মহানায়ক উত্তম কুমার এই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে অনন্তলোকের বাসিন্দা হয়েছেন আজ প্রায় ৪৫ বছর হলো। ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই মারা যান তিনি। অথচ বাংলার মানুষের মনে আজও চির অমর হয়ে আছেন এই মহানায়ক। আজ তাঁর প্রয়াণ দিবস- শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে বিশ্বের উত্তমভক্তরা। ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা উত্তম কুমার। নিপুণ অভিনয় দক্ষতার কারণে বাংলা চলচ্চিত্র তাঁকে ‘মহানায়ক’ খেতাব দিয়েছে। তাঁকে বাঙালি সংস্কৃতির আইকন এবং বাংলার ম্যাটিনি আইডল রূপে ধরা হয়। তাঁর ভক্তরা উত্তমকে ‘গুরু’ বলে ডাকে। তবে তাঁর প্রকৃত নাম অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়। উত্তম কুমার অভিনয়ের পাশাপাশি গান খুব পছন্দ করতেন। গান তাঁর জীবনের একটা অংশ ছিল। উত্তম কুমার যে দারুণ গাইতে পারতেন, তা কিন্তু মোটামুটি সবাই জানেন। এমনকি প্রথম জীবনে দক্ষিণ কলকাতার এক স্কুলে গানের শিক্ষকতাও করেছেন উত্তম। নিজের গাওয়া গানে অভিনয়ও করেছেন উত্তম কুমার। কিন্তু জানেন কি এমন এক বাংলা ছবি রয়েছে, যেখানে সাতটি গান গেয়েছিলেন মহানায়ক এবং ছবিতে প্লেব্যাকের সুযোগ একবারই পেয়েছিলেন। সালটা ১৯৫৬। তারিখ ২৪ ডিসেম্বর। মুক্তি পায় উত্তম কুমার, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের ছবি ‘নবজন্ম’। পরিচালক দেবকী কুমার বসু। ছবির সংগীত পরিচালক নচিকেতা ঘোষ। ওই ছবিতে সাতটি কীর্তন গেয়েছিলেন উত্তম। সংগীত পরিচালক নচিকেতা ঘোষ বৈষ্ণব পদাবলির সাতটি ছোট ছোট পদ গাইয়েছিলেন উত্তম কুমারকে দিয়ে। শোনা যায়, এই ছবির জন্য সঠিক কীর্তন গাওয়ার গায়ক খুঁজছিলেন সংগীত পরিচালক নচিকেতা ঘোষ। সে খবরটাই কানে আসে উত্তমের। উত্তম জানিয়েছিলেন, অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি ছবিটির গান গাইবেন। এতে তাঁর অভিনয়ও ভালো হবে। নচিকেতা ঘোষ প্রথম দিন রেকর্ডিংয়েই বুঝে
গিয়েছিলেন উত্তম একেবারে সঠিকভাবেই কীর্তন গাইছেন। আর সে কারণেই একটি নয়, ছবিটির সাতটি কীর্তনই উত্তমকে দিয়ে গাইয়েছেন নচিকেতা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুটি গান হলো- ‘কানু কহে রাই, কহিতে ডরাই’ ও ‘আমি আঙুল কাটিয়া’। তবে উত্তমের গাওয়া গানগুলো ছবিতে ব্যবহার হলেও রেকর্ডে রাখা হয়নি। তবে এটিই একমাত্র বাংলা ছবি যেখানে শোনা গিয়েছিল উত্তম কুমারের কণ্ঠ। যদিও সিনেমার বাইরে উত্তম গান করেছেন বিভিন্ন চ্যারিটি শোতে। অনেক ঘরোয়া আয়োজনে গান করেছেন। এমন এক ঘরোয়া আসরে উত্তমের গাওয়া ‘এই মম জোছনায়...’ গানটি রেকর্ড হয়ে বেরিয়েছিল মেগাফোন কোম্পানি থেকে। প্রসঙ্গত, গানটি আসলে আরতি মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া পুজোর গান। উত্তম কুমারের পাড়ার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ড. লালমোহন মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ৪৬-৪৭ দাঙ্গার সময় নিজের কথা ও সুরে একটি গান বেঁধে উত্তম কুমার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে গাইতেন। গানটা ছিল- ‘হিন্দুস্তান মে কেয়া হ্যায় তুমহারা ও ব্রিটিশ বেচারা। আভি চলে যাও ইংল্যান্ড বাজা কর ব্যান্ড।’ উত্তম কুমার সংগীত গুরু হিসেবে পেয়েছিলেন নিদানবন্ধু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো একজন গুণী শিল্পীকে। ইনি ধ্রুপদী, ধামাল, খেয়াল, ঠুংরি ইত্যাদি সব ধরনের শাস্ত্রীয় সংগীতে পারদর্শী ছিলেন। অমর ভট্টাচার্য, বিনোদ মল্লিক, মণিলাল দাস, মেহেদী হাসান (রামপুর), সত্যেন সেন (পাতিয়ালা), রামদাস মিশ্র (বেনারস) প্রমুখ দিকপাল সংগীত গুণীর কাছে তালিম নিয়েছিলেন নিদানবন্ধু বাবু। এমন একজন সংগীত শিক্ষক নির্বাচন থেকে স্পষ্ট হয়, গান শেখার ব্যাপারে কতখানি নিবিষ্ট ছিলেন উত্তম কুমার। নিয়মিত রেওয়াজ করতেন। রবীন্দ্রসংগীত ছিল তাঁর ভীষণ প্রিয়। পরবর্তীকালে সুযোগ পেলেই তিনি রবীন্দ্রসংগীত গেয়েছেন।