ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের ষষ্ঠ ও সপ্তম দিনে তেল আবিবে একের পর এক অন্তত ৩০টি ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে। এতে ইসরায়েলি সামরিক কমান্ড সেন্টার, গোয়েন্দা দপ্তর, ইসরায়েলি সেনাদের চিকিৎসা দেওয়া একটি হাসপাতাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন স্থাপনা লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। এদিকে ইসরায়েলকে রক্ষায় মাকিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। ইরানে হামলার লক্ষ্যে এরই মধ্যে মার্কিন নৌবাহিনীর নতুন ও বৃহত্তম বিমানবাহী রণতরি ইউএসএস জেরাল্ড আর. ফোর্ড ভূমধ্যসাগরের পথে রয়েছে। বিভিন্ন সূত্র বলছে, যে কোনো মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ইরানে হামলা চালাতে পারে। কোনো কোনো সূত্র বলছে, আগামীকাল শনিবার এ হামলা শুরুর আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে খোঁদ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ‘ইরানে হামলার অনুমোদন দেওয়া হলেও কখন হামলা হবে, সেটি আমার নির্দেশের ওপর নির্ভর করছে। আমি কখন বলব, সেটা শুধু আমিই জানি।’
হোয়াইট হাউসের বরাতে বার্তা সংস্থা সিএনএন জানায়, ইরানে হামলার সিদ্ধান্তের আগে কূটনীতির জন্য দুই সপ্তাহ সময় দেবেন ট্রাম্প।
ব্লুমবার্গ নিউজ গতকাল জানিয়েছে, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে পড়ছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এরই মধ্যে ইরানে হামলার পরিকল্পনার অনুমোদন দিয়েছেন। মার্কিন জেনারেলরাও সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। এখন শুধু ট্রাম্পের আদেশের অপেক্ষা করা হচ্ছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘ফেডারেল সংস্থার কয়েকজন শীর্ষনেতাও হামলার জন্য প্রস্তুতি শুরু করেছেন।’ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ইসরায়েলি অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের যোগদানের সিদ্ধান্ত কী’ সাংবাদিকদের এমন এক প্রশ্নের জবাবে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বৃহস্পতিবার সরাসরি উত্তর প্রদান থেকে বিরত থাকেন। তবে তিনি ইসরায়েলের সঙ্গে মিলে ইরানে হামলার ব্যাপারে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমায় বলেন, ‘আমি সেটা করতে পারি, আবার না-ও করতে পারি। কেউ জানে না, আমি কী করব।’ তিনি মার্কিন বাহিনীকে ইরানে হামলার অনুমতি দেওয়ার কথা স্বীকার বলেন, ‘আমার নির্দেশের ওপরই এখন সবকিছু নির্ভর করছে। আমি কখন নির্দেশ দেব সেটা আমিই শুধু জানি।’ রয়টার্স জানিয়েছে, ইরানের চলমান ইসরায়েলি অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের যোগ দেওয়া নিয়ে রহস্য সৃষ্টি করে রেখেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এরপর ভিন্ন এক বক্তব্যে ট্রাম্প জানিয়েছেন, ইরানি কর্মকর্তারা বৈঠক করতে ওয়াশিংটন আসার আগ্রহ দেখিয়েছেন। এতে তিনি সবুজসংকেত হয়তো দেবেন, তবে এখন আলাপ-আলোচনার জন্য অনেক দেরি হয়ে গেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে সিএনএন ও ওয়াশিংটন পোস্টের খবরে বলা হয়েছে, মার্কিন নৌবাহিনীর নতুন ও বৃহত্তম বিমানবাহী রণতরি ইউএসএস জেরাল্ড আর. ফোর্ড ভূমধ্যসাগরে মোতায়েনের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। এটি ইরানের দিকে যাত্রা করবে। খবরে আরও বলা হয়েছে, এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে তাদের ঘাঁটিগুলো সক্রিয় করেছে। এ ছাড়া বাইরে থেকে যুদ্ধাস্ত্র এনে এই অঞ্চলে সামরিক সরঞ্জাম পুনর্বিন্যাস করা হচ্ছে। সর্বশেষ আপডেট হলো, ইউএসএস জেরাল্ড আর. ফোর্ডও মোতায়েন হতে চলেছে। সে অনুযায়ী, এটি হবে এই অঞ্চলে মোতায়েন তৃতীয় মার্কিন বিমানবাহী রণতরি। এটি পারস্য উপসাগরে থাকা ইউএসএস কার্ল ভিনসন এবং এই সপ্তাহের শুরুতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে পাঠানো ইউএসএস নিমিৎজের সঙ্গে যোগ দেবে।
মার্কিন নৌবাহিনীর বরাত দিয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধে সক্ষম ধ্বংসকারী যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস টমাস হাডনারকে পশ্চিম ভূমধ্যসাগর থেকে পূর্ব ভূমধ্যসাগরের দিকে যাত্রা শুরু করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আরেকটি ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসকারী জাহাজকেও অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ইরানে হামলার সিদ্ধান্তের আগে কূটনীতির জন্য দুই সপ্তাহ সময় দেবেন ট্রাম্প- হোয়াইট হাউস : হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য সামরিক হামলার আগে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার জন্য আরও দুই সপ্তাহ সময় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সিএনএনের খবরে বলা হয়, গতকাল এক বিবৃতিতে এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন ল্যাভিট এ বিষয়ে ব্রিফিং করেন।
৩০ মিসাইল হামলা ইরানের : টাইমস অব ইসরায়েল খবর দিয়েছে, ইসরায়েলি ভূখণ্ডে আরও ৩০টি ব্যালিস্টিক মিসাইল হামলা চালিয়েছে ইরান। এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বুধবার দিনগত রাত এবং গতকাল সকাল থেকে ইসরায়েলে ৩০টি ইরানি মিসাইল আঘাত হানে। একটি মিসাইল আবারও দক্ষিণ ইসরায়েলের আহত সেনা ও সাধারণ লোকজন ভর্তি থাকা সোরোকা হাসপাতালে আছড়ে পড়ে। এতে হাসপাতালটির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া মধ্য ইসরায়েলের হোলন ও রামাত গান এলাকাতেও আঘাত হানে ইরানি মিসাইল। ইরানের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যম ইরনা বৃহস্পতিবারের খবর দিয়ে জানায়, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর কমান্ড সেন্টার, গোয়েন্দা বিভাগের সদর দপ্তর এবং সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা শাখার একটি শিবিরে আঘাত হেনেছে। বৃহস্পতিবার ভোর থেকে ইসরায়েলের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে ইরানের সামরিক বাহিনী। এটা ছিল নিখুঁত এবং সরাসরি আঘাত। ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রে এই তিন সামরিক স্থাপনার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
আরেক খবরে আলজাজিরা জানিয়েছে, ইরানে ইসরায়েলের বিমান বাহিনী অভিযান শুরুর পর সাধারণ ইসরায়েলিদের ধারণা ছিল যে সার্বিক পরিস্থিতি ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে আছে। কিন্তু সংঘাতের ষষ্ঠ দিনেই ইরান থেকে নিক্ষিপ্ত একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলিদের সেই ধারণাকে নড়বড়ে করে দিয়েছে। বুধবার ভোর থেকে ইসরায়েলের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে ইরান। গতকালও দফায় দফায় ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়। এতে ভূখণ্ডটির বহু স্থাপনা লন্ডভন্ড হয়ে গেছে।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বিবিসি জানিয়েছে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলের আরও অন্তত তিনটি বেসামরিক স্থাপনা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ সময় ইসরায়েলের বেশির ভাগ অংশে সাইরেনের শব্দ পাওয়া গেছে। তেল আবিব ও জেরুজালেমেও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। গত কয়েক দিনের মধ্যে এটাই ইসরায়েলে ইরানের সবচেয়ে বড় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ অবস্থায় ইসরায়েলি বিশ্লেষক ওরি গোল্ডবার্গ বলেছেন, এ রকম ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনা ইসরায়েলের সাধারণ বাসিন্দাদের হতবাক করেছে। কারণ এত দিন পর্যন্ত তাদের ধারণা ছিল, সার্বিক পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে। আজ তারা বুঝতে পেরেছে যে এই ধারণা পুরোপুরি সঠিক ছিল না। অপরদিকে ইরানি হামলার ব্যাপারে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এ হামলার জন্য ‘তেহরানের দানবদের’ মূল্য চুকাতে হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি ইসরায়েলের তরফ থেকে দাবি করা হয়েছে, ইরানি হামলার জবাবে তারাও বুধবার থেকে গতকাল পর্যন্ত ইরানের আরাক পারমাণবিক চুল্লিসহ বিভিন্ন স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। রাতভর তাদের বাহিনীর ৪০টি যুদ্ধবিমান একাধিক ইরানি অস্ত্র কারখানায় হামলা চালিয়েছে।
চীন থেকে ইরানে রহস্যময় বিমান : দ্য টেলিগ্রাফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীন থেকে ইরানে রহস্যময় বিমান পাঠানো হয়েছে। এ বিমান নিয়ে শুরু হয়েছে নানা জল্পনাকল্পনা। জানা গেছে, ইরানে ইসরায়েলের হামলার ঠিক এক দিন পর চীন থেকে একটি রহস্যজনক কার্গো বিমান ইরানের দিকে রওনা হয়। এরপর আরও একটি বিমান চীনের উপকূলীয় শহর থেকে ছেড়ে গেছে। সোমবার সাংহাই থেকে তৃতীয় আরও একটি বিমান ইরানে গেছে। এ নিয়ে তিন দিনে তিনটি বোয়িং ৭৪৭ বিমান ইরানে পাঠানো হয়েছে। ফ্লাইট ট্র্যাকিং ডেটা অনুযায়ী, প্রতিটি বিমান উত্তর চীন পেরিয়ে কাজাখস্তান, তারপর উজবেকিস্তান এবং তুর্কমেনিস্তান হয়ে ইরানের দিকে যাত্রা করে। এসব বিমান ইরান সীমান্তের কাছে গিয়ে হঠাৎ রাডার থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুদ্ধের মধ্যে ইরানে বিমান পাঠানোয় নতুন উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। এসব বিমানে কী পাঠানো হয়েছে, তা নিয়েও নানা জল্পনাকল্পনা চলছে। এভিয়েশন বিশ্লেষকরা বলছেন, এই বোয়িং ৭৪৭ বিমানগুলো সাধারণত সামরিক সরঞ্জাম পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হয় এবং সরকারিভাবে চুক্তিবদ্ধ পরিবহনেও ব্যবহার করা হয়।
এক্সেটার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় চীনের কূটনীতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ড. আন্দ্রেয়া ঘিসেল্লি বলেন, চীনের পক্ষ থেকে ইরানকে সহায়তার প্রত্যাশা অনেকের মধ্যেই রয়েছে এবং এই কার্গো ট্রান্সপোর্টগুলো সেই সম্ভাবনার দিকে ইঙ্গিত দিতে পারে। অন্যদিকে ইসরায়েলের নিরাপত্তা গবেষণা সংস্থার গবেষক তুভিয়া গেরিং বলেন, চীনা সামরিক সরঞ্জাম ইরানে পৌঁছেছে কি না, তা পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। তবে সম্ভাবনাটি উড়িয়ে দেওয়া উচিত হবে না।
এদিকে ফ্লাইট অপারেটর লুক্সেমবার্গভিত্তিক কার্গোলাক্স দাবি করেছে, তাদের ফ্লাইটগুলো ইরানি আকাশপথ ব্যবহার করেনি। তবে তারা বিমানের কার্গো নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
পুতিন-শি জিনপিংয়ের ফোনালাপ : চলমান ইরান-ইসরায়েল সংঘাত নিয়ে ফোনে কথা বলেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। খবরে বলা হয়, চীনের প্রেসিডেন্ট এই সংঘাত নিরসনে ‘বড় শক্তিগুলোর’ প্রতি উত্তেজনা কমানোর আহ্বান জানিয়েছেন। এটি ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য হস্তক্ষেপ বিবেচনায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রতি পরোক্ষ বার্তা বলে ধারণা করা হচ্ছে।