প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, যতদিন তিনি দায়িত্বে আছেন, ততদিন দেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ হতে দেবেন না। এ ছাড়া কিছুতেই জাতীয় নির্বাচন ২০২৬ সালের জুন পার হবে না। কম সংস্কার চাইলে ডিসেম্বরেও হতে পারে, বেশি সংস্কার চাইলে জুন পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। জুনের পর এক ঘণ্টাও ক্ষমতায় থাকবে না অন্তর্বর্তী সরকার।
গতকাল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইউনূস এমন আশ্বাস দিয়েছেন বলে বৈঠক শেষে জানিয়েছেন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা। প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় গতকাল বিকাল থেকে দুই দফায় এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
দেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিপেক্ষিতে নির্বাচন, সংস্কারসহ নানা ইস্যু নিয়ে এদিন বামপন্থি, ইসলামিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের ২০ জন শীর্ষ নেতার সঙ্গে বৈঠক করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত শনিবার বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি।
বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে নেতারা বলেন, বৈঠকে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে প্রধান উপদেষ্টা জানান, গত বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে তার (প্রধান উপদেষ্টা) কাছে মনে হচ্ছিল সংস্কার, নির্বাচনসহ যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন, সেগুলোতে তিনি ব্যর্থ হবেন। এজন্য তিনি পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। পদত্যাগপত্র লেখারও উদ্যোগ নেন। পরে অন্যরা তাকে নিবৃত করেন।
বৈঠকে দ্রুত নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা, গণহত্যার বিচার দৃশ্যমান করা, বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে সরকারের সিদ্ধান্ত মানুষকে জানানো, সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ স্পষ্ট করা, প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নির্বাচন আয়োজন ও বৃহত্তর সংস্কারের দায়িত্ব নির্বাচিত সরকারের হাতে হস্তান্তর, সব রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের প্রতি সমান দৃষ্টিভঙ্গি রেখে সরকারকে দলনিরপেক্ষ ভূমিকা বজায় রাখা, মিয়ানমারে মানবিক করিডর, চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যবস্থাপনা বিদেশিদের হাতে দেওয়ার মতো জাতীয় নিরাপত্তাসংশিষ্ট ইস্যুগুলোতে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নেওয়া, বিতর্কিত উপদেষ্টাদের অপসারণসহ নানা পরামর্শ দেন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা আশ্বস্ত করে বলেন, তিনি যতদিন আছেন, ততদিন দেশের অনিষ্ট হয় এমন কোনো কাজ হবে না।
বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, বৈঠকে সংস্কার, বিচার, নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছে। আগামী জাতীয় নির্বাচন ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যেই হবে বলে নিশ্চিত করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। সবাই এতে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
প্রথম দফায় বৈঠক অংশ নেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম, এবি পার্টির চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান মঞ্জু, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা খালেকুজ্জামান ভূঁইয়া, জাতীয় গণফ্রন্টের সমন্বয়কারী টিপু বিশ্বাস ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন।
দ্বিতীয় দফায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমান, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমেদ আবদুল কাদের, হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির জাতীয় নির্বাহী পরিষদের মহাসচিব মাওলানা মুসা বিন ইজহার ও ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজি। বৈঠক শেষে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, আমরা বলেছি, অর্থবহ সংস্কার করতে জনগণের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। জনগণের অংশগ্রহণ সম্ভব একমাত্র নির্বাচনের মাধ্যমে। নির্বাচন দিতে যতটুকু সংস্কার প্রয়োজন সেটা করে নির্বাচিত সরকারের হাতে বাকি সংস্কারের দায়িত্ব ছেড়ে দিতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারকেই সবকিছু করতে হবে তার কোনো মানে নেই।
মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, প্রফেসর ইউনূস আলোচনা শুরু করেছেন এই বলে যে, অনেক বড় সংকটের মধ্যে আমরা আছি। তিনি ভারতীয় আধিপত্যবাদের ষড়যন্ত্রের কথা বলেছেন। এজন্য উনি (প্রধান উপদেষ্টা) চিন্তিত। তাই তিনি মনে করছেন সমগ্র জাতির একত্রিত হওয়া দরকার। দিন দিন ঐক্যটা দুর্বল হচ্ছে। এজন্য উনি হতাশ। আমরা বলেছি, জাতীয় ইস্যুতে আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকব। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, গত বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উনার মনে হয়েছিল তিনি এতদিন যা যা করেছেন সবকিছু ব্যর্থ হয়ে যাবে। সংস্কার করতে পারবেন না, সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে পারবেন না। তাই উনি পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরে সবাই তাকে বাধা দেন। আমরা বলেছি, আপনাকে বেশি করে রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত হতে হবে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন এটা আমাদের জানিয়েছেন। আমরা বলেছি, পদত্যাগ বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধান দেবে না। আমরা আপনার ওপরে আস্থা রাখতে চাই।
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান মঞ্জু বলেন, আমরা মৌলিক সংস্কার শেষে ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার অনুরোধ করেছি। গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, করিডর ও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনা বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার বিষয় নিয়ে মানুষের মধ্যে উদ্যোগ তৈরি হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত এখন নানা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছি। যেসব উপদেষ্টা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, বিশেষ করে আন্দোলনকারী ছাত্রনেতাদের মধ্যে যারা উপদেষ্টা হয়েছেন, তারা একটা দল (এনসিপি) করেছেন, সেই দলকে সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষায় আমরা সেই দুই উপদেষ্টাকে অপসারণ, অথবা তাদের বুঝিয়ে পদত্যাগের দিকে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছি।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী বলেন, জাতীয় স্বার্থে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা আশ্বস্ত করেছেন তার মাধ্যমে এ দেশের কোনো অনিষ্ট হবে না। আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, অনেক আশা-ভরসা নিয়ে জাতি আপনাকে এ দায়িত্বে বসিয়েছে। আপনি ধৈর্য, সাহস ও প্রজ্ঞার সঙ্গে সব রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে মৌলিক সংস্কারগুলো শেষ করবেন।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক বলেন, প্রধান উপদেষ্টা কমিটমেন্ট করেছেন, ২০২৬ সালের জুনের পরে এক ঘণ্টাও তিনি ক্ষমতায় থাকবেন না। তার আগেই নির্বাচন দেবেন। সংস্কারে এখন পর্যন্ত কাক্সিক্ষত অগ্রগতি হয়নি। সংস্কার এভাবে অনিশ্চিত গন্তব্যে যেতে পারে না। তাই কতটুকু সংস্কার হবে, কতটুকু কাজ হয়েছে তা পরিষ্কার করতে অনুরোধ করেছি। নির্বাচনের আগে ফ্যাসিবাদী আমলের সব হত্যাকাণ্ডের বিচার দৃশ্যমান করার দাবি করেছি।
সংশিষ্টরা বলছেন, জুলাই আন্দোলনের ঐক্য কয়েক মাস বজায় থাকলেও তাতে ফাটল দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন ইস্যুতে প্রথমে ছাত্রদের মধ্যে অনৈক্য দেখা দেয়। তার পর রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ ও ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ নিয়ে বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলেনের দূরত্ব তৈরি হয়। এরপর নতুন দল এনসিপির আত্মপ্রকাশের পর সংস্কার ও নির্বাচন বিষয়ে মিত্র দলগুলোর মধ্যে বিভেদ স্পষ্ট হতে শুরু করে। এর মধ্যে বিএনপি ও এনসিপি পাল্টাপাল্টি ছয়জন উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করে। নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগ দাবি করেছে এনসিপি। একের পর এক আন্দোলনে অচল হয়ে যাচ্ছে রাজধানী।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের শপথ নিয়েও সরকারের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব তৈরি হয়েছে। নির্বাচনসহ বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ বাড়ায় অনেকটা বিব্রত প্রধান উপদেষ্টা। নানা ক্ষোভ ও হতাশা থেকে অধ্যাপক ইউনূস পদত্যাগ করতে চাইছেন- এমন খবরে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের আহ্বান জানায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। এর পরিপ্রেক্ষিতে শনিবার থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক শুরু হয়।
প্রধান বিচারপতির সাক্ষাৎ : রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকের আগে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় সূত্র জানায়, প্রধান বিচারপতি বিকাল ৫টার দিকে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় প্রবেশ করেন। বৈঠক শেষে বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে তিনি যমুনা ত্যাগ করেন। তবে তাদের মধ্যে কী নিয়ে আলোচনা হয়েছে তা জানা যায়নি।