকৃত সম্পদ গচ্ছিত রাখার সুযোগ দিচ্ছে, তাদের আমি আহ্বান জানাচ্ছি, তারা যেন এ অপরাধের শরিক না হয় এবং এ সম্পদ তার প্রকৃত মালিক অর্থাৎ কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ করদাতাদের কাছে ফিরিয়ে দেয়। আমি উন্নয়নশীল দেশ থেকে সম্পদ পাচার রোধে কঠোর আন্তর্জাতিক বিধিবিধান প্রণয়ন এবং এর প্রয়োগ নিশ্চিতের প্রস্তাব করছি।’
রোহিঙ্গা ইস্যু তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের প্রতিবেশী মিয়ানমারে চলমান সংঘাত সমগ্র অঞ্চলের জন্য গভীর উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এটি যে শুধু আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাই ঝুঁকিতে ফেলছে তা নয়, বরং বাংলাদেশে আশ্রয়প্রাপ্ত বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের তাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনকেও কঠিন করে তুলেছে। আট বছর পার হলেও রোহিঙ্গাসংকটের কোনো সমাধান দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। উপরন্তু বাংলাদেশ প্রতিনিয়তই মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে বাধ্য হচ্ছে।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এ-সংকটের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী রোহিঙ্গারা, আর তাদের পরেই বৃহত্তম ভুক্তভোগী হলো বাংলাদেশ। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে রোহিঙ্গাসংকট কোনোভাবেই মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো দ্বিপক্ষীয় বিষয় নয়। আমরা শুধু একটি দায়িত্বশীল প্রতিবেশী এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্বশীল সদস্য হিসেবে আমাদের মানবিক দায়িত্ব পালন করে আসছি। কিন্তু তহবিলসংকটের কারণে আজ রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় ন্যূনতম জীবনমান বজায় রাখার আমাদের যৌথ প্রয়াসও ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি তাদের জরুরি সহায়তা কার্যক্রমে মারাত্মক তহবিল ঘাটতির বিষয়ে ইতোমধ্যে সতর্ক করেছে। অবিলম্বে নতুন তহবিল না এলে মাসিক রেশন অর্ধেকে নামিয়ে এনে মাথাপিছু মাত্র ৬ মার্কিন ডলারে নামতে পারে, যা রোহিঙ্গাদের অনাহার ও অপুষ্টিতে নিমজ্জিত করবে; যা তাদের আগ্রাসি কোনো পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করতে পারে। তহবিলের অতিরিক্ত কাটছাঁট হলে তা নিঃসন্দেহে সুরক্ষা ও নিরাপত্তাঝুঁকি বহুগুণ বৃদ্ধি করবে, যা ক্যাম্পের সীমানা ছাড়িয়ে যেতে পারে। তাই আমি বিদ্যমান দাতাদের সাহায্য বাড়াতে এবং সম্ভাব্য নতুন দাতাদের অনুদান প্রদানের আহ্বান জানাচ্ছি, যাতে এ বিপর্যয়কর পরিস্থিতি এড়ানো যায়।’ তিনি বলেন, ‘মানবিক সহায়তার জন্য নতুন ও বর্ধিত তহবিলের বাইরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই মিয়ানমার সরকার বা রাখাইনের অন্য অংশীদারদের ওপর ইতিবাচক পরিবর্তন ও দ্রুত রাজনৈতিক সমাধানের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে হবে। অন্য প্রতিবেশী দেশগুলোকেও তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। রাখাইনে স্থিতিশীলতা আনতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যে কোনো যৌথ প্রচেষ্টায় সহযোগিতা দিতে বাংলাদেশ সদাপ্রস্তুত। আমরা আশা করি, ৩০ সেপ্টেম্বরের উচ্চপর্যায়ের সম্মেলন বিশ্বব্যাপী দৃঢ়সংকল্প তৈরি করবে এবং রোহিঙ্গাদের জন্য বাস্তবসম্মত আন্তর্জাতিক সহায়তা নিশ্চিত করবে, যেখানে তহবিল সংগ্রহ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে একটি রোডম্যাপ গৃহীত হবে এবং সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে রোহিঙ্গাসংকটের স্থায়ী সমাধান খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে।’
সামাজিক ব্যবসা প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বজুড়ে আমরা আজ সামাজিক ব্যবসার ধারণা প্রসার করছি। এটি এমন এক ব্যবসা যার সম্পূর্ণ মুনাফা সামাজিক কল্যাণেই পুনর্বিনিয়োগ করা হয়। আমরা মনে করি প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সুফল বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়ে তরুণদের ঝুঁকিমুক্ত রাখার জন্য শুধু প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন সামাজিক উদ্ভাবন। প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে আমরা ক্ষুদ্র ঋণের ধারণা নিয়ে এসেছিলাম। তখন সেটি ছিল প্রথাগত ধারণার বিরুদ্ধে এক বৈপ্লবিক নিরীক্ষা। কিন্তু আজ বিশ্বব্যাপী তা মূলধারার হাতিয়ার হিসেবে স্বীকৃত। ক্ষুদ্র ঋণ লাখ লাখ মানুষকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করেছে। উদাহরণস্বরূপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গ্রামীণ আমেরিকা বছরে এখন ৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ নিম্ন আয়ের নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিতরণ করেছে এবং এর প্রায় শতভাগ নিয়মিতভাবে পরিশোধ করে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আমি সব সময় মানুষকে আশার বাণী শুনিয়েছি, কখনো ভয় দেখিয়ে কিছু করা আমি সমর্থন করিনি। কিন্তু আজ আমাকে সেখান থেকে সরে এসে ভয়ংকর কিছু কথা বলতে হচ্ছে। আজ আমি সতর্ক করছি, চরম জাতীয়তাবাদ, অন্যের ক্ষতি হয় এমন ভূরাজনীতি এবং অন্যের দুর্ভোগ ও পীড়নের প্রতি ঔদাসীন্য বহু দশকের পরিশ্রমে আমরা যে অগ্রগতি অর্জন করেছি তা ধ্বংস করে দিচ্ছে। এর সবচেয়ে মর্মান্তিক চিত্র আমরা দেখছি গাজায়। শিশুরা না খেয়ে অকালমৃত্যু বরণ করছে, বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে নির্বিচার হত্যা করা হচ্ছে, হাসপাতাল, স্কুলসহ একটি গোটা জনপদ নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হচ্ছে। জাতিসংঘের স্বাধীন তদন্ত কমিশনের সঙ্গে আমরাও একমত যে আমাদের চোখের সামনেই একটি নির্বিচার গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে মানব জাতির পক্ষ থেকে এর অবসানে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি না। এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। বাংলাদেশের জনগণ ও বিশ্বের বিবেকবান নাগরিকের পক্ষ থেকে আমি আবারও জোরালো দাবি জানাচ্ছি যে পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ সমস্যার দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান এখনই বাস্তবায়ন করতে হবে।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘গত বছর বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিভ্রান্তিকর সংবাদ ছড়ানো হয়েছে, যা এখনো চলমান। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পরিকল্পিত মিথ্যা সংবাদ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর ডিপফেকের প্রসার, যা পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছে। এসবের বিরুদ্ধে আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে, যাতে এসব বিকৃত কর্মকাণ্ড মানুষের ওপর মানুষের আস্থা বিনষ্ট না করে কিংবা সামাজিক সম্প্রীতি দুর্বল না করে।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের তিন শূন্যের পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। তরুণরা তিন শূন্য বাস্তবায়নের সৈনিক হয়ে বড় হবে। তাদের সামনে থাকবে শূন্য কার্বন, শূন্য সম্পদ কেন্দ্রীভূতকরণ এবং শূন্য বেকারত্ব। এর ভিত্তিতে তারা গড়ে তুলবে তাদের পৃথিবী।
উন্নয়নে সহায়তা চাইলেন বিশ্বনেতাদের : বাংলাদেশের উন্নয়নে বিশ্বনেতাদের সহায়তা চাইলেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের ৮০তম সাধারণ অধিবেশনের (ইউএনজিএ) সাইডলাইনে প্রধান উপদেষ্টা একাধিক দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নেন এবং বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য সহযোগিতা চান।
জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন আয়োজিত এক উচ্চপর্যায়ের নৈশভোজে ড. ইউনূস কূটনীতিক, জাতিসংঘ কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে শ্রম আইন, শ্রমিকের অধিকার ও চলমান সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা করেন। সেই অনুষ্ঠানে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) শীর্ষ নেতারা এই নৈশভোজে অংশ নেন এবং শ্রম খাত সংস্কার অব্যাহত রাখার প্রতি ঐকমত্য প্রকাশ করেন।
অধ্যাপক ইউনূস বৃহত্তর পরিসরে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য শ্রম সংস্কারকে অপরিহার্য বলে মন্তব্য করেন। তিনি ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের আগে আইএলও কনভেনশনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকারের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন।
পোশাকশিল্পে ন্যায্যমূল্য : বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহম্মদ তাহের এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবিরসহ সব নেতার বক্তব্যেই পোশাক রপ্তানিতে ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করার দাবি অভিন্নভাবে উঠে আসে।
দুই দেশের সরকারপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক : বৃহস্পতিবার নেদারল্যান্ডস প্রধানমন্ত্রী ও আলবেনীয় প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। বৈঠকে নেদারল্যান্ডসের কাছে কৃষি ও জলবায়ু সহযোগিতা চান। ডাচ প্রধানমন্ত্রী ডিক স্কুফের সঙ্গে বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশের গ্রামে হিমাগার (কোল্ড স্টোরেজ) সুবিধা স্থাপনের জন্য নেদারল্যান্ডসের সহযোগিতা চেয়েছেন। এই হিমাগার করতে পারলে কৃষিজাত পণ্য সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণে সহায়ক হবে। এই সময় প্রধান উপদেষ্টা আগামী নির্বাচনের আগে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো ঠেকাতে আন্তর্জাতিক সহায়তা কামনা করেন। ডাচ প্রধানমন্ত্রীও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহারকে গণতন্ত্রের জন্য বড় হুমকি উল্লেখ করে একযোগে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
আলবেনিয়ার প্রেসিডেন্ট বাজরাম বেগাজ বাংলাদেশ থেকে দক্ষ ও অদক্ষ কর্মী নিয়োগের প্রস্তাব দিলে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশ কর্মী সরবরাহে সক্ষম। এজন্য আলবেনীয় সরকারকে ভিসাপ্রক্রিয়া সহজ করার আহ্বান জানান তিনি। সে সময় প্রেসিডেন্ট বেগাজ বাংলাদেশিদের জন্য ই-ভিসা চালুর বিষয়টি বিবেচনার আশ্বাস দেন।
জাতিসংঘের উচ্চপর্যায়ের কর্ম অধিবেশনে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, স্বাস্থ্যসেবা অর্থ উপার্জনকারীদের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়। তিনি মনে করেন, মুনাফা অর্জনের দৃষ্টিভঙ্গি স্বাস্থ্যসেবাকে ব্যাহত করে এবং বিশ্বজুড়ে সামাজিক সমস্যা সমাধানে স্বাস্থ্যসেবা খাতে সামাজিক ব্যবসার মডেলের পক্ষে কথা বলেন। বৈঠকে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী, এসডিজি সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ এবং পররাষ্ট্র সচিব আসাদ আলম সিয়াম উপস্থিত ছিলেন।