নিজেকে অযোগ্য মনে করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) থেকে পদত্যাগ করেছেন চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলা শাখার সমন্বয়ক মুহাঈমেনুল ইসলাম সিফাত। ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে এ সিদ্ধান্তের কথা জানান তিনি। এর আগে এনসিপি থেকে ‘ব্যক্তিগত কারণ’ দেখিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতা মোল্লা মোহাম্মাদ ফারুক এহসান, আবু হানিফ, হানিফ খান সজীব, আবদুজ জাহের, রিদওয়ান হাসানসহ কয়েকজন। এনসিপি থেকে বহিষ্কারের কিছু ঘটনাও যোগ হয়েছে। এর মধ্যে বহিষ্কৃত নেতা গাজী সালাউদ্দিন তানভীরের দুদকের জালে আটকা পড়ার ঘটনা বেশ আলোচিত। এ ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের দুই উপদেষ্টার সাবেক এপিএস-পিওর বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগও অনুসন্ধান করা হচ্ছে। সেখানে নতুন করে যোগ হয়েছে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে ট্রাক আটকে চাঁদাবাজির সময় এনসিপি নেতা তারিকুল ইসলাম সেনাবাহিনীর হাতে আটকের ঘটনা।
আদৌ কাম্য বা প্রত্যাশিত ছিল না তারুণ্যের এমন লজ্জাজনক পতন। প্রত্যাশা- আকাঙ্খাক্ষার পারদ কতই না তুঙ্গে ছিল তাদের নিয়ে। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের এই ফ্রন্টলাইনারদের সঙ্গে মমতা-ভালোবাসার একটি অলিখিত চুক্তিনামা হয় জনমানুষের। আবেগের বশে কেউ তাদের বখতিয়ার খিলজি, কেউ জালিমের বিরুদ্ধে আল্লাহর প্রেরিত আবাবিল পাখি পর্যন্ত ভেবে নেয়। নানা ক্রিয়াকর্মে সেই স্নেহ-মর্যাদা-বিশ্বাস এরই মধ্যে বরবাদ করে দিয়েছেন একসময়ের পরমাদরের শিক্ষার্থী সোনামণিরা। যেখানে-সেখানে মব দুষ্কর্ম, চাঁদা-বখরা-তদবিরবাজিসহ হেন কুকর্ম নেই যাতে গেল ৯-১০ মাসে তারা হাত পাকাননি।
প্রকাশ্য ভালোবাসা-বিশ্বাসের রাখিবন্ধনের জেরে তারা প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের জন্যও আপদ হয়ে উঠেছেন। তাদের মাস্টারমাইন্ড জ্ঞান করেন বলে তাঁকেও দূষতে ছাড়ছেন না কেউ কেউ। আবার রাগে-দুঃখে তিনি পদত্যাগ করতে চেয়েছেন। এ খবরটাও তাদের মাধ্যমেই বাজারজাত হয়েছে। এক অর্থে যা ড. ইউনূসের জন্য নিদারুণ দুর্ভাগ্যের। সর্বশেষ সরকারি কর্মচারীদের মৃদু আন্দোলনটিও তেজী হয়েছে তাদের কারণেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উসকানি দিয়ে এবং রাজপথে মব সৃষ্টি করে তারা ঘামাচিকে ফোড়া বানিয়েছেন। একই কুকীর্তি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ইশরাক হোসেনের শপথ বানচাল নিয়েও চলেছে। এসব করে দিনে দিনে তারা কেবল দেনা বাড়িয়ে চলেছেন। নিজেরা ডুবছেন। ডুবাতে বসেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসসহ তাঁর নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকেও।
তারুণ্যের প্রতি আবেগ এবং জুলাই-আগস্টের বিপ্লব তাদের প্রতি বাড়তি ভালোবাসা জন্মেছিল অনেকের। তারা প্রথাগত দলগুলোর মতো মতলবি-বেপরোয়া হবে না বলে তাদের গঠিত দলের প্রতি একটি পর্যবেক্ষণও জন্ম দেয়। মাঝেমধ্যে এক-আধটু বখে গেলেও ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখাও হতে থাকে। কিন্তু ক্রমশ নানা দুষ্কর্মে জড়িয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে সেই সমন্বয়করা এখন নিশ্চিত ঝুঁঁকিতে। তাদের দলের ভবিষ্যৎও অন্ধকার। গণমাধ্যম আর স্যোশাল মাধ্যম ছাড়া মাঠে-ময়দানে অস্তিত্ব নেই। কখনো কখনো সোশ্যাল মিডিয়াকেও আনসোশ্যাল করে ফেলছেন তারা। তাদের কারও কারও মধ্যে আবার দ্রুতগতিতে আখের গুছিয়ে নেওয়ার ভূত ভর করেছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে নানা ঘটনায়। মবের সম্প্রসারণ ঘটাতে গিয়ে তারা কখনো কখনো কোনো কোনো অফিসেও ঢুকে পড়ছে। কেবল চাকরি দেওয়া নয়, চাকরিচ্যুত করার ফরমানও জারি করছে। মিল-ফ্যাক্টরিতে ঢুকে পড়ছে। বলছে ব্যবসা দিতে। নইলে উৎপাদনের চাকা বন্ধের হুঁশিয়ারি। শ্রমিক-কর্মচারীদের উসকে দিয়ে গন্ডগোল বাধানোর থ্রেট।
এই বেপরোয়াপনার সিরিয়ালেই সামনে আসে তারুণ্যের দুই উপদেষ্টার এপিএস ও পিওর তদবিরবাণিজ্যে শতকোটি টাকা হাতানোর খবর। স্থানীয় সরকার এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার এপিএস মোয়াজ্জেম হোসেন বা স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগমের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (ছাত্রপ্রতিনিধি) তুহিন ফারাবি ও ডা. মাহমুদুল হাসানরা অবুঝচিত্তে কুতকুত খেলতে গিয়ে শত-হাজার কোটি টাকা কামাননি। বয়সে ছোট হলেও বড় সাইজের দুর্নীতিতে তারা হাত পাকিয়েছেন মাস কয়েকেই। অভিযোগ উঠেছে তারা তদবিরবাণিজ্য ও ফ্যাসিবাদের দোসর চিকিৎসক-প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অর্থের বিনিময়ে পুনর্বাসনে সহায়তা করে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। স্থানীয় সরকার, স্বরাষ্ট্র, স্বাস্থ্য, পানিসম্পদ, গণপূর্ত, সড়ক, মহাসড়ক বিভাগসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে ঘুরে ঘুরে তদবির করতেন বলে প্রচারণা ছিল আগে থেকেই।
অভিযোগ ওঠার পর মোয়াজ্জেম হোসেন ও তুহিন ফারাবিকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ২১ এপ্রিল মোয়াজ্জেম হোসেন এবং তুহিন ফারাবিকে অব্যাহতি দিয়ে সরকারি আদেশ জারি হয়। অন্যদিকে ডা. মাহমুদুল হাসান বর্তমানে রাশিয়ায় অবস্থান করছেন। তিনি সেখান থেকে ফিরবেন কি না, সংশয় আছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসার কাজের লোক ১৫ বছরে ৪০০ কোটি টাকার মালিক হওয়া আর আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার কাজের লোক সাত মাসে ৩০০ কোটি টাকার মালিক হওয়া নিয়ে ঐকিকের অঙ্ক কষা ফের কঠিন নয়। এনসিপির আরেক প্রভাবশালী নেতা গাজী সালাউদ্দিন তানভীরের বিরুদ্ধে তদবিরবাণিজ্যের অভিযোগ নিয়ে তাচ্ছিল্য করা হয়েছে। বলা হয়েছিল, এগুলো মিথ্যা-ভুয়া অভিযোগ। পরে জেলা প্রশাসক বদলিতে প্রভাব বিস্তার এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানে কেনাকাটায় কমিশনবাণিজ্য ধরা পড়লে তাকে এনসিপি থেকে বহিষ্কার করা হয়। শেখ হাসিনার কাজের ছেলে জাহাঙ্গীরকাণ্ডের নিউ ভার্সনের পর বহিষ্কার প্রকারান্তরে চুরিতন্ত্রের ভার্সন।
প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, একের পর এক উপদেষ্টার পিএস বা এনসিপি ঘরানার ব্যক্তিরা দুর্নীতি করছে কীভাবে? কারও পিএস ৩০০ কোটি টাকা অনিয়ম করে, কারও পিএস করে দেড় শ কোটি টাকা, কারও ৪০০ কোটি টাকা। কীভাবে করে? এসব মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টারা কেন এসব জানেন না? জানুয়ারি মাসে বই ছাপানো থেকে ৪০০ কোটি টাকা লুট করার পর সরকার কেন জুন মাসে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করতে আসে? তা-ও অভিযুক্তকে তার দল সাসপেন্ড করার পর। প্রধান উপদেষ্টা দেশের বহু মানুষের ১ জানুয়ারি জন্মদিন এটা জানেন; কিন্তু তার উপদেষ্টাদের পিএসরা শত শত কোটি টাকা অনিয়ম করছে এটা জানেন না কেন? সংস্কৃতি উপদেষ্টার দুর্নীতির অভিযোগ তুলে শিল্পকলার ডিজি পদত্যাগ করেছিলেন, সরকার সেই অভিযোগ তদন্ত করেনি কেন? নগদ থেকে দেড় শ কোটি টাকা মেরে দেওয়া ভদ্রলোক তার বউকে নগদে চাকরি দিয়েছেন, যার বেতন ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। বলছেন তার যোগ্যতা আর মেধায় চাকরি পেয়েছেন। এত মেধা তাদের? তার নিয়োগের জন্য সার্কুলার হয়েছিল কি? তিনি মেধার প্রতিযোগিতা করে এই চাকরি পেয়েছেন? ডাক উপদেষ্টার পিএসের বউ দেড় লাখ টাকা বেতনে ডাক মন্ত্রণালয়ের একটা দামি চাকরি পেয়েছেন, এটা নিয়ে মানুষের প্রশ্ন থাকবে- কৌতূহল থাকবে, এটা স্বাভাবিক।
গত কয়েক বছর নগদ যারা লুট করেছেন, তার মধ্যে প্রধান অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করার পর একজন বিশেষ সহকারীর চাপে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সেই সহকারী কে? প্রধান উপদেষ্টা কেবল সমৃদ্ধির স্বপ্ন দেখাবেন আর তাঁর উপদেষ্টাদের পিএসরা সপরিবার দুর্নীতি করবে, টাকা কামাবে, তা কি থ্রি জিরোতে পড়ে? অথবা এটাই কি নতুন বন্দোবস্ত? সাবেক উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের পিএস আতীক মোর্শেদসহ কিছু বিপ্লবী গত দুই মাসে নগদের দেড় শ কোটি টাকা সরিয়ে ফেলেছেন মানে নতুন একটা দলের কিছু নেতার কামাই-রোজগারের বন্দোবস্ত? আতীক নগদ অফিসের ছয় তলায় একটা রুম নিয়ে নগদের কাজ দেখাশোনা করেন এবং বউ জাকিয়া সুলতানাকে একটা বড় পদে আত্মীয়স্বজনের কয়েকজনকেও সেখানে চাকরি দিয়েছেন। নাহিদ ইসলাম ডাক ও টেলিযোগাযোগ তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা থাকার সময় একটুও টের পাননি? চব্বিশের আন্দোলনে এত প্রাণহানি, অঙ্গহানি এ জন্যই? হাসপাতালে কাতরানোদের চিকিৎসাও এরই মধ্যে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক। জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সেবা কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এই প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নিতে আসে। জুলাই অভ্যুত্থানে চোখ হারানো বা চোখে আঘাতপ্রাপ্তরা এখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন। প্রশাসনের বিরুদ্ধে তাদের যেমন অভিযোগ আছে আবার তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনেরও এন্তার অভিযোগ। ভালো চিকিৎসা না পেয়ে তারা বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। আবার পুলিশ, সেনাবাহিনীর ওপর হামলা করছেন। কর্মচারীদের পেটাচ্ছেন। ডাক্তারদের অবরুদ্ধ করছেন। কেনাকাটা-খাবার সরবরাহকাজে হস্তক্ষেপ করছেন-কখনো কখনো ঢাকার বিভিন্ন সভায় অংশ নিয়ে আবার হাসপাতালে গিয়ে শুয়ে থাকছেন। নার্স-কর্মচারী-কর্তৃপক্ষের এমন সব অভিযোগের বিপরীতে চিকিৎসাধীন আহতদের অভিযোগ চিকিৎসা না পাওয়ার। বেদনাও কীভাবে তামাশা হতে পারে? এ দায় কার? বছর ঘুরে আরেকটা জুলাই আসছে। জুলাই গণ অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের রাজনৈতিক দল এনসিপির আত্মপ্রকাশের তিন মাসের মধ্যে নানা অভিযোগে তিরবিদ্ধ দলটি। দলের মধ্যেও বিভক্তি। দলটির শীর্ষ নেতারা পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়ে নিজেদের মধ্যকার বিরোধ ও সমন্বয়হীনতা প্রকাশ করেছেন। একই সঙ্গে তাদের কয়েকজনের আচরণ ও কথাবার্তায় রাজনৈতিক বিবেচনাবোধের স্পষ্ট অনুপস্থিতি। অতি দ্রুত তারুণ্যের এমন দুর্গতি কাম্য ছিল না।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন