মিছিল-মিটিং-রাজনৈতিক উত্তাপ-মিডিয়ায় টকশো আর বিস্ফোরক সব মন্তব্যে মানুষ যখন ত্যক্ত বিরক্ত, এ সময় হানিফ সংকেতের ইত্যাদি যেন তীব্র খরার পর এক পশলা বৃষ্টির মতো স্বস্তিদায়ক। আমাদের অনিয়ম-অসংগতি, আক্রমণ-প্রতিআক্রমণ, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষতগুলোকে অত্যন্ত মুনশিয়ানার সঙ্গে তুলে ধরে অশান্ত পরিবেশে যেন শান্তির বার্তা বয়ে আনে ইত্যাদি। ইত্যাদি যেন নিজেকেই নিজে ছাড়িয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। বর্ষার ভরা মৌসুমে ঝুঁকি নিয়ে চরফ্যাশনের মতো দুর্গম এলাকায় কেউ অনুষ্ঠান করতে পারেন তা ভাবাই যায় না। কারণ এ সময় উত্তাল থাকে সমুদ্র। আর সমুদ্রের কোলঘেঁষেই এই চরের অবস্থান। উত্তাল মেঘনা আর সমুদ্রের মোহনায় অবস্থিত চর কুকরি-মুকরি, বঙ্গোপসাগরের মোহনায় নতুন জেগে ওঠা তাড়ুয়া দ্বীপ, আর মনপুরার দখিনা হাওয়া সমুদ্রসৈকত কিছুই বাদ যায়নি এবারের ইত্যাদিতে। ভোলার নৈসর্গিক সৌন্দর্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য-আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রসহ ভোলার মহিষ বাথান, মহিষের দই, ’৭০-এর ঘূর্ণিঝড়, উত্তাল সমুদ্রে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জেলেদের মাছ ধরা প্রতিটি বিষয়ই অত্যন্ত নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন হানিফ সংকেত। রুপালি ইলিশের অন্যতম আবাসস্থল ভোলা। আর এই মাছ আহরণের জন্য ভোলার সবচেয়ে বড় চরফ্যাশনের সামরাজ মাছ ঘাট। যেখানে সাগর থেকে কীভাবে মাছ আসে, ঝুঁকির মধ্যেও জেলে শিশুদের নিয়ে মাছ ধরা, জেলেদের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট, সামুদ্রিক জীবন, মেঘনার ভাঙাগড়া-এসব দৃশ্য দর্শকরা বিস্ময় ও মুগ্ধতা নিয়ে দেখেছেন। এবারের ইত্যাদিতে জানা গেল ভোলা মাঝির নামে এ জেলার নামকরণ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের এই একটিমাত্র জেলার প্রতিটি উপজেলার নামকরণই হয়েছে মানুষের নামানুসারে। অভিজাত এলাকা গুলশান সম্পর্কে অজানা তথ্য জানা গেল। একসময় এই গুলশানে ভোলার মানুষ এসে আবাদ করত বলে স্থানীয় লোকজন এলাকাটির নাম দিয়েছিল ভোলা গ্রাম। প্রমাণ হিসেবে সেই আমলের দুটি নিদর্শন দেখালেন হানিফ সংকেত। গুলশান জামে মসজিদ যার পূর্ব নাম ছিল ভোলা জামে মসজিদ এবং ভোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়-যেটি বর্তমানে মধ্যবাড্ডায় অবস্থিত। কমরেড নলিনী দাস, ‘জাতীয় মঙ্গলের কবি’ খ্যাত কবি মোজাম্মেল হক, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফা কামালের মতো বীর ও গুণী মানুষের জন্মস্থান এই ভোলা। এবারের ইত্যাদির প্রতিটি বিষয়ই ছিল শিক্ষণীয়, আনন্দদায়ক ও হৃদয়স্পর্শী। এআইয়ের সঙ্গে দাদির চমৎকার আলাপে উঠে এসেছে বয়স্ক মানুষের নিঃসঙ্গতা, এআইয়ের অপব্যবহারসহ নানা দিক। সংস্কৃতির সংজ্ঞা, বড় চোর আর ছোট চোরদের নিয়ে বিদ্রƒপাত্মক গারোদালোচনা ছিল সমসাময়িক। চলচ্চিত্রের বাস্তব অবস্থার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে প্রযোজক এবং নায়িকার সাক্ষাৎকারে। চীনের বেইজিংয়ের সামার প্যালেসের প্রতিবেদনটিও ছিল বেশ উপভোগ্য ও তথ্যসমৃদ্ধ। কাশেম টিভির রিপোর্টার ও নাতির কথোপকথন বেশ জমে উঠেছে। ’৭০-এর ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে স্বজন হারানো প্রত্যক্ষদর্শী মান্নান শিকদারের চোখ ভেজা সাক্ষাৎকারটি ছিল বেশ হৃদয়স্পর্শী। এভারেস্ট বিজয়ী ভোলার ছেলে এম এ মুহিতের সাক্ষাৎকারে ছিল তরুণদের জন্য চমৎকার বার্তা, আর এভারেস্টের চূড়ায় উঠে ইত্যাদির লোগো প্রদর্শন করার কারণ হিসেবে মুহিত বলেন, ‘ইত্যাদি এভারেস্ট সমান উচ্চতায় অবস্থান করছে।’ ইত্যাদির প্রতি ভালোলাগা ও ভালোবাসা থেকেই মুহিতের এই ‘ইত্যাদি নিয়ে এভারেস্ট চূড়ায়’ ওঠা বলে জানান। জীবিকার তাগিদে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেও ঝুঁকি নিয়ে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়া একটি জেলে পরিবারের করুণ চিত্র তুলে ধরা হয় অনুষ্ঠানের শেষ প্রতিবেদনে। একই পরিবারের তিনজন সদস্যের মৃত্যু হয় ঝড় দুর্ঘটনায়। ইত্যাদির পক্ষ থেকে অসহায় এই পরিবারটিকে ২ লাখ টাকার একটি চেক প্রদান করা হয়। ইত্যাদি দেখলেই বোঝা যায় এর নির্মাণের পেছনে প্রচুর গবেষণা করা হয়। সবচেয়ে বড় কথা প্রতিটি জেলাভিত্তিক ইত্যাদিই আর্কাইভে রাখার মতো। শুনেছি সরকারিভাবেই অনুষ্ঠানটি আর্কাইভে রাখা হয়। যদি না হয় তাহলে শিগগিরই এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া উচিত।